Ethics of Care বা যত্ননৈতিক নীতি একটি নৈতিক দর্শন যা সম্পর্ক এবং আন্তঃব্যক্তিক যত্নের গুরুত্বকে কেন্দ্রীভূত করে। এটি সাধারণত নারীবাদী দর্শন হিসেবে পরিচিত, তবে এটি এমন একটি নৈতিক ধারণা যা মানব সম্পর্কের মৌলিকতার প্রতি গভীর মনোযোগ দেয়। এই নীতিতে মনোযোগ দেয়া হয় যত্ন, সহানুভূতি, এবং সম্পর্কের প্রতি দায়িত্ববোধের ওপর, যা কেবল সাধারণ ন্যায়পরায়ণতা বা নিয়মের চেয়ে বেশি জটিল ও সম্পর্ক-ভিত্তিক।
কনফুসিয়াস নীতিদর্শন, যা প্রাচীন চীনা নীতিবিদ্যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধারাবাহিকতা, সমাজে শৃঙ্খলা, নৈতিকতা, এবং সম্পর্কের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। কনফুসিয়াসের নীতিতে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক যেমন পরিবার, সমাজ, এবং রাষ্ট্রের মাঝে নৈতিক দায়িত্ব এবং যত্নের ভূমিকা গুরুত্ব পায়। যদিও কনফুসিয়াসের নীতিবিদ্যা একেবারে প্রথাগত ধারণার দিকে ঝুঁকে থাকতে পারে, তবে তার শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই Ethics of Care এর মূল নীতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
এই নিবন্ধে, আমরা Ethics of Care এবং কনফুসিয়াস নীতিদর্শনের মধ্যে সম্পর্ক, মিল এবং পার্থক্য আলোচনা করবো।
—
Ethics of Care: মূল ধারণা
Ethics of Care ধারণাটি মূলত নারীবাদী দার্শনিক Carol Gilligan এর কাজের মাধ্যমে প্রসিদ্ধি লাভ করে। তাঁর ১৯৮২ সালের গ্রন্থ “In a Different Voice” এ, তিনি মূলত দাবি করেছিলেন যে, নারীরা প্রথাগত নৈতিকতায় (যেমন ন্যায়ের দৃষ্টিকোণ) তুলনায় সম্পর্ক এবং যত্নের দিকে বেশি মনোযোগী। তিনি দেখিয়েছিলেন, নৈতিক চিন্তা ও বিচার-বিশ্লেষণ একটি সম্পর্কভিত্তিক এবং প্রসঙ্গভিত্তিক প্রক্রিয়া হতে পারে, যা কেবল সাধারণ নিয়মের মেনে চলা নয়, বরং ব্যক্তিগত দায়িত্ব এবং সহানুভূতির মাধ্যমে মানবিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করে।
Ethics of Care একটি সম্পর্ক ভিত্তিক নীতি যেখানে সহানুভূতি, দায়িত্ব, এবং যত্নের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক স্থাপন করা হয়। এটি সমাজের বিভিন্ন স্তরে (পারিবারিক, সামাজিক, এবং রাষ্ট্রীয়) মানুষের আন্তঃসম্পর্কের গুরুত্বকে চিন্তা করে। এই নীতির মূল লক্ষ হল, যেকোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে যত্ন এবং সহানুভূতির মাধ্যমে মানবিক দায়িত্ব পালন করা।
কনফুসিয়াস নীতিদর্শন: মূল ধারণা
কনফুসিয়াস (Confucius) চীনা নীতিবিদ্যার একজন গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক যিনি মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের গুরুত্ব, সামাজিক শৃঙ্খলা, এবং নৈতিক উন্নতির ওপর জোর দেন। তাঁর শিক্ষা “রেন” (仁) বা মানবতার ধারণার চারপাশে ঘুরপাক খায়। রেন হল এমন একটি গুণ যা মানবতার প্রকৃত অর্থ, অন্যদের প্রতি সহানুভূতি এবং দয়া অনুভূতিকে নির্দেশ করে।
কনফুসিয়াসের নীতিতে সম্পর্কের ভিত্তিতে নৈতিকতার উন্নতি হয়। তাঁর মতে, পরিবার, বন্ধু, শিক্ষক, এবং রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কগুলো শুধুমাত্র সামাজিক শৃঙ্খলা নয়, বরং নৈতিক উন্নতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি “শি” (施), অর্থাৎ, কর্তব্য পালনের মাধ্যমে নৈতিক গুণাবলী বিকাশের কথা বলেছেন। এর মাধ্যমে পারস্পরিক দায়িত্ব এবং যত্নের গুরুত্ব স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। এছাড়াও, কনফুসিয়াস “লি” (礼) বা শিষ্টাচার এবং “শুন” (孝) বা পিতৃ-মাতৃভক্তির মাধ্যমে সামাজিক শৃঙ্খলা এবং সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।
মিল এবং সাদৃশ্য
1. সম্পর্কের গুরুত্ব:
Ethics of Care এর মূল বিষয় হল সম্পর্কের মধ্যে যত্ন এবং সহানুভূতির মূল্য। এটি বিশ্বাস করে যে মানুষের আসল নৈতিকতা এবং দায়িত্ব সম্পর্কের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। একইভাবে, কনফুসিয়াসের নীতিতেও সম্পর্কের মাধ্যমে নৈতিকতা গড়ে ওঠে। কনফুসিয়াস পরিবার, শিক্ষক, বন্ধু, এবং সমাজের মধ্যে সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
উদাহরণস্বরূপ, কনফুসিয়াসের শিক্ষা অনুযায়ী, পিতৃ-মাতৃভক্তি এবং পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব পালন, যা “শুন” (孝) নামে পরিচিত, এটি মানুষের অন্তরের ভালো গুণাবলী বিকাশে সাহায্য করে। এটি সম্পর্ক এবং যত্নের ভিত্তিতে নৈতিকতা গড়ার একটি প্রক্রিয়া।
2. মানবতার ধারণা:
Ethics of Care তে মানবিক দায়িত্ব এবং সম্পর্কের মধ্য দিয়ে যত্ন ও সহানুভূতির প্রসার ঘটানো হয়। কনফুসিয়াসের “রেন” (仁) ধারণার সঙ্গে এটি অনেকটাই মিল রয়েছে। “রেন” মানুষের অন্তর্গত ভালো গুণাবলী, যা অন্যদের প্রতি সহানুভূতি, দয়া এবং মানবতা প্রকাশ করে। এখানে নৈতিক দায়িত্ব ও যত্নের প্রক্রিয়া সম্পর্কিত যা Ethics of Care-র মূলধারার সঙ্গে যুক্ত।
3. সহানুভূতি ও দায়িত্ব:
উভয় দর্শনে সহানুভূতি ও দায়িত্ব পালনের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। Ethics of Care সম্পর্কের মাধ্যমে অন্যদের প্রতি সহানুভূতি এবং যত্নের দৃষ্টিকোণ থেকে দায়িত্ব পালন করে। কনফুসিয়াসও তাঁর নীতিতে বিশেষ করে পরিবার এবং সমাজে দায়িত্ব পালন, শিক্ষক এবং ছাত্রের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সহানুভূতির কথা বলেছেন। উদাহরণস্বরূপ, “শি” (施) বা কর্তব্য পালনের মাধ্যমে কনফুসিয়াস মানুষের নৈতিক উন্নতির কথা বলেন।
4. শিষ্টাচার এবং নৈতিকতা:
কনফুসিয়াসের “লি” (礼) বা শিষ্টাচার সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা এবং দায়িত্বের দিকে ইঙ্গিত দেয়, যা নীতিগত এবং সামাজিক শৃঙ্খলার ভিত্তি তৈরি করে। এটি Ethics of Care এর নৈতিক গুণাবলীর প্রতি দৃষ্টি দেয়, যেখানে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক এবং যত্নের মাধ্যমে মানুষের দায়িত্ব পালন করা হয়।
পার্থক্য
1. ফোকাসের দিক:
Ethics of Care মূলত নারীদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সম্পর্কের মূল্যায়ন এবং যত্নের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। এটি নারীদের দৈনন্দিন জীবনে যত্ন, সম্পর্ক এবং সহানুভূতির ওপর গুরুত্ব দিয়ে নৈতিকতা চর্চা করে। অন্যদিকে, কনফুসিয়াসের দর্শনটি মূলত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তিতে তৈরি, যেখানে পারিবারিক এবং সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে শৃঙ্খলা এবং দায়িত্বের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
2. সমাজের কাঠামো:
Ethics of Care সাধারণত ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে যত্ন এবং সহানুভূতির মাধ্যমে নৈতিকতার প্রসার ঘটায়। তবে কনফুসিয়াসের দর্শনে আরও ব্যাপকভাবে রাষ্ট্র এবং সমাজের শৃঙ্খলা এবং নৈতিক উন্নতির জন্য দায়িত্ব পালন করার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
3. মৌলিক নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি:
Ethics of Care সম্পর্কের প্রতি যত্ন এবং সহানুভূতির দৃষ্টিকোণ থেকে নৈতিকতা তৈরি হয়, যেখানে শুদ্ধতা এবং ন্যায্যতার ধারণা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন। কনফুসিয়াসের নীতিতে, যদিও সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, তবে এর মূল বিষয় হল নৈতিক আদর্শের প্রবর্তন এবং ঐতিহ্যগত শৃঙ্খলা। “লি” (礼) বা শিষ্টাচারের মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং সামাজিক দায়িত্ব পালন এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
—
উপসংহার
Ethics of Care এবং কনফুসিয়াস নীতিদর্শন উভয়ই মানুষের সম্পর্ক এবং দায়িত্ব পালনকে নৈতিকতার কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করে। তবে, Ethics of Care একটি সম্পর্কভিত্তিক নীতি যা নারীর দৃষ্টিভঙ্গিতে গড়ে উঠেছে, যেখানে যত্ন, সহানুভূতি এবং আন্তঃব্যক্তিক দায়িত্বের ওপর জোর দেওয়া হয়। অন্যদিকে, কনফুসিয়াসের দর্শনে পরিবারের শৃঙ্খলা, রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং সামাজিক আদর্শের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধার মাধ্যমে নৈতিকতা গড়ে ওঠে।
এই দুটি দর্শনই পারস্পরিক সম্পর্কের গুরুত্ব এবং মানুষের নৈতিক দায়িত্বে মনোযোগ দেয়, তবে একে অপরের থেকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বিকশিত হয়েছে। একে অপরের মধ্যে মিল থাকা সত্ত্বেও, তাদের দর্শন সমাজের বিভিন্ন স্তরে নৈতিক উন্নয়ন