সামাজিক শ্রেণীবিভাগ এমন একটি সমাজতান্ত্রিক কাঠামো যা একটি সমাজের সদস্যদের বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং রাজনৈতিক অবস্থানে ভাগ করে। এই শ্রেণীবিভাগের মধ্যে মূলত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিশ্লেষণ করা হয়: শ্রেণী, বর্ণ এবং লিঙ্গ। এগুলি শুধু যে একটি মানুষের জীবনের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাকে প্রভাবিত করে, তেমনিভাবে তাদের সমাজে অবস্থান, অধিকার এবং সুযোগও নির্ধারণ করে। এই প্রবন্ধে, আমরা শ্রেণী, বর্ণ এবং লিঙ্গ ভিত্তিক সামাজিক শ্রেণীবিভাগের তত্ত্ব, তার বিশ্লেষণ এবং বাস্তব জীবনে এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।
শ্রেণী (Class)
শ্রেণী সামাজিক শ্রেণীভিত্তিক পার্থক্যকে বোঝায়, যা সাধারণত অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষা, পেশা, বা জীবনের মানের ভিত্তিতে তৈরি হয়। সর্বাধিক পরিচিত শ্রেণীবিভাগের ধারণা হলো মাক্সবাদী তত্ত্বের ভিত্তিতে, যেখানে সমাজকে প্রধানত দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়—পুরস্কৃত শ্রেণী (bourgeoisie) এবং শ্রমিক শ্রেণী (proletariat)। মাক্সবাদী তত্ত্ব অনুসারে, শ্রেণী সংগ্রাম এই দুই শ্রেণীর মধ্যে সংঘটিত হয়, যেখানে পুঁজিবাদী শ্রেণী শ্রমিক শ্রেণীকে শোষণ করে।
এই শ্রেণীভিত্তিক বিভাজন সমাজে অসমতা সৃষ্টি করে, যেখানে উচ্চ শ্রেণীর সদস্যরা অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার সুবিধা লাভ করে, আর নিম্ন শ্রেণীর মানুষ সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, উন্নত দেশগুলোতে উচ্চশ্রেণীর মানুষ সাধারণত উন্নত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা লাভ করে, কিন্তু নিম্ন শ্রেণীর মানুষ সেই সুযোগগুলো থেকে বঞ্চিত।
বর্ণ (Race)
বর্ণগত শ্রেণীবিভাগ সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ধারণা, যা মূলত শারীরিক বৈশিষ্ট্য যেমন ত্বকের রং, চুলের ধরন ইত্যাদির ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করে। বর্ণগত শ্রেণীভেদ ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, যা শুধু ব্যক্তির সামাজিক অবস্থানকেই নির্ধারণ করে না, বরং তাদের পরিচিতির একটি বড় অংশ তৈরি করে।
বর্ণবাদ বা রেসিজম এক ধরনের সামাজিক বৈষম্য, যা এক জাতির মানুষকে অন্য জাতির মানুষের থেকে ন্যূনতম বা সর্বোচ্চ সুবিধা দেওয়ার প্রক্রিয়া। এই বৈষম্য শুধু যে সামাজিক জীবনে সীমাবদ্ধ থাকে তা নয়, বরং বর্ণবাদী শ্রেণীবিভাগ ব্যক্তির আস্থাশক্তি, চাকরির সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং আইনি অধিকারেও অবহেলিত থাকে।
মিশেল ফুকো, যিনি শক্তির তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছেন, তার মতে, বর্ণবাদী শ্রেণীভেদ সামাজিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং নিয়ন্ত্রণের একটি ব্যবস্থা। যখন জাতিগত বা বর্ণগত শ্রেণীভেদ সমাজের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তখন এটি সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে, যার মাধ্যমে কিছু গোষ্ঠী সবসময় অত্যাচারের শিকার হয়।
লিঙ্গ (Gender)
লিঙ্গভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ একটি সমাজের পুরুষ এবং মহিলার (এছাড়াও অন্যান্য লিঙ্গ পরিচয়ের) মধ্যকার পার্থক্য ও অসমতার ভিত্তিতে তৈরি হয়। লিঙ্গের ভিন্নতা সাধারণত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর মাধ্যমে গড়ে ওঠে, যা ‘পুরুষ’ এবং ‘মহিলা’ হিসেবে মানুষকে চিন্তা ও আচরণে সীমাবদ্ধ করে। তবে এই বিভাজন শুধুমাত্র দুটি লিঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি তৃতীয় লিঙ্গ বা লিঙ্গ-অপরাধী গোষ্ঠীর অধিকারকে অস্বীকারও করে।
ফেমিনিস্ট তত্ত্ব অনুসারে, লিঙ্গভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ মানব সমাজের গঠন, ভূমিকা, এবং অনুকূল সুযোগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজে পুরুষকে অধিকাংশ সময় ক্ষমতাশালী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, এবং মহিলাদের তথা নারীদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সামাজিকভাবে ন্যূনতম সুযোগ দেওয়া হয়। তবে, আধুনিক যুগে নারীরা নিজেদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আসছেন এবং কিছু ক্ষেত্রে তারা পুরুষের সঙ্গে সমান অধিকারের অধিকারী হয়েছেন।
একটি উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে লিঙ্গ বৈষম্যের প্রভাব এখনও প্রবল। যেমন ভারতে নারীরা এখনও অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষায়, কর্মসংস্থানে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পুরুষদের থেকে পিছিয়ে। যদিও বর্তমান সময়ে কিছু নারীবাদী আন্দোলন এবং সামাজিক পরিবর্তনের ফলে এই বৈষম্য কিছুটা কমেছে, তবুও সমাজের মূলধারায় নারীদের পুরুষের সমান অধিকার লাভের ক্ষেত্রে অসংখ্য বাধা রয়েছে।
সমাজে শ্রেণী, বর্ণ ও লিঙ্গের আন্তঃসম্পর্ক
শ্রেণী, বর্ণ এবং লিঙ্গের মধ্যে একটি জটিল সম্পর্ক বিদ্যমান, যা সামাজিক শ্রেণীবিভাগকে আরও জটিল এবং অন্তর্নিহিত করে তোলে। এই তিনটি উপাদান একে অপরের সাথে সম্পর্কিত, এবং এগুলোর মিলিত প্রভাব একজন ব্যক্তির জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সীমানা সৃষ্টি করে। এটি সমাজে দ্বৈত শ্রেণী ও বৈষম্যের জন্ম দেয়, যেখানে এক শ্রেণীর মানুষ তাদের ক্ষমতা ও সুযোগের মাধ্যমে অন্য শ্রেণীর মানুষের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে।
এটি একটি বাস্তব উদাহরণ হিসাবে দেখা যায়, যখন আফ্রিকান-আমেরিকান নারী একাধিক বৈষম্যের সম্মুখীন হন—তারা কেবল বর্ণগত বৈষম্য এবং লিঙ্গবৈষম্য ভোগ করেন না, বরং তারা শ্রেণীভিত্তিক অত্যাচারের শিকারও হন। তাদের ন্যূনতম অধিকার ও সুযোগে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, যার ফলে তাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
উপসংহার
সামাজিক শ্রেণীবিভাগের তত্ত্ব আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে শ্রেণী, বর্ণ, এবং লিঙ্গ কিভাবে সমাজের ভিতরে অসমতা তৈরি করে এবং সেই অসমতা সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলে। প্রতিটি উপাদান—শ্রেণী, বর্ণ, এবং লিঙ্গ—সমাজের বিভিন্ন স্তরে একে অপরের সাথে জড়িত, এবং এটি মানব জীবনের সুযোগ, মর্যাদা এবং অধিকারকে প্রভাবিত করে। তাই এই বৈষম্য দূর করতে এবং একটি সমতা ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে যথাযথ প্রচেষ্টা প্রয়োজন।