অন্যভাবে দেখলে মিথের যে প্রয়োজনীয়তা একসময় মানব সমাজে ছিল, এবং মিথ যেভাবে মানুষকে প্রেরণা ও শক্তি যুগিয়েছে, এই সব ‘বিতিকিচ্ছিরি’(!) চলচ্চিত্র গুলোও একই কাজ করছে। বরং তার চেয়ে ভাল কাজ করছে, কারন এখন সে শুধু শুনছেই না বরং দেখছেও এবং দেখছে অহরহ।
জাহিদুল ইসলাম
গ্রিক পুরাণের নয় মাথা ওয়ালা হাইড্রা ছিল পাতাল জগতের প্রবেশেদ্বারের পাহারাদার। লার্না নামক অঞ্চলে হাইড্রা পাতালের পথ পাহারা দিত। কিন্তু লার্না অঞ্চলের মানুষ হাইড্রার অত্যাচারে ছিল অতিষ্ঠ। অত্যাচারী হাইড্রাকে হত্যা করার জন্য আসলেন অতি প্রাকৃত শক্তির অধিকারী হারকিউলিস এবং শেষে হাইড্রাকে পুড়িয়ে মারেন তিনি।
মর্ত্যের উপর এক অত্যাচারী শাসক ছিল কংস। কংসকে বধ করার জন্য আসলেন এক অবতার, শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণের শক্তির আধার ছিল অমর্ত্য জগতের দেবতারা। তেমনই আরেক অবতার রাম। রাবনের মত ভয়াল দানবকে পরাজিত করার জন্য দৈব শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধে এবং অবশেষে জয় হয় রামের।
ইসলাম ধর্মেও দেখি আল্লাহ তায়ালা মূসা (আঃ) কে ঐশ্বরিক শক্তি দান করেছিলেন ফেরাউনের মত অত্যাচারী শাসককে পরাজিত করার জন্য।
উপরের প্রত্যেকটি ঘটনাতেই একটি সধারণ দৃশ্য দেখা যায়- যেখানে একটি প্রচন্ড অত্যাচারী চরিত্র আছে যাকে সাধারণ মানুষ কর্তৃক পরাজিত করা অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে এবং এই চরিত্রের বিপরীতে একটি অতিপ্রাকৃত অলৌকিক শক্তিধর চরিত্রের আবির্ভাব হয়েছে যে অত্যাচারীকে পরাজিত করেছে।
খেয়াল করলে দেখবো এই পৌরাণীক ও ধর্মীয় কাহিনীগুলো ইতিহাস জুড়ে মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে প্রেরণা জুগিয়ে এসেছে। রাম-রাবনের কাহিনী, মুসা-ফেরাউনের কাহিনীগুলো যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য প্রেরণা হিসেবে লেখক, প্রচারক, এবং ধর্মীয় ব্যাক্তিত্ত্বরা ব্যবহার করেছেন। এবং মানুষও এইসকল কাহিনীগুলোর সাথে নিজেকে মিলিয়েছে, প্রেরনা নিয়েছে এবং এ কারণেই এসকল পুরাণ ও ধর্মীয় কাহিনীগুলোর উপযোগীতা এখনো বিদ্যমান। এমিল ডুরখেইমের ভাষায় এখনো এই কাহিনীগুলো ‘ফাংশনাল’; অর্থাৎ এগুলো সমাজের স্থিতিশীলতা (স্ট্যাবলিটি) রক্ষা করতে সাহায্য করছে।
কেজিএফ চলচ্চিত্রটি যখন খুব বেশি আলোচিত হচ্ছিল তখন এই চলচ্চিত্রের প্রতি আমার একটি অগ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি আকিরা কুরোসাওয়া, ওজু, অরসন ওয়েলস দেখা মানুষ। সেই ইগোতেও এইসব চলচ্চিত্রকে প্রথম জ্ঞানে নাকোচ করে দেওয়ার প্রবণতাই তৈরি হওয়ার কথা। এছাড়াও ফেসবুকের কল্যানে মালালায়াম ও তামিল চলচ্চিত্রগুলোর বিজ্ঞান বিবর্জিত ক্লিপ দেখে এইসকল চলচ্চিত্রগুলোকে ‘ভালো লাগানোর’ ইচ্ছাও চলে গিয়েছিল। একদিন বন্ধুদের আড্ডায় কেজিএফ-কেন্দ্রিক আলাপে শরিক হতে না পারার আক্ষেপ থেকে দাঁত মুখ খিঁচে(!) চলচ্চিত্রটা দেখে ফেললাম এবং পরবর্তীতে ধীরে ধীরে এইসকল চলচ্চিত্রগুলোর প্রতি একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচিত হল-
খেয়াল করলে দেখবেন, এইসকল চলচ্চিত্রগুলোর থিম এবং উপরে বর্ণিত পুরাণ ও ধর্মীয় কাহিনীগুলোর মধ্যে একটি মিল আছে। এসকল চলচ্চিত্রেও কোন এলাকায় বা রাষ্ট্রে একটি ভয়ংকর সন্ত্রাসী চক্র বা ক্ষমতাশালী চক্রের উপস্থিতি দেখানো হয়। সাধারণ মানুষের জান, মাল, সম্ভ্রম যাদের কাছে একেবারে তুচ্ছ বিষয় এবং সাধারণ মানুষ এদের সাথে কখনোই পেরে ওঠেনা। তার বিপরীতে হঠাৎ-ই ত্রানকর্তা হিসেবে একজন নায়কের আবির্ভাব হয় যার এক প্রকার কিছু অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা থাকে। যেমন- মাটির উপর জোরে হাত রাখলেই ঘিরে থাকা শত্রুরা উড়ে যাচ্ছে, লাফ দিয়ে আগুন পেরিয়ে যাচ্ছে, লোহা ভেঙ্গে ফেলছে, একাই খালি হাতে শত শত সশস্ত্র সন্ত্রাসীকে পরাজিত করছে ইত্যাদি। অর্থাৎ সেই চুড়ান্ত রকমের শক্তিশালী অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অলৌকিক ক্ষমতার অধীকারী একজন এসে মুখোমুখি হয়, সাধারণ মানুষের হয়ে সে লড়াই করে এবং তার অবতার সুলভ শক্তি দ্বারা অন্যায়কে পরাজিত করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল একজন নায়ককে শুধু অবতারদের মত শক্তিশালী হিসেবেই দেখানো হয়না বরং একজন মানুষ হিসেবেও তাকে চিত্রায়িত করা হয়। এজন্য তার জীবনেও প্রেম আনা হয়; দুক্ষ, বেদনা, কান্না, হাসি ইত্যাদিও আনা হয়। নায়কদেরক যদি শুধু শক্তিই দেখানো হত তাহলে এই নায়কদের এত গ্রহনযোগ্যতা থাকত না, বরং তাদেরকে সাধারণ মানুষের আবেগে চিত্রায়িত করা হয় বলে, তারাও যে মানুষ ব্যাতিত আর কিছুই নয় এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়; অলৌকিক শক্তি থাকার পরও মানুষ তাকে অলৌকিক অস্তিত্ব কল্পনা না করে বরং নিজেদেরই একজন হিসেবে ভাবে। এবং চলচ্চিত্রের শেষে প্রতিষ্ঠিত হয় একজন মানুষের দ্বারাও চূড়ান্ত শক্তিশালী অন্যায় প্রতিহত হওয়া সম্ভব।
বিষয়টি হল- মানুষ যখন অনেক বেশি অত্যাচারিত হয়, মানুষ যখন অত্যাচারীকে পরাজিত করার সকল শক্তি হারিয়ে ফেলে অথবা যখন অত্যাচারী এতটাই শক্তিশালি হয়ে ওঠে যে সাধারণ মানুষের সম্মিলিত শক্তিও অত্যাচারীকে পরাজিত করতে অক্ষম তখন মানুষের মাঝে দুটি বোধের জাগ্রত হয়- হয় সে নির্দিধায় অত্যাচার এবং অন্যায়কে মেনে নেয় এবং নিজেও সিস্টেমের অংশ হয়ে ওঠে অথবা সে মনে মনে একটি শক্তির, একটি নতুন উত্থানের কামনা করে যা তাকে এই নাগপাশ থেকে মুক্তি দিতে পারবে। এই চলচ্চিত্রগুলো দ্বিতীয় শ্রেনীর মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
কেজিএফ বা এইধরণের তামিল, মালালায়াম চলচ্চিত্রগুলোর উপযোগীতা এখানেই। মানুষ যখন জনপ্রীয় সংস্কৃতিতে দেখে যে বৃহৎ অন্যায় শক্তিরও পতন হয় এবং সে পতনটা হয় মানুষের হাতেই তখন অন্যায় সিস্টেমের প্রতি তার যে ক্ষোভ, তার যে বিরোধ, এই বিরোধের আগুন প্রজ্জ্বলিত রাখার জন্য সে নতুন বিচালি পায়। অন্যায়ের চাপে অতিষ্ঠ হয়ে অন্যায়ের অংশ হয়ে যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে যে প্রেরণা প্রয়োজন সে প্রেরণা পায়। অন্যায়কে সে অপরাজেয় শক্তি হিসেবে মনে করেনা। চলচ্চিত্রে অন্যায় এবং দুষ্টকে পরাজিত করার বাস্তব দৃশ্যায়ন (ভিজুয়ালাইজেশন) তার কাছে অন্যায়কে পরাজিত করতে পারার সম্ভাব্যতাকে আরো বেশি বৃদ্ধি করে।
অন্যভাবে দেখলে মিথের যে প্রয়োজনীয়তা একসময় মানব সমাজে ছিল, এবং মিথ যেভাবে মানুষকে প্রেরণা ও শক্তি যুগিয়েছে, এই সব ‘বিতিকিচ্ছিরি’(!) চলচ্চিত্র গুলোও একই কাজ করছে। বরং তার চেয়ে ভাল কাজ করছে, কারন এখন সে শুধু শুনছেই না বরং দেখছেও এবং দেখছে অহরহ।
এসকল অবৈজ্ঞানিক, অবাস্তব, এবং কিছু ক্ষেত্রে হাস্যকর চলচ্চিত্রগুলোও যে এই পুরো উপমহাদেশে ব্যাপক হারে চলছে তার সম্ভাব্য কারণ হয়ত এখানের মানুষেরা তাদের সরকার, রাজনীতি, সামাজিক দুষ্ট চক্র এবং ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে সন্তুষ্ট নয় এবং সবাই মনে মনে একটি সংস্কারের অপেক্ষা করছে। বাস্তবে অন্যায়ের কাছে পরাজিত এই মানুষগুলো তাই অন্যায়কে চলচ্চিত্রে পরাজিত হতে দেখে আনন্দ পায়।
অনেকে বলতে পারেন চলচ্চিত্র নির্মাতারা এত সচেতনভাবে চলচ্চিত্রগুলো তৈরি করেনা। এ কথা সত্য, কিন্তু অসচেতন ভাবেও যা তৈরি করা হয় তারও একটি বার্তা থাকে। সাধারণ মানুষ যখন বার্তাটি গ্রহন করে তখন শুধুমাত্রই কাজটির উপাদানের আলোকেই বার্তা গ্রহন করে।
আপত্তি থাকতে পারে যে, এইসব চলচ্চিত্র আপনাকে অইভাবে ভাল-খারাপের রূপক হিসেবে ভাবায় না; হয়তবা কোন প্রভাবই আপনার উপর ফেলেনা বলে দাবি করবেন। কিন্তু এই চলচ্চিত্র গুলোর প্রভাব আপনার মত শিক্ষিত, শহুরে, সচেতন একজন ব্যাক্তির উপর না পড়লেও যাদেরকে আপনি জিডিপির লাভ লোকসান বুঝাতে পারবেন না, মার্ক্স-লেলিন পড়িয়ে বিপ্লবী করতে পারবেন না, গাজ্জালি-তাইমিইয়্যা পড়িয়ে জিহাদী বানাতে পারবেন না, অধীকার-ব্যক্তিস্বাধীনতা-গণতন্ত্র কি তা বুঝাতে পারবেননা- এমন মানুষের উপর অনেক প্রভাব বিস্তার করে। গ্রাম বা শহরের রিক্সাচালক ও খেটে খাওয়া মানুষদের তাদের নিজেদের আড্ডায় গেলে দেখবেন এই সকল চরিত্রগুলোকে তারা বাস্তব কোন অন্যায়কে রোধ করার জন্যও কল্পনা করে থাকে।
একটি সম্ভাবনা থাকে যে, এইসকল চলচ্চিত্র গুলো সাধারণ মানুষের জন্য ‘আফিম’ হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ এইসকল চলচ্চিত্র সাধারণ মানুষের মনের ক্ষোভকে প্রশমিত করে দিতে পারে যেহেতু তারা চলচ্চিত্রের শেষে অন্যায়কে পরাজিত হতে দেখে একটি সন্তুষ্টি পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি এমন হবেনা, কারণ তারা এই চলচ্চিত্র দেখে কোন এন্টিটির উপর ভরসা করে বসে থাকবেনা বরং অন্যায়কে উৎখাতের প্রচেষ্টায় নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করার চেয়ে নায়কের ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে চাইবে।
লেখকঃ জাহিদুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
যোগাযোগঃ jahidmn3@gmail.com
Writing is not a view of the School of Thought, it is entirely the opinion of the Author.
If you want to share your thought, you can mail us at- editor.sot@gmail.com