সমাজ যখন তার উপাদানগুলোর অবিচ্ছিন্নতা রক্ষা করতে চায়, তখন বেধে দেয় নানা নিয়ম শৃঙ্খলার বেড়াকল। এরই যখন পরিবর্তন দেখে তখনি একে অবক্ষয় বলে সজ্ঞায়িত করতে চান সমাজবিদরা। বোধ মানুষকে সচেতন করে তুলে। সে তার চারিপার্শ্ব সম্পর্কে সচেতন ধারণা রাখে।
মোঃ ওয়ালিদ হোসেন তামিম
একটি দেশের উন্নতির সোপানগুলোকে ঠিক রাখেন তার অধিবাসীরা । উন্নয়ন বলতে শুধু বাহ্যিক উন্নয়ন নয়, মানসিক উন্নয়নও বটে। সময় যেভাবে বয়ে চলে, তার সাথে সংস্কৃতিও প্রবাহিত হতে থাকে, এর পরিবর্তন ঘটতে থাকে প্রতিনিয়ত। আজকের সমাজে যা ট্যাবু, অগ্রাজ্য, অপ্রত্যাশিত, কালের প্রবাহে কোন এক সমাজ সংস্কৃতির অংশ হয়ে যেতে পারে তা।
বর্তমান সময়ে আকাশ সংস্কৃতি কিংবা যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর প্রভাবে সমাজের পরিবর্তন ঘটছে খুব দ্রুত। তাই এ অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্খিত ট্যাবুগুলোকে মানিয়ে নিতে প্রয়োজন বোধিবৃত্তিক বিকাশ।
সমাজবিদরা যাকে সামাজিক অবক্ষয় বলে সজ্ঞায়িত করেন, আমার মতে তা পরিবর্তন এরই অংশ। সমাজ যখন তার উপাদানগুলোর অবিচ্ছিন্নতা রক্ষা করতে চায়, তখন বেধে দেয় নানা নিয়ম শৃঙ্খলার বেড়াকল। এরই যখন পরিবর্তন দেখে তখনি একে অবক্ষয় বলে সজ্ঞায়িত করতে চান সমাজবিদরা। বোধ মানুষকে সচেতন করে তুলে । সে তার চারিপার্শ্ব সম্পর্কে সচেতন ধারণা রাখে ।
বোধিবৃত্তিক বিকাশে প্রধান ভূমিকা পালন করেন সাহিত্যিক লেখকরা। তারাই প্রধান সমাজ সংস্কারকের ভূমিকা পালন করেন। যা সমাজকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। রাষ্ট্রের ধারণা, সমাজের ধারণা, নাগরিকের ধারণা এগুলোর সূচনা বোধিবৃত্তিক বিকাশের মাধ্যমে। যার সূচনা হয় প্রাচীন গ্রিসে, পরবর্তীতে রোমান সাম্রাজ্য, বাইজেন্টাইন, আরবীয়দের মাধ্যমে তা বিকশিত হয়। পশু শিকার, বর্বতার যুগ থেকে আধুনিক যুগের আগমনের মূল সূতিকাগার ছিল বোধিবৃত্তিক চর্চা কেন্দ্রগুলো। বোধিবৃত্তিক চর্চা মানুষকে তার অধিকার সম্পর্কে করে তুলে সোচ্চার, হয়ে উঠে প্রতিবাদী। একজন যদি নাই বুঝে তার অধিকার খুন্ন হচ্ছে তবে তার মধ্যে এ অধিকার আদায় করে নেয়ার স্পৃহা আসবে কি করে?
যেমন স্বাধিকার আন্দোলন, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬ এর ৬ দফা, ৬৯ এ গণঅভ্যুথান, ৭১ এ স্বাধীনতা মূলত বোধিবৃত্তিক চর্চারই ফসল। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সূচনা করে ছাত্ররা, তারপর স্বাধীনতার জন্য সোচ্চার হওয়া, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সবই কিন্তু বোধিবৃত্তিক চর্চারই চূড়ান্ত রূপ ।
শুধু বাংলাদেশ না পৃথিবী জুড়েই তা সত্য। কার্ল মার্ক্স কিংবা লেনিন যখন অনুধাবন করতে পারেন সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা এবং রাজতন্ত্রের গুঁড়দিকগুলো, তারা মানুষদেরকে দিক্ষিত করেন সে দীক্ষায়, যার ফলে সমাজে আসে পরিবর্তন। যার ফল ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আজকের গণচীন। সমাজ যেহেতু পরিবর্তনশীল এবং যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর সক্রিয় প্রভাব একে করেছে দ্রুত পরিবর্তনশীল এক চলকে। এ পরিবর্তনকে গ্রহণ করার মানসিকতা সৃষ্টি করতে প্রয়োজন বোধিবৃত্তিক বিকাশ ।
বোধিবৃত্তিক বিকাশ যদি যথার্থ না হয় তার সক্রিয় ভূমিকা আজ সমাজে প্রত্যক্ষ। যেখানে ইয়েমেন, সিরিয়া কিংবা আফ্রিকায় হাজার হাজার নিরাপরাধ শিশু মারা যাচ্ছে যুদ্ধের করাল গ্রাসে, সেখানে এই হৃদ্য সংকুল বিষয়গুলো আমাদের অনেকেরই হৃদয় স্পর্শ করে না। হই না প্রতিবাদে সোচ্চার। আমাদের আগ্রহী করে তুলে সস্তা বিনোদন।
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং সমসাময়িকদের মাধ্যমে বাংলায় যে বোধিবৃত্তিক বিকাশ শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরও তা অব্যাহত থাকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ুন আজাদ, আহামদ ছফা সহ সমসাময়িক অনেকের হাত ধরে। তথাপি আজকের সময়ে বোধিবৃত্তিক বিকাশের এ বেহাল দশা কেন? এর পিছনে অনেক কারণই দায়ী থাকতে পারে। তবে রাজনীতিক অসহিষ্ণুতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি অন্যতম প্রধান দুটি ।
মানুষ্যর মাঝে বোধিবৃত্তিক বিকাশ যথার্থ না হয়ে থাকলে তারা গোঁড়ামিতে হয়ে থাকে আচ্ছন্ন।
এই যেমন প্রায়শই আমরা শুনি ধর্ষন সম্পর্কিত নানা ঘটনা। এ নিয়ে চলে আলোচনা সমালোচনা, চলে প্রতিবাদ। এখানে এক শ্রেণির আভির্ভাব ঘটে যারা ধর্ষনের প্রধান কারণ বলে দায়ী করে কাপড়কে। এই গোড়ামিতে আচ্ছন্ন মানুষের সংখ্যা কিন্তু নেহাত কম নয়। বোধিবৃত্তিক বিকাশে বিকশিত হলে এ মানুষগুলো পরিবর্তনকে সহজে গ্রহণ করত। তারা মধ্যযুগীয় এ পাশবিক নির্যাতনকে সমর্থন না করে হয়ে উঠত আন্দোলনে সোচ্চার। অথবা আত্মশক্তির অভাবে আন্দোলনে সোচ্চার না হতে পারলেও এমন সব অযাচারকে করত মন থেকে ঘৃণা।
এ সকল গোঁড়ামির সাথে বোধিবৃত্তিক বিকাশের অভাব প্রধানত দায়ী। বোধ হচ্ছে সচেতনতার সর্বোচ্চ স্তর। সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি সম্পর্কে সচেতনতাকেই বোধশক্তিসম্পন্ন হওয়া বুঝায়। আত্মসচেতন মানুষই জাতীয় উন্নতির প্রধান ধারক ও বাহক। তাই দ্রুত পরিবর্তনশীলতার যুগে আমাদের বোধিবৃত্তিক বিকাশ অত্যাবশ্যক। অন্যথায় এমন এক পরিবর্তীত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে যেখানে বর্তমান সময়ের ন্যায়গুলো পরিবর্তীত হবে ট্যাবু রূপে আর অন্যায়গুলো হয়ে যাবে আকাঙ্খিত স্বাভাবিক সত্য ।
লেখকঃ
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
যোগাযোগঃ walidhossen2@gmail.com
Writing is not a view of the School of Thought, it is entirely the opinion of the Author.
If you want to share your thought, you can mail us at- editor.sot@gmail.com