প্রাকৃতিক নির্বাচনঃ প্রকৃতির শাসন

প্রত্যেক বাবা-মায়ের সন্তানই জিনগত রূপান্তর (Genetic Mutation) এর কারণে বাবা-মায়ের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন ধরনের আচরণ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায়।

জাহিদুল ইসলাম

কোন প্রক্রিয়ায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের প্রাণি এবং শীত প্রধান অঞ্চলের প্রাণি বন্টিত হলো? কিংবা একই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জীববৈচিত্র্য কেন দেখা যায়? পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রাণি থাকবে এটি নির্ধারণই বা কে করে?

এইসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় ডারউইনের ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ তত্ত্বের মাধ্যমে। ‘Natural Selection’ বা প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব মতে- এই পৃথিবীতে কোন প্রজাতি টিকে থাকবে বা বিকশিত হবে (অন্য কথায় বিবর্তিত হবে) আর কোন প্রজাতি টিকে থাকবেনা সেটি প্রকৃতি নিজেই নির্ধারণ করে। মজার বিষয় হচ্ছে, ডারউইনের মতে এটি কোনো দৈব ঘটনা নয় বরং এটি সুশৃঙ্খল ও পদ্ধতিগত ঘটনা।

বিষয়টি বুঝতে হলে ‘Descent with Modification’ বা ‘বংশধরে পরিবর্তন’ এর বাস্তবতাটি (fact) বুঝতে হবে। প্রত্যেক বাবা-মায়ের সন্তানই জিনগত রূপান্তর (Genetic Mutation) এর কারণে বাবা-মায়ের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন ধরনের আচরণ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায়। প্রত্যেক প্রাণির বংশধরেই এই আচরণ-বৈশিষ্ট্যের বিচ্যুতি দেখা যায়। এই বাস্তবতাটিকেই ‘Descent with Modification’ বলে। এই নতুন বৈশিষ্ট্যের কোন সন্তানটি টিকে থাকবে সেটা নির্বাচন করে প্রকৃতি।

যেমন ধরুন, আপনার এলাকার সকল গাছের রং খয়েরি। সেখানে খয়েরি রংয়ের প্রজাপতিরা সহজেই লুকিয়ে থাকতে পারে। পাখি বা অন্যান্য প্রাণি সহজে তাদেরকে চিহ্নিত করতে পারে না। কিন্তু ধরুন, কোনো কারণে ঐ এলাকার মাটিতে নতুন উপাদান যুক্ত হলো বা পূর্বের কোনো উপাদান সরে গেলো যার কারণে গাছের রংয়ের পরিবর্তন হলো। কি হবে! খয়েরি রংয়ের প্রজাপতিগুলো দৃশ্যমান হবে। ফলে পাখি ও অন্যান্য খাদক তাদের চিনে নিতে পারবে এবং ঐ খয়েরি প্রজাপতি প্রকৃতিতে টিকতে না পেরে হয় বিলুপ্ত হবে নয়ত ঐ পরিবেশ ছেড়ে চলে যাবে। ফলে ঐ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য নতুনভাবে নির্ধারিত হবে। প্রাকৃতিক নির্বাচনে খাদ্য শৃঙ্খল অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আবার ধরুন, একটি পরিবেশে হরিণ খাদ্যের জন্য ঘাসের উপর নির্ভর করে। কোনো কারণে সেখানে ঘাসের অপ্রতুলতা দেখা দিলে হরিণকে সেখানে গাছ থেকে পাতা ছিড়ে খাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এই অবস্থায় ধরুন হরিণের দুটি সন্তান হলো।

একটি স্বাভাবিক এবং অপরটির পা এবং গলা স্বাভাবিক থেকে খানিকটা লম্বা ( Descent with Modification)। দেখা যাবে, স্বাভাবিক সন্তানটি খাদ্যের অভাবে পর্যাপ্ত পুষ্টি পাবে না। কারণ গাছ থেকে পাতা খাওয়ার মত উচ্চতা তার নেই। ফলে অন্য খাদক দ্বারা তার ভক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অপরদিকে পা ও গলা লম্বা শাবকটির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি। কেননা এটি সহজেই খাদক থেকে পালিয়ে বেড়াতে পারবে এবং গাছের পাতা সহজে খেতে পারবে। এই শাবকটির যে বংশধর আসবে তাদের পা ও গলাও উঁচু হবে। পরবর্তীতে এদের বংশধরদের পা ও গলা আরো উঁচু হবে। ফলে ঐ শাবকের প্রজাতিটি ঐ পরিবেশে টিকে যাবে। আর অপরগুলো হয় বিলুপ্ত হবে নয়ত ঐ পরিবেশ ছেড়ে চলে যাবে। এইভাবেই বলা হয় জিরাফের গলা লম্বা হয়েছে। এই প্রক্রিয়াটি উৎকৃষ্ট বীজ বাছাই করে উৎকৃষ্ট ফল উৎপাদন করার মতই।

তবে, একমাত্র প্রাকৃতিক নির্বাচনই বিবর্তন ও টিকে থাকার একমাত্র প্রক্রিয়া না৷ এটি আরো অনেকগুলো পদ্ধতির মধ্যে একটি। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো প্রজাতির বিবর্তন, বিলুপ্তি ও টিকে থাকা শত সহস্র বৎসরব্যাপী ঘটনা। এই প্রক্রিয়াটি অবশ্যই ‘Survival of the Fittest’ থেকে আলাদা।

এভাবে কোনো এলাকার খাদ্য শৃঙ্খল এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ- এককথায় পুরো প্রকৃতি মিলে নির্ধারণ করে ঐ পরিবেশে কোন প্রাণিটি টিকে থাকবে এবং কোন প্রানিটিকে ঐ পরিবেশের দরকার। এটি কোনো দৈব (random) পদ্ধতি নয়। এই প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমেই একই প্রজাতিতে ভিন্নতা দেখা যায়।

মনে করা হয়, এই প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর সকল জীবিত বস্তু একটি অপরটির সাথে সংযুক্ত। কারণ পৃথিবীর সকল জীবিত বস্তুই প্রকৃতির স্বরূপ নির্ধারণ করে। এবং এটি আমাদের শেখায় পৃথিবীর কোনো জীবই অপ্রয়োজনীয় বা অগুরুত্বপূর্ণ নয়, তাদের প্রত্যেকেই প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পৃথিবীতে অবদান রাখে। এটি প্রমাণ করে, হাজার বছর ধরে প্রকৃতি নিজের শাসনেই তার এই চমৎকার পৃথিবীকে শৈল্পিক পদ্ধতিতে সাজিয়েছে। এই শৈল্পিক কাজে মানুষ প্রজাতির একটুখানি হস্তক্ষেপও প্রকৃতি সুদে-আসলে ও আরো বাড়িয়ে ফিরিয়ে দিবে। কারণ মানুষ নিজেও প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃতির শাসনের গন্ডির আওতায়ই অবস্থান করে।

লেখকঃ জাহিদুল ইসলাম

শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সরকার ও রাজনীতি বিভাগ

যোগাযোগঃ jahidmn3@gmail.com

Writing is not a view of the School of Thought, it is entirely the opinion of the Author.

If you want to share your thought, you can mail us at- editor.sot@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *