মানুষের ওপর কল্পিত শৃঙ্খলের প্রভাব ও পরিণতি

বৃহৎ সংখ্যক মানুষকে এক বৃক্ষের নিচে আনতে, বিশ্বাস ও শক্তি যোগাতে কাল্পনিক শৃঙ্খল একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

প্রকাশ মৈত্র

“Man is by nature a social animal.” গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল বহু আগে বলে গিয়েছিলেন। মানুষ কি সত্যিই সামাজিক পশু? এটা প্রমাণ করতে গেলে আমাদের একই সাথে দুটো প্রমাণ লাগবে। এক হলো, মানুষ সামাজিক। দুই হলো, মানুষ আদতে একটা পশু। আমি দুইয়ের কোনোটাতেই একেবারে যাচ্ছিনা। বরং সমাজ ও পশু – দুটো ঘেঁষে কিছুটা দূর যাওয়ার চেষ্টা করব।


প্রথমে একটু ইতিহাসে উঁকি দিয়ে আসা যাক। মানুষের উদ্ভব কবে? এ পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে পুরোনো মানব ফসিল বা জীবাশ্মের বয়স প্রায় ২০ লক্ষ বছর। তবে আজকের মানুষ বলতে আমরা যা বুঝি, ২০ লাখ বছর আগের সেই মানুষ তার ধারেকাছেও নেই। কেবলমাত্র আমাদের চারপাশে দেখা সাধারণ এক স্তন্যপায়ী পশুর চেয়ে বেশিকিছু নয়। তখনকার মানুষের আজকের এই সমগ্র বিশ্বজুড়ে শাসকরূপে আবির্ভূত হওয়ার প্রাথমিক ভিত্তি প্রস্তুত হয় আজ থেকে প্রায় ৭০ হাজার বছর পূর্বে বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের মাধ্যমে। প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষের মস্তিষ্কের আয়তন ছিল মাত্র ৬০০ ঘন সেন্টিমিটার। তা থেকে বৃদ্ধি পেতে পেতে আজকের আধুনিক মানুষের মস্তিষ্কের আয়তন হয়েছে প্রায় ১২৬০ ঘন সে.মি। এই যে একটা দীর্ঘ কয়েক হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় মস্তিষ্কের আয়তনের যে দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া, এটা বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের ফলেই সম্ভব হয়েছে। তখন থেকেই  মানুষের ডিএনএ (DNA) তে অবস্থিত জিনের দ্রুত মিউটেশন(Mutation)  ঘটতে থাকে। মানুষের মনের ভাব প্রকাশের একটা প্রেরণা কাজ করতে শুরু করে। সেই মোতাবেক মানুষের ভেতরে ধীরে ধীরে জন্ম নিতে থাকে ভাষা। এক মানুষ অন্য মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে ভাষাকে ব্যবহার করতে শুরু করে। কোনো সমস্যাকে মোকাবিলা করতে সবাই ভাষা ও বুদ্ধিকে ব্যবহার করে একত্র হতে থাকে। মূলত সমস্যা সমাধানে একত্র হবার এই চাহিদাই মানুষকে একটু একটু করে সমাজ গড়ার দিকে ঝুঁকে দেয়। প্রাচীন পশুত্ব থেকে সরে এসে, পাথুরে গুহার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে সামাজিক হতে শুরু করে আদিম মানুষ। কিন্তু এত সংখ্যক মানুষ একত্র হল কিভাবে? এর নেপথ্যে কি রয়েছে?

শারীরিকভাবে বিবেচনা করলে মানুষ দুনিয়ার অন্যতম অলস প্রাণী। একটা ছোটো পিঁপড়েও তার ওজনের ১০ থেকে ৫০ গুণ পর্যন্ত ওজন বহন করতে পারে। কিন্তু একজন মানুষ একা তেমন কিছুই করতে পারবেনা। তবুও এই প্রাণীটি কিভাবে সমগ্র পৃথিবীর রাজা ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো? এর কারণ, মানুষের শক্তির মূল জায়গা হলো কোনো একটা কাজে তার গোত্রের বহু মানুষকে একত্রীকরণ। এই একত্র করার কাজে সে ব্যবহার করে এক বা একাধিক সাধারণ কল্পনা ও তার প্রতি গোত্রের সকলের সমান বিশ্বাস।

একটা উদাহরণ দিলে হয়ত বিষয়টা পরিষ্কার হবে। ধরুন, আপনি একটা কোম্পানি খুলবেন। কোম্পানি খুলতে কি দরকার? বিনিয়োগ। এখন, আপনি আপনার অপরিচিত চারজন মানুষকে যদি বলেন আপনার কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে, তাহলে অবশ্যই আপনাকে বোঝাতে হবে যে কোম্পানির বিনিয়োগ থেকে মুনাফা পাওয়া যাবে। আর সেই মুনাফা দিয়ে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবে। এই যে মুনাফার বিষয়টা। এটা কিন্তু আপনি নিশ্চিত নন যে আদৌ মুনাফা পাওয়া যাবে কিনা। তবু এই কল্পিত গল্পের প্রতি সব বিনিয়োগকারীকে আস্থা রাখতেই হবে। নয়তো লোকসানের ঝুঁকি নিয়ে কেউ বিনিয়োগই করবেনা।

আমাদের সভ্যতাকে এই পর্যায়ে আনতে কল্পিত ভাবনার ওপর বিশ্বাস স্থাপনের কোনো তুলনা নেই। আর কিছু কিছু কল্পনা আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনে এত গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে যে সেটাকে কল্পনা বলে বিশ্বাস করাই কঠিন। ধরা যাক, রাষ্ট্রের কথা। রাষ্ট্র বলে কোনো ফিজিক্যাল কিছু কি আদৌ রয়েছে? নাহ। স্রেফ কাঁটাতার দিয়ে পৃথিবীর সমগ্র ভূমিকে ভাগ করে করে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। উদ্ভব হয়েছে বললে ভুল। একটা নাম দিয়ে মনে মনে ধরে নেয়া হয়েছে যে, এইটা হলো অমুক রাষ্ট্র। ঠিক তেমন আরেকটা বড় কল্পনার নাম হচ্ছে টাকা। আপনার হাতে একটা নকশা করা কাগজ দেয়া হল। যার ওপরে ১০০০ লেখা। এটা নিয়ে আপনি বাজারে গেলেন। নকশাকার কাগজটার মূল্য যে আসলেই অনেক বেশি এটা অবশ্যই আপনি ও বিক্রেতাকে বিশ্বাস করতে হবে। নইলে আপনি ওই সাধারণ কাগজটার বিনিময়ে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, হরলিক্স কিনে বাড়ি ফিরতে পারবেন না। আস্তে আস্তে কাগজের টাকার ধারণাও তো ফুরিয়ে আসছে। বর্তমানের প্রযুক্তির যুগে অনলাইন ব্যাংকিং এ আপনার একাউন্টে কয়েকটা সংখ্যা দেখে আপনি মনে মনে কল্পনা করে নেন যে আপনার কাছে অর্থ আছে, আর তা দিয়ে আপনি কিছু কিনতে পারবেন। এই যে টাকার কল্পনা, এটা কিন্তু আমরা নিজেরাই বানিয়েছি একটা বিনিময় প্রথার প্রয়োজনীয়তা হিসেবে। কিন্তু চারপাশে ভালো করে দেখলে দেখা যাবে, সেই টাকাই আমাদের জীবনের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে। এমন কিছু নাই যা টাকা দিয়ে কিনতে পারা যায়না। সমস্তকিছু পণ্য হয়ে টাকার কাছে যেন নতজানু হয়ে থাকে।


মৃত্যু ছাড়া মানবজীবনের নিশ্চিত ও চূড়ান্ত কোনো লক্ষ্য নেই৷ তবুও আমরা বিভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে ছোটবেলা থেকে বুড়ো হই। কেউ হতে চাই ডাক্তার, কেউ বা ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বিজ্ঞানী। কিন্তু এরপর? আসলে কল্পনাগুলো আমাদের একরকম মানসিক স্বস্তি দেয়। জগতের নিষ্ঠুর সত্য থেকে সাময়িক দূরে রাখে। একটা শিশুকে জন্ম থেকেই আমি মৃত্যুর আশা দিয়ে বড় করতে পারিনা। তাহলে গোটা মানবসমাজেরই উন্নতি থেমে যাবে। এই ধরুন, রাষ্ট্র বা জাতীয়তাবাদের ধারণার ওপর যদি আমাদের বিশ্বাস না থাকত, ভালোবাসা না থাকত, তবে ১৯৭১ এ পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে আপামর বাঙালি কি একজোট হতে পারত? ন’মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নিজের জীবনকে বাজি রেখে লাখ লাখ বাঙালি কি স্বাধীনতা আনতে পারত? নাহ, কোনোটাই সম্ভব ছিলনা রাষ্ট্রের মত কাল্পনিক শৃঙ্খলে বিশ্বাস ছাড়া। 

তাই বৃহৎ সংখ্যক মানুষকে এক বৃক্ষের নিচে আনতে, বিশ্বাস ও শক্তি যোগাতে কাল্পনিক শৃঙ্খল একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

তাহলে আবারো আমরা প্রশ্নের মুখোমুখি হই, কল্পনা কি শুধুমাত্র সভ্যতাকে এগিয়েই রাখে? মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়িয়েই চলে? নাহ। এর বিপরীতও বহু ঘটনা ঘটেছে, ঘটছে। একটা জঙ্গিদল তার দলের জনবল বাড়াতে সেই জঙ্গি আদর্শ প্রচার করে। আর দলের ছত্রছায়ায় যারা যারা আসে, সবাইকে সেই কাল্পনিক আদর্শে সমান বিশ্বাসী থাকতে হয়। নচেৎ কোনো জঙ্গি নিজের জীবন বাজি রেখে সমাজে সহিংসতা চালাতে পারবেনা। শুধু এটাই নয়, কাল্পনিক শৃঙ্খলকে ভুল পথে চালিত করে পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত প্রচুর প্রাণক্ষয় হয়েছে। এখনো হচ্ছে অহরহ।


পৃথিবী কবে ধ্বংস হবে বা মানবজাতির পতনকাল আর কতদূর, তা আমরা জানিনা। কোনো দৈবদুর্বিপাকে বা মহাজাগতিক কারণে যদি সব হুট করেই বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাহলে আমাদের সত্যিই কিছু করার নেই। যেভাবে ধুমকেতু পড়ার ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ডাইনোসর ।  যেভাবে বরফ যুগে টিকে উঠতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে লোমশ ম্যামথ । তেমনভাবে মানুষের এই বর্ণিল সভ্যতার অন্তিম মুহূর্ত কবে আসবে, সে সম্পর্কে একদম সঠিকভাবে আমরা বলতে পারবনা। তবে আমরা নিজেরা নিজেরাই যেন কাল্পনিক শৃঙ্খলের  ফাঁদ পেতে যুদ্ধ-বিগ্রহ দিয়ে নিজেদের এ মহাকাব্যের ইতি না টানি, তা নিয়ে আমাদের যথেষ্ট সচেতন থাকতে হবে বৈকি।

                          “কিছুই কোথাও যদি নেই
                          তবু তো ক’জন আছি বাকি।
                          আয় আরো হাতে হাত রেখে
                         আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।”

            -শঙ্খ ঘোষ

তথ্যসূত্রঃ

১। Sapiens : A Brief History Of Humankind – Yuval Noah Harari

২। পৃথিবীর ইতিহাস – দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়৩। মানবসমাজ – রাহুল সাংকৃত্যায়ন

লেখক,শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়যোগাযোগঃ prokash.stu2018@juniv.edu

Writing is not a view of the School of Thought, it is entirely the opinion of the Author.

If you want to share your thought, you can mail us at- editor.sot@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *