স্টিফেন হকিং আইনস্টাইন ও কোয়ান্টাম সূত্রের সমন্বয় ব্ল্যাকহোলের শক্তিক্ষয় প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন। এটি পরবর্তীতে Hawking Radiation নামে পরিচিতি পায়।

নিকট ইতিহাসের অন্যতম সেরা কসমোলজিস্ট, লেখক ও তত্ত্বীয় পদার্থবিদ ছিলেন উইলিয়াম স্টিফেন হকিং। বিগ ব্যাং, ব্ল্যাকহোল থেকে শুরু করে তাঁর দেয়া মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও গঠন কাঠামো সংক্রান্ত তত্ত্বসমূহ আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানে আমূল বিপ্লব এনেছে। স্টিফেন হকিং তাঁর জীবদ্দশায় বহুবার “World’s Smartest Person” বলা হলেও তিনি কখনও তাঁর IQ স্কোর প্রকাশ করেননি তাঁর মতে মূর্খরাই নিজেদের IQ স্কোরের বড়াই করে (Tillman & Dobrijevic, 2021)।
১৯৪২ সালের ৮ই জানুয়ারি ফ্র্যাংক হকিং এবং ইসাবেল হকিংয়ের কোলজুড়ে পৃথিবীতে আসে আধুনিক যুগের আইনস্টাইন খ্যাত স্টিফেন হকিং। বাবা মেডিসিনের ছাত্র হওয়ার সুবাদে ছেলেকেও ডাক্তারি পড়তে চেয়েছিলেন। তবে বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্টিফেন ১৭ বছর বয়সে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে অধ্যয়নের জন্য ভর্তি হন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি উপলব্ধি করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ ছিলো পুরোই বোরিং। পরবর্তীতে অক্সফোর্ড থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে হকিং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এ Cosmology নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশুনা করতে যান।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ১৯৬৩ সালে হকিং এর মোটর নিউরন রোগ ধরা পড়ে। এমতাবস্থায় চিকিৎসকেরা তাকে আর মাত্র দু চার বছর বেঁচে থাকার আশ্বাস দেন।
কিন্তু রোগটি হকিংয়ের দেহে যত দ্রুত ছড়ানোর ধারণা করা হয়েছিল ততো দ্রুত ছড়ায় না। এরপর ১৯৬৬ সালে তিনি ফলিত গণিত ও তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে General Relativity and Cosmology এর উপর পিএইচডি সম্পন্ন করেন। এসময় তিনি “Properties of Expanding Universes” নামক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যা ২০১৭ সালে ইন্টারনেট উন্মুক্ত করা হয় (Hawking, 1966)।
এরপর সময়ের সাথে রোগটা তাঁর শরীরে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়লে হকিং চলাফেরায় অক্ষম হয়ে পড়েন এবং ১৯৮৫ সালে সম্পূর্ণরূপে বাকশক্তি হারান। তবে প্রযুক্তির আশীর্বাদে ক্যামব্রিজ থেকে তাঁর জন্য এক বিশেষ স্পিচ জেনারেটিং ডিভাইস তৈরি করা হয়, যার সাহায্যে হকিং তাঁর চোয়ালের মাংস বেশি নড়াচড়া করে ইলেকট্রনিক ভয়েস জেনারেট করতে পারতেন।
১৯৭৪ সালে স্টিফেন বিখ্যাত রয়েল সোসাইটির সদস্য হন। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে এই নড়বড়ে শরীর নিয়েই তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন এবং ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই পদে কর্মরত থাকেন।
খ্যাতিনামা:
স্টিফেন হকিং আইনস্টাইন ও কোয়ান্টাম সূত্রের সমন্বয় ব্ল্যাকহোলের শক্তিক্ষয় প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন। এটি পরবর্তীতে Hawking Radiation নামে পরিচিতি পায়।
তবে হকিং এর সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা আসে ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত তাঁর লেখা প্রথম বই “অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম” এর মাধ্যমে। এ বইয়ে তিনি মহাবিশ্বের উদ্ভব, বিবর্তন অভ্যন্তর, বিবর্ধন—এ সকল কিছু ব্যাখ্যা করেন। ওই সময় বইটির প্রায় এক কোটি কপি বিক্রি হয় (Clark, 2019)।
২০১৪ সালে তাঁর জীবনের উপর “দ্য থিওরি অব এভ্রিথিং” নামক চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়, যা স্বয়ং হকিংয়ের থেকে প্রশংসা লাভ করে।
স্টিফেন হকিং তাঁর এক বক্তব্যে বলেন, “আমি শারীরিকভাবে অনেক ক্ষেত্রেই কর্মক্ষম নই। কিন্তু আমার কর্ম জীবনে আমি সফল।” ২০০৯ সালে পর্যন্ত ক্যামব্রিজের লুসিয়ান অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত থাকার পর হকিং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়-ই আমৃত্যু পর্যন্ত Center of Theoretical Cosmology এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
কর্মজীবন ঘেঁটে স্টিফেন হকিং কে খুব সিরিয়াস কোনো ব্যক্তি প্রতিকৃতি মনে হলেও তিনি ছিলেন রসিক আর খেয়ালি এক বিজ্ঞানী। বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে হকিং সম্পর্কে কিছু অবাক করা তথ্য জেনে নিন—
ছোটবেলার আইনস্টাইন:
যখন স্টিফেনের বয়স ১৪ বছর, তখন সে আর তাঁর বন্ধুরা মিলে পুরনো ঘড়ির যন্ত্রাংশ ও টেলিফোনের সুইচবোর্ড দিয়ে একটা কম্পিউটার বানিয়ে ফেলেন। এজন্য বন্ধুমহলে তাকে আইনস্টাইন ডাকা হতো।
হেরে যাওয়া বাজিগর:
স্টিফেন হকিং তাঁর বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সমূহের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। কিন্তু তিনি প্রায়ই কিছু ফাঁকা বুলি আওড়াতেন। আর এগুলো নিয়ে বাজি ধরা ছিলো তাঁর এক অন্যতম অভ্যাস। ১৯৭৫ সালে স্টিফেন Cygnus X-1 নিয়ে ক্রিপ থ্রোনের সাথে বাজি লাগান যে এটা কোনো ব্ল্যাকহোল না। আবার ২০১২ সালে তিনি গর্ডন কেনের সাথে ১০০ ডলারের বাজি ধরেন যে, পদার্থবিদরা কখনো হিগস বোসন আবিষ্কার করতে পারবেন না। জীবদ্দশায় স্টিফেন এমন আরও অনেক বাজি ধরেছেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই সে ভুল প্রমাণিত হয়ে হেরে বসেছেন (Rodgers, 2017)।
বিজ্ঞানী হয়েও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আশঙ্কা:
২০১৪ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্য সেন্টার ফর দ্য ফিউচার অব ইন্টেলিজেন্স এর এক সম্মেলনে স্টিফেন নিজের এক বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ ঠিকই, কিন্তু এটি একসময় আমাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। যা হতে পারে শক্তিশালী স্বায়ত্তশাসিত অস্ত্র কিংবা সংখ্যালঘু লোকের নিপীড়নের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠের নতুন এক হাতিয়ার। আবার ভবিষ্যতে, এ আই নিজস্ব চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটাতে পারে – এতে তাদের আদর্শ আমাদের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে। তিনি আরও বলেন, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জাগরণ হয় আমাদের জন্য সেরা কিছু বয়ে আনবে অন্যথায় তা মানবসভ্যতার নরকে পতনের কারণ হবে।”
হুইলচেয়ারের উন্মাদ:
স্টিফেন অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথম দিকে লাঠির সাহায্যে হাঁটলেও পরে তাকে হুইলচেয়ারের দারে যেতে হয়। এমন অবস্থায় হয়ত যে কেউই খুব সাবধানতার সাথে হুইল চেয়ার চালাবে। কিন্তু তাঁর গল্পটা ছিলো অন্যরকম। স্টিফেন প্রায় সবসময়ই খুব বেপরোয়া ভাবে হুইলচেয়ার ড্রাইভ করতেন। এজন্য সে তাঁর হাড়গোড়ও ভেঙেছেন।
সময় অভিযাত্রীদের নিমন্ত্রণ:
২০০৯ সালের কোনো এক সময়ে এক আজগবী ধরনের পার্টির আয়োজন করেন হকিং। সেখানে ব্যানারে লেখা ছিল “Welcome Time Travellers”. আর মজার ব্যাপার হলো সেখানে তিনি একাই ছিলেন কেননা পার্টির পরের দিন লোকজনদের দাওয়াত দেয়া হয়। তিনি ধারণা করেছিলেন ভবিষ্যৎ থেকে কেউ সময়যাত্রা করে পিছনে আসবেন, কিন্তু পুরোটাই ছিলো বৃথা চেষ্টা।
যদিও চলমান সময়ে স্টিফেন হকিং-কে নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। তাছাড়া তাঁর গুটিকয়েক মতবাদ কতিপয় নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসে আঘাত হানে। কিন্তু তাঁর অবদান বর্তমানে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় অনস্বীকার্য।
Writing is not a view of the School of Thought, it is entirely the opinion of the Author.
If you want to share your thought, you can mail us at- edior.sot@gmail.comরেফারেন্সঃ
Hawking, S. (1966). Properties of expanding universes (Doctoral thesis). https://doi.org/10.17863/CAM.11283
Clark, S. (2019, December 2). A brief history of Stephen Hawking: A legacy of paradox. New Scientist. https://www.newscientist.com/article/2053929-a-brief-history-of-stephen-hawking-a-legacy-of-paradox/#:%7E:text=Stephen%20Hawking%20dies%20aged%2076&text=His%20genre%2Ddefining%20book%2C%20A,and%20The%20Big%20Bang%20Theory.
Rodgers, P. (2017, August 25). Hawking loses black hole bet. Physics World. https://physicsworld.com/a/hawking-loses-black-hole-bet/
Tillman, N. T., & Dobrijevic, D. (2021, December 1). Stephen Hawking biography: Life, theories, books & quotes. Space.Com. https://www.space.com/15923-stephen-hawking.html