প্লেটোর “রিপাবলিক” (Republic) গ্রন্থটি প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক চিন্তাধারার একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এই গ্রন্থটি রাষ্ট্রের কাঠামো, ন্যায়, দার্শনিক শাসন, ও শিক্ষা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছে। প্লেটো শিক্ষা চিন্তা এবং রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের ওপর ব্যাপকভাবে আলোকপাত করেছেন। তাঁর শিক্ষা দর্শন শুধু তার সময়ের গ্রীক সমাজের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী নয়, বরং আধুনিক শিক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য প্লেটোর শিক্ষা চিন্তা ও তার প্রভাব আজও বহুল আলোচিত।
১. শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য: আত্ম-উন্নয়ন ও ন্যায়বিচার
প্লেটো তার “রিপাবলিক” গ্রন্থে শিক্ষা বিষয়ে যা কিছু বলেছেন, তার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের আত্ম-উন্নয়ন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। তিনি মনে করেন, শিক্ষা মানুষের মনের অন্ধকার দূর করে সত্য, ন্যায় ও সুন্দর সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করে। এই চিন্তা থেকেই তাঁর “গুহার উপ比ব্যাখ্যা” (Allegory of the Cave) উদ্ভূত, যেখানে তিনি মানুষের অজ্ঞতা ও সত্যের প্রতি পথপ্রদর্শন করার গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন। গুহার বন্দী মানুষের মতো যারা অন্ধকারে বন্দী, তাদেরকে বাস্তবতার সত্য উপলব্ধি করতে হবে, আর এ কাজটি করতে পারে শুধুমাত্র শিক্ষিত ব্যক্তি—দার্শনিকরা।
এছাড়া, প্লেটো মনে করেন, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাষ্ট্রের শাসকদেরকে গভীর জ্ঞানী হতে হবে, আর এজন্য তাদেরকে একটি বিশেষ শিক্ষা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তাঁর মতে, একমাত্র শিক্ষা দ্বারা ব্যক্তির মনের অন্ধকার দূর হয়ে, সে ন্যায়ের পথে পরিচালিত হতে পারে।
২. শিক্ষার স্তর এবং প্রক্রিয়া
প্লেটো তার শিক্ষা চিন্তায় একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ও স্তরের মধ্যে শিক্ষাকে ভাগ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, প্রতিটি ব্যক্তির জন্য শিক্ষা একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে থাকা উচিত, যাতে তারা তাদের প্রকৃত ক্ষমতা ও ভূমিকা অনুধাবন করতে পারে। “রিপাবলিক”-এ তিনি শিক্ষার ধাপে ধাপে বর্ণনা দিয়েছেন, যা মূলত চারটি স্তরে বিভক্ত:
২.১. প্রাথমিক শিক্ষা: শরীর ও মনকে সুস্থ রাখা
প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা ব্যাপকভাবে শারীরিক প্রশিক্ষণ এবং নৈতিক শিক্ষার সংমিশ্রণ। প্লেটো বিশ্বাস করেন যে, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে সুস্থ থাকতে হবে, যাতে তারা পরবর্তীতে জ্ঞানার্জনের জন্য প্রস্তুত হতে পারে। শিশুরা সমাজের মূল অংশ হিসেবে বেড়ে ওঠার আগে তাদের শারীরিক সক্ষমতা ও চরিত্রের উন্নতি ঘটানো উচিত।
২.২. গান, কাব্য ও নৈতিক শিক্ষা
প্লেটো শিক্ষার পরবর্তী স্তর হিসেবে গান, কাব্য এবং নৈতিক শিক্ষা প্রদান করার কথা বলেন। এই স্তরের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে সৎ ও অসৎ, সুন্দর ও কুৎসিতের পার্থক্য তুলে ধরা হয়। শিশুদের এমন গল্প শোনানো উচিত যা তাদের নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। খারাপ চরিত্রের ছবি কিংবা মিথ্যা গল্প যেন তাদের মনোভাবকে বিকৃত না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
২.৩. গণিত এবং বিজ্ঞান
প্লেটো আরও বলেন, গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে মনের প্রাঞ্জলতা এবং বুদ্ধির বিকাশ ঘটে। গণিতের মাধ্যমে মানুষের যুক্তি শক্তি এবং চিন্তা করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এই স্তরের শিক্ষা তার ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমে ব্যক্তির মনের গঠন এবং যুক্তির ভিত্তি গড়ে উঠে। গণিতের মধ্য দিয়ে মানুষের বিমূর্ত চিন্তার ক্ষমতা বাড়ে, যা পরবর্তীতে দার্শনিক চিন্তার বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
২.৪. দার্শনিক শিক্ষা (ফিলোসফি)
প্লেটো মনে করেন, সমাজের শাসকদের জন্য দার্শনিক শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শাসকদেরকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তাকে দীর্ঘ সময় ধরে ফিলোসফি, মেটাফিজিক্স এবং জ্ঞানের গভীর স্তরে প্রবেশ করতে হবে। দার্শনিক শিক্ষা তাদের ন্যায়, সৌন্দর্য ও সত্যের প্রতি অবিরাম অনুসন্ধান করতে সহায়তা করবে। এই শিক্ষা স্তরের মাধ্যমে একজন শাসক সমাজের সঠিক পরিচালনায় সক্ষম হবে, কারণ সে সবকিছুতে গভীরভাবে চিন্তা করতে পারবে এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করতে সক্ষম হবে।
৩. শিক্ষার মাধ্যমে দার্শনিক শাসক তৈরি
প্লেটোর মতে, রাষ্ট্রের জন্য আদর্শ শাসক হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি দার্শনিক হিসেবে সমাজের সত্য ও ন্যায়ের পথনির্দেশক হতে পারেন। এমন শাসক তৈরি করার জন্য, তাকে দীর্ঘদিন ধরে কঠোর শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে গড়ে তোলা হয়। দার্শনিক শাসকরা সাধারণ জনগণের মঙ্গলার্থে কাজ করবেন এবং তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রতি লোভী হবেন না। এজন্য, শাসকদের জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা প্লেটো প্রস্তাব করেন, তা একটি চূড়ান্ত স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে শাসকরা গুনী, বিচক্ষণ এবং ন্যায়পরায়ণ হতে সক্ষম হবে।
৪. শিক্ষার উদ্দেশ্য: মনের শুদ্ধি ও আত্মউন্নয়ন
প্লেটোর শিক্ষা চিন্তায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, শিক্ষা শুধুমাত্র বাহ্যিক জ্ঞান লাভের জন্য নয়, বরং এটি মনের শুদ্ধি এবং আত্মউন্নয়নের একটি মাধ্যম। তিনি বিশ্বাস করেন, মানুষের মনের প্রকৃত উৎকর্ষ সাধিত হয়, যখন সে সত্যের প্রতি অবিচল থাকে এবং তার আত্মার প্রকৃত স্বরূপ জানতে পারে। তার মতে, শিক্ষা হলো একটি নৈতিক প্রক্রিয়া, যা মানুষের আত্মাকে উত্তীর্ণ করে সঠিক পথে পরিচালিত করে।
শিক্ষার মূল লক্ষ্য হল একজন ব্যক্তির আত্মা যেন দুষ্টতা, অন্ধকার, এবং অবিচারের অন্ধকার থেকে মুক্তি পায় এবং সে সত্যের, ন্যায়ের ও সুন্দরতার আলো দেখতে পায়। এখানেই তিনি তার গুহার উপ比ব্যাখ্যাটি ব্যাখ্যা করেছেন, যেখানে একজন ব্যক্তি গুহার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে সত্যের দিশা খুঁজে পায়।
৫. শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের উদ্দেশ্য
প্লেটো শিক্ষার বিভিন্ন স্তর বা ধাপের মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যই স্পষ্ট করতে চান যে, মানুষকে তার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে। প্রথম স্তরের শিক্ষা (শারীরিক প্রশিক্ষণ ও নৈতিক শিক্ষা) মানুষের শুদ্ধ চরিত্র গঠনে সহায়ক। দ্বিতীয় স্তরের শিক্ষা (গান, কাব্য, নৈতিক শিক্ষা) মানুষের আত্মিক উৎকর্ষ সাধন করে। তৃতীয় স্তরের শিক্ষা (গণিত ও বিজ্ঞান) মানুষের বুদ্ধির বিকাশ ঘটায়, এবং চূড়ান্ত স্তরের দার্শনিক শিক্ষা মানুষকে ন্যায়, সত্য ও সৌন্দর্যের সন্ধানে পরিচালিত করে।
৬. শিক্ষার সমান সুযোগ এবং শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি
প্লেটো বিশ্বাস করতেন যে, সমাজের সকল মানুষের জন্য শিক্ষা সমানভাবে প্রাপ্য হওয়া উচিত। তিনি নারী-পুরুষের মধ্যে শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য মেনে নেননি। তার মতে, নারীরা পুরুষদের মতোই শাসক বা রক্ষক হিসেবে শিক্ষালাভের অধিকারী। এই ধারণা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি যুগান্তকারী চিন্তা, যেখানে সর্বোচ্চ পদে নারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা পরিস্কার হয়ে ওঠে।
প্লেটোর শিক্ষাচিন্তা: তাঁর দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু
প্লেটো (Plato), প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক, তাঁর দার্শনিক চিন্তাধারা এবং শিক্ষাচিন্তার জন্য চিরকাল স্মরণীয়। তাঁর দর্শন সমাজের ন্যায়, সত্য, সুন্দর ও গুণাবলীর অনুসন্ধান নিয়ে ছিল, এবং এই চিন্তাধারা বিভিন্ন দার্শনিক শাখায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে। বিশেষ করে, তাঁর “রিপাবলিক” গ্রন্থে তাঁর শিক্ষাচিন্তা ও সমাজের কাঠামো এবং রাষ্ট্রের সংহতি প্রতিষ্ঠার মধ্যে যে সম্পর্ক তা গভীরভাবে আলোচিত হয়েছে। এই প্রবন্ধে, আমরা দেখব যে, কীভাবে প্লেটোর শিক্ষাচিন্তা তাঁর দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করেছে এবং কীভাবে এটি তার দর্শনের মূল স্তম্ভগুলির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কিত।
১. প্লেটোর দর্শনের মৌলিক দিক
প্লেটোর দর্শনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল তাঁর মেটাফিজিক্যাল ধারণা, যেখানে তিনি “আদর্শ জগত” বা “ফর্মস” (Forms) এর ধারণা প্রবর্তন করেন। তাঁর মতে, আমাদের আশপাশের সমস্ত বস্তু ও ঘটনা বাস্তবে “ফর্মস” এর প্রতিফলন। এই ফর্মসগুলোই চিরন্তন, অমর এবং শুদ্ধ, যা প্রকৃত জ্ঞানের উৎস। প্লেটো বিশ্বাস করতেন যে, মানব মনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো এই আদর্শ জগতের সান্নিধ্যে পৌঁছানো এবং সেই সত্যকে উপলব্ধি করা।
এছাড়া, প্লেটো তাঁর “গুহার উপ比ব্যাখ্যা” (Allegory of the Cave)-তে এই দর্শনকে আরও বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, যেখানে তিনি দেখান যে, মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে শুধু ছায়া বা মিথ্যা দেখতে পায়, এবং শিক্ষা ও চিন্তার মাধ্যমে তাকে বাস্তবতার সত্যের দিকে নিয়ে যেতে হবে। প্লেটোর এই চিন্তাভাবনা থেকেই তাঁর শিক্ষাচিন্তার ভিত্তি তৈরি হয়েছে।
২. শিক্ষার উদ্দেশ্য: আত্মার উৎকর্ষ সাধন
প্লেটো শিক্ষা সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করতেন, তা ছিল মূলত আত্মার উৎকর্ষ সাধনের জন্য। তাঁর মতে, শিক্ষা শুধুমাত্র তথ্য সংগ্রহ বা বাহ্যিক জ্ঞানের অনুগ্রহ নয়, বরং এটি আত্মার শুদ্ধি ও অন্তর্দৃষ্টি লাভের একটি মাধ্যম। তাঁর “রিপাবলিক” গ্রন্থে, শিক্ষা ও ন্যায়ের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে, তিনি দেখান যে, শুধুমাত্র শাসকদের শিক্ষা যদি যথাযথ হয়, তবে একটি রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে।
শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ নিজের মনের গভীরে প্রবেশ করে, যা তাকে সত্যের দিকে পরিচালিত করে। তাঁর “গুহার উপ比ব্যাখ্যা” (Allegory of the Cave)-তে এই ধারণা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। গুহার বন্দীদের মতো, আমরা সবাই দুনিয়ায় অন্ধকারে বসবাস করি, যেখানে আমরা প্রকৃত সত্য বা জ্ঞান থেকে দূরে থাকি। কিন্তু শিক্ষার মাধ্যমে এই অন্ধকার থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব, এবং তখনই আমরা “আদর্শ জগত” বা “ফর্মস” কে দেখতে সক্ষম হই।
এটি স্পষ্ট করে যে, প্লেটোর শিক্ষাচিন্তার লক্ষ্য ছিল আত্মার শুদ্ধি এবং তার মাধ্যমে মানুষের জীবনকে ন্যায়সঙ্গত ও সুন্দর করে তোলা।
৩. শিক্ষা ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক
প্লেটো তাঁর “রিপাবলিক”-এ রাষ্ট্রের কাঠামো ও তার শাসকদের জন্য শিক্ষার গুরুত্ব খুবই বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, একটি সুষ্ঠু ও ন্যায়নিষ্ঠ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে, সেই রাষ্ট্রের শাসকদের (দার্শনিক শাসক) উচ্চতর শিক্ষা লাভ করা প্রয়োজন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, দার্শনিকরা সমাজের জন্য আদর্শ শাসক হবে, কারণ তারা “ফর্মস” বা আদর্শ জগতের বাস্তবতার দিকে লক্ষ্য রেখে দেশ পরিচালনা করতে সক্ষম হবে।
তাঁর মতে, শাসকদের জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে, তা খুবই কঠিন ও দীর্ঘমেয়াদি, যাতে তারা একে একে গুনিতত্ত্ব, গণিত, সংগীত, দর্শন, এবং মেটাফিজিক্সের মাধ্যমে আত্মিক ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিপূর্ণ হয়। তাদেরকে শুধু কৌশলগত বা শাসনশাস্ত্র শেখানো হয় না, বরং শাসক হতে হলে তাদেরকে ন্যায়, সত্য, এবং সৌন্দর্যের মর্মার্থ বুঝতে হবে।
এই ধারণাটি প্লেটোর দর্শনের একটি মূল স্তম্ভ, যেখানে তিনি বুঝিয়েছেন যে, যদি রাষ্ট্রের শাসকরা প্রকৃত জ্ঞানী না হয়, তবে সে রাষ্ট্র কখনোই সুষ্ঠু, ন্যায়নিষ্ঠ এবং সুখী হতে পারে না। রাষ্ট্রের সফলতার জন্য শিক্ষা একটি অপরিহার্য উপাদান।
৪. শিক্ষার স্তর: ধাপে ধাপে আত্ম-উন্নয়ন
প্লেটো শিক্ষাকে একটি ধাপে ধাপে বিকাশমান প্রক্রিয়া হিসেবে দেখতেন। তাঁর মতে, সমাজের প্রত্যেক সদস্যকে তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি ও ক্ষমতা অনুযায়ী শিক্ষা দেওয়া উচিত। “রিপাবলিক”-এ তিনি সমাজের তিনটি শ্রেণী বর্ণনা করেছেন—শাসক শ্রেণী, রক্ষক শ্রেণী, এবং উৎপাদক শ্রেণী। এই শ্রেণী অনুযায়ী, প্রত্যেক শ্রেণীর জন্য আলাদা আলাদা শিক্ষার প্রয়োজন।
৪.১. শাসক শ্রেণী (Philosopher-Kings)
শাসকদের জন্য উচ্চতর শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল, যাতে তারা ন্যায় এবং সত্যের অনুসন্ধানে সক্ষম হন। প্লেটো মনে করতেন, তাদেরকে দীর্ঘকাল কঠোর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গড়ে তোলা উচিত। গণিত, সংগীত, দর্শন, এবং শুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করে তারা বুঝতে পারবে কীভাবে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা যায়। তাঁদের চিন্তা-ভাবনা হবে জ্ঞানের আলোতে ভরা এবং এভাবেই তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে।
৪.২. রক্ষক শ্রেণী (Guardians)
রক্ষকদের শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন ছিল। তারা সৈনিক, পুলিশ বা নিরাপত্তাকর্মী হতে পারে, এবং তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। তবে, তাদেরও ন্যায় এবং সততার শিক্ষা দরকার, যাতে তারা রাষ্ট্রের জন্য সঠিকভাবে কাজ করতে পারে।
৪.৩. উৎপাদক শ্রেণী (Producers)
উৎপাদকরা, যেমন কৃষক, কারিগর বা ব্যবসায়ী, তাদের কাজের জন্য দক্ষতা এবং প্রযুক্তি শেখার প্রয়োজন ছিল। তবে তাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল বাহ্যিক কাজের দক্ষতা অর্জন, যাতে রাষ্ট্রের মূল কাজগুলি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে।
৫. শিক্ষার মাধ্যমে ন্যায় ও গুণাবলীর প্রতিষ্ঠা
প্লেটোর শিক্ষাচিন্তা, তার দর্শনের মতো, একটি গুণাবলীপূর্ণ জীবন প্রতিষ্ঠার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিল। তাঁর মতে, সত্য, সৌন্দর্য ও ন্যায়ের প্রতি মানুষের আসক্তি গড়ে তুলতে শিক্ষাই মূল হাতিয়ার। শিক্ষা কেবলমাত্র বাহ্যিক বা বাহ্যিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য নয়, বরং এটি মানুষের নৈতিক ও আত্মিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য।
এজন্য, প্লেটো শিক্ষা দেয়ার প্রক্রিয়াকে এমনভাবে সাজিয়েছেন যাতে প্রতিটি ব্যক্তি তার নিজস্ব ক্ষমতা অনুযায়ী গড়ে উঠতে পারে এবং সমাজের প্রতি তার দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়। উদাহরণস্বরূপ, যাদের বুদ্ধিমত্তা বেশি, তারা শাসক শ্রেণীতে যাবে, আর যারা শারীরিক দক্ষতায় প্রখর, তারা রক্ষক শ্রেণীতে, এবং যারা সাধারণ কাজের জন্য উপযুক্ত, তারা উৎপাদক শ্রেণীতে কাজ করবে।
৬. শিক্ষার চূড়ান্ত লক্ষ্য: সত্যের প্রতি আগ্রহ
প্লেটোর দর্শনের কেন্দ্রে রয়েছে “সত্যের প্রতি আগ্রহ” এবং তাঁর শিক্ষার চূড়ান্ত লক্ষ্য হল, মানুষ যাতে সত্যের সন্ধান করতে পারে এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। শাসকদের শিক্ষা মূলত তাদের সত্যের অনুসন্ধান ও জানার প্রতি আগ্রহ জাগানোর জন্য ছিল, যাতে তারা কেবলমাত্র নিজের অথবা শ্রেণীর স্বার্থে কাজ না করে, বরং পুরো রাষ্ট্রের মঙ্গলার্থে কাজ করতে পারে।
এভাবে, প্লেটোর শিক্ষাচিন্তা তাঁর দর্শনের একটি প্রধান অঙ্গ। তাঁর মতে, শিক্ষা মানুষের আত্মার উন্নতি ও শুদ্ধির জন্য অপরিহার্য, এবং একমাত্র শুদ্ধ আত্মাই ন্যায় ও সত্যের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকতে পারে।
উপসংহার
প্লেটোর শিক্ষাচিন্তা তার দর্শনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তিনি শিক্ষা ও আত্মার শুদ্ধি, ন্যায় এবং সত্যের অনুসন্ধানকে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন। তার মতে, শিক্ষা শুধুমাত্র বাহ্যিক দক্ষতা অর্জনের প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি মানুষের নৈতিক ও আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের একটি মাধ্যম। প্লেটো বিশ্বাস করতেন, যখন মানুষের মনের অন্ধকার প্লেটোর “রিপাবলিক” গ্রন্থে শিক্ষা চিন্তা তার সমাজের আদর্শ কাঠামো নির্মাণের জন্য অপরিহার্য। তাঁর মতে, শিক্ষা শুধুমাত্র ব্যক্তির মঙ্গল নয়, বরং রাষ্ট্রের সফলতা এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠায়ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো আত্মা ও মনের শুদ্ধি, সত্যের প্রতি আগ্রহ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা। তাঁর শিক্ষাদর্শন আজও বর্তমান বিশ্বের শিক্ষা চিন্তার ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলেছে, কারণ এটি মনের বিকাশ এবং নৈতিক উৎকর্ষ সাধনে মূখ্য ভূমিকা পালন করে।