চৈনিক নীতিবিদ্যার ইতিহাসে মেনসিয়াস (孟子, Mencius) বা মেংজি, কনফুসিয়াসের পরবর্তী অন্যতম বিশিষ্ট দার্শনিক হিসেবে পরিচিত। তাঁর দর্শন কনফুসিয়াসের আদর্শ ও শিক্ষা থেকে প্রভাবিত হলেও তিনি কিছু বিষয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেন, বিশেষত মানুষ ও সমাজের প্রকৃতি নিয়ে। মেনসিয়াস তাঁর দর্শনে মানুষের “স্বভাবতই ভালো” হওয়া নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন, যা চীনা দর্শনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাঁর মতে, মানুষের মৌলিক প্রকৃতি বা স্বভাব হলো ভালো, এবং এটি সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে বিকশিত হয়।
মেনসিয়াসের এই দৃষ্টিভঙ্গি, যাকে আমরা “ইনহেরেন্টলি গুড” (inherently good) বলে চিহ্নিত করি, তার মূল বক্তব্য হলো যে, প্রতিটি মানুষ জন্মগতভাবে ভালো হতে পারে এবং সঠিক পরিবেশ, শিক্ষা, এবং নৈতিক অনুশীলনের মাধ্যমে তার গুণাবলী বিকশিত হয়। যদিও মেনসিয়াসের এই মতবাদকে বোঝার জন্য চীনা দর্শনের প্রেক্ষাপটে এটি আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন, তবে তার মূল বক্তব্য হলো যে, মানুষের মৌলিক প্রকৃতি ভালো এবং তা কখনোই দুর্নীতিগ্রস্ত নয়।
১. মেনসিয়াসের দর্শনের ভিত্তি: মানুষ স্বভাবতই ভালো
মেনসিয়াসের মতে, মানুষ জন্মগতভাবে ভালো, এবং এই ভালোবাসার মূল কারণ হল তার হৃদয়ে থাকা “রেন” (仁) বা মানবতাবোধ। “রেন” মানুষের মৌলিক গুণাবলী হিসেবে চিহ্নিত হয়, যা কনফুসিয়াসের শিক্ষা থেকেও এসেছে, তবে মেনসিয়াস এর উপর আরও জোর দিয়েছেন। মেনসিয়াসের দর্শনে এই “রেন” একটি মূল গুণ যা মানুষের সকল নৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল। মানবতা, সহানুভূতি, দয়া এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ—এগুলি মানুষের স্বভাবের অন্তর্গত।
এছাড়া, মেনসিয়াসের মতে, মানুষের ভালো হওয়ার প্রবৃত্তি বা প্রকৃতি যেমন পাথরের মধ্যে আগুনের কণা থাকে, ঠিক তেমনি মানুষের ভালো হওয়ার শক্তি থাকে তার অন্তরে। কিন্তু এই ভালো প্রকৃতির বিকাশের জন্য সঠিক পরিবেশ, শিক্ষা এবং সহানুভূতির প্রয়োজন।
২. মেনসিয়াসের মতে মানুষের মৌলিক গুণাবলী
মেনসিয়াসের দর্শনে মানুষের স্বভাবের মধ্যে মূল গুণাবলী হিসেবে কিছু বিশেষ জিনিস উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি মানুষের অভ্যন্তরীণ গুণাবলীকে “সান” (三) বা তিনটি প্রধান গুণ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করেছেন:
রেন (仁): মানবতা বা দয়া।
ই (义): ন্যায়বোধ বা সঠিক কাজ করা।
লি (礼): শিষ্টাচার বা সামাজিক শৃঙ্খলা।
এই তিনটি গুণ মানুষের মৌলিক গুণাবলী, যা জন্মগতভাবে তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে। কিন্তু এই গুণাবলী ঠিকভাবে বিকশিত হতে পারে কেবল সঠিক শিক্ষা, সমাজ এবং পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে। মেনসিয়াস মনে করতেন, মানুষের স্বাভাবিক গুণাবলী যদি সঠিকভাবে বিকশিত হয়, তাহলে সে সমাজের কল্যাণে কাজ করতে সক্ষম হবে।
৩. প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রভাব
যদিও মেনসিয়াস বিশ্বাস করতেন যে মানুষের মৌলিক প্রকৃতি ভালো, তিনি এর পাশাপাশি বলেছিলেন যে, পরিবেশ এবং শিক্ষা মানুষের চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাঁর মতে, মানুষের ভালো প্রকৃতি বিকাশের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও সঠিক শিক্ষা অত্যন্ত জরুরি। মেনসিয়াস যেমন বলেন:
> “যেমন জল পরিষ্কার না হলে মাছ চলতে পারে না, তেমনি মানুষ যদি খারাপ পরিবেশে থাকে তবে তার নৈতিক গুণাবলী বিকশিত হতে পারে না।”
এটি বোঝায় যে, পরিবেশের ওপর মানুষের প্রকৃতি এবং গুণাবলীর বিকাশের প্রভাব রয়েছে। যদি মানুষ খারাপ পরিবেশে বেড়ে ওঠে, তবে তার ভালো প্রকৃতি বিকাশের পথে বাধা আসবে। যেমন, একটি ছোট শিশু যদি পরিবারে অথবা সমাজে অশান্তি, অসততা বা সহানুভূতির অভাব দেখে বেড়ে ওঠে, তবে তার মধ্যে এই গুণগুলির বিকাশে সমস্যা হতে পারে।
৪. মেনসিয়াসের “মানুষ স্বভাবতই ভালো” সম্পর্কে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
মেনসিয়াসের দর্শন “মানুষ স্বভাবতই ভালো” এই ধারণাটি, চৈনিক দর্শনের ইতিহাসে, বিশেষভাবে কনফুসিয়াসের একজন শিষ্য, শু সু (Xunzi) এর বিপরীত মতাদর্শের সাথে তুলনা করা হয়। শু সু (Xunzi) বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের স্বভাব হলো খারাপ, এবং মানুষের প্রকৃতিকে সুশৃঙ্খল এবং নৈতিক করার জন্য কঠোর শিক্ষা এবং সামাজিক শৃঙ্খলার প্রয়োজন।
মেনসিয়াসের এই মতাদর্শ শু সু’র ধারণার বিপরীত ছিল, কারণ শু সু বিশ্বাস করতেন যে মানুষের প্রকৃতি জন্মগতভাবে খারাপ এবং তাকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্য কঠোর পরিশ্রম ও শিক্ষার প্রয়োজন। তবে মেনসিয়াসের মতে, মানুষের প্রকৃতি ভালো, এবং কেবলমাত্র সঠিক পরিবেশ এবং শিক্ষা তার গুণাবলীকে সঠিকভাবে বিকশিত করতে পারে।
৫. নৈতিক শিক্ষা এবং চরিত্র গঠন
মেনসিয়াসের মতে, মানুষের গুণাবলীর বিকাশ এবং নৈতিকতা গঠন সঠিক শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং অভ্যাসের মাধ্যমে সম্ভব। তিনি বিশ্বাস করতেন যে মানুষের স্বভাব ভালো হলেও, তাকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে হবে, যাতে তার গুণাবলী বিকাশ লাভ করে। মেনসিয়াসের মতে, একজন আদর্শ ব্যক্তির পথপ্রদর্শক হওয়া উচিত একজন শিক্ষক, যিনি তার ছাত্রদের নৈতিকতার পথে পরিচালিত করবেন।
এছাড়া, মেনসিয়াস বলেন, একজন মানুষ যদি তার অন্তরের ভালো গুণাবলী চর্চা করে এবং সে যদি তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে সচেষ্ট হয়, তাহলে সে তার প্রকৃত ভালো অবস্থায় ফিরে আসতে সক্ষম হবে। যেমন:
> “যেমন একটি গাছ যদি শক্তভাবে মাটি থেকে সরে যায়, তার পুষ্টি ও বিকাশ ঠিকভাবে হবে না, ঠিক তেমনি মানুষ তার অন্তরের ভালো গুণাবলী থেকে বিচ্যুত হলে তার চরিত্র বিকাশ ঘটতে পারে না।”
৬. সমাজে ভালো প্রকৃতির প্রভাব
মেনসিয়াসের মতে, যখন একটি সমাজে বেশিরভাগ মানুষ ভালো প্রকৃতির অধিকারী থাকে, তখন সেই সমাজটি শান্তিপূর্ণ ও ন্যায্য হয়। এমনকি রাষ্ট্র পরিচালনায়ও ভালো মানুষের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মেনসিয়াস বলেছিলেন যে, যদি শাসকরা সঠিকভাবে শাসন করেন এবং জনগণের কল্যাণে কাজ করেন, তবে তারা সেই সমাজের স্বাভাবিক ভালো প্রকৃতিকে উদযাপন করতে পারবেন।
মেনসিয়াসের মতে, রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি হল মানুষের মৌলিক ভালো প্রকৃতি। তিনি মনে করতেন যে, শাসকরা যদি ন্যায়ের পথে চলেন এবং জনগণের কল্যাণে মনোনিবেশ করেন, তবে পুরো রাষ্ট্রে ভালো আচরণ এবং নৈতিকতার প্রচলন হবে।
৭. মেনসিয়াসের দর্শনের আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা
মেনসিয়াসের “মানুষ স্বভাবতই ভালো” দর্শন আজও অনেকের কাছে প্রাসঙ্গিক। এটি সমাজের নৈতিকতা এবং মানুষের চরিত্র গঠনের বিষয়ে একটি শক্তিশালী বক্তব্য। তার দর্শন আমাদের শেখায় যে, মানুষের প্রকৃতি ভালো হলেও তাকে সঠিক পরিবেশ, শিক্ষা, এবং অনুশীলনের মাধ্যমে সেই ভালো গুণাবলী বিকশিত করতে হবে। বর্তমান পৃথিবীতেও যদি আমরা ভালো শিক্ষা, সহানুভূতি, এবং ন্যায্যতার প্রতি গুরুত্ব দিই, তবে আমাদের সমাজ আরও উন্নত এবং শান্তিপূর্ণ হতে পারে।
উপসংহার
মেনসিয়াসের “মানুষ স্বভাবতই ভালো” দর্শন চৈনিক দর্শনের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাঁর মতে, মানুষের মৌলিক প্রকৃতি ভালো, কিন্তু এই ভালো প্রকৃতির বিকাশের জন্য সঠিক পরিবেশ, শিক্ষা, এবং নৈতিক অনুশীলনের প্রয়োজন। মানুষের চরিত্র গঠন এবং সমাজের উন্নতির জন্য এই দর্শন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মেনসিয়াসের দর্শন আজও আমাদের জীবনের নানা দিক নিয়ে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করে, বিশেষ করে নৈতিকতা, শিক্ষা এবং সামাজিক কল্যাণের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত করতে সাহায্য করে।