বেদান্ত নীতিবিদ্যার আলোকে জীবন মুক্তির ধারণা
বেদান্ত দর্শন হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান দর্শন শাস্ত্র, যা জীবন ও মহাবিশ্বের গভীরতম সত্যকে ব্যাখ্যা করে। বেদান্ত শব্দটি ‘বেদ’ (জ্ঞানের উৎস) এবং ‘অন্ত’ (অন্ত্য, শেষ) থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘বেদের শেষ অংশ’ বা ‘বেদের সারাংশ’। বেদান্ত দর্শনে জীবন মুক্তির ধারণা মূলত আত্মা, ঈশ্বর এবং জগতের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো আত্মজ্ঞান অর্জন করে মানুষকে জীবনের প্রতি প্রকৃত বোঝাপড়া দিতে, যা তাকে মুক্তির দিকে নিয়ে যায়।
১. জীবন মুক্তির মূল উদ্দেশ্য
বেদান্তের মতে, মানবজীবনের শেষ লক্ষ্য হলো মুক্তি (মোক্ষ) অর্জন। মুক্তি মানে হলো সারা জীবনের সংকীর্ণতা, দুঃখ ও জড়তার বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ। মুক্তির অর্থ কেবল শারীরিক বা সামাজিক মুক্তি নয়, বরং এটি আত্মার প্রকৃত পরিচয় উপলব্ধি। বেদান্তে মনে করা হয়, মানুষ তার প্রকৃত আত্মা, বা ‘আত্মা’ (অত্ম), যে ঈশ্বরের অংশ, সে বিষয়ে অজ্ঞ। এই অজ্ঞতার কারণেই মানুষ জন্ম-মৃত্যুর循环 (সঞ্চার-সংশার) চক্রে বন্দী থাকে। মুক্তির উদ্দেশ্য হলো এই অজ্ঞতা থেকে মুক্তি লাভ এবং আত্মসাক্ষাৎ বা ‘ব্রহ্ম জ্ঞান’ অর্জন করা।
২. আত্মা ও ঈশ্বরের সম্পর্ক
বেদান্ত দর্শনের প্রধান শিক্ষা হলো, আত্মা (অত্ম) এবং ব্রহ্ম (ঈশ্বর) একে অপরের সঙ্গে অভিন্ন। একে অপরের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। “অহং ব্রহ্মাস্মি” (আমি ব্রহ্ম) বা “তত্বমাসি” (তুমি তা) এই দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা বেদান্তের মূল মন্ত্র। এর মাধ্যমে বোঝানো হয়, প্রতিটি সত্তা (আত্মা) ঈশ্বরেরই একটি অংশ। ঈশ্বর বা ব্রহ্ম সজ্ঞা, অপরিসীম, চিরস্থায়ী এবং সবকিছুর উৎস। কিন্তু, মানুষ নিজের প্রকৃত সত্তা বা আত্মাকে ভুলে গিয়ে জগতের জড় জিনিসগুলোতে আটকে থাকে। এই অজ্ঞতার মূলে রয়েছে আত্ম-পরিচয়ের অভাব। জীবন মুক্তির জন্য এই আত্মপরিচয় অর্জন করা অত্যন্ত জরুরি।
৩. জীবনের সংকীর্ণতা ও মোহের গুরুত্ব
বেদান্ত মতে, মানুষ জগতের মোহে (মায়া) আবদ্ধ হয়ে থাকে। মায়া হলো সেই শক্তি যা ঈশ্বরের অসীমত্ব এবং চিরস্থায়ী অস্তিত্বকে আড়াল করে দেয়। এই মায়ার মধ্যে মানুষ ধরা পড়ে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে। মানুষের জীবনে মায়ার উপস্থিতি তাকে ভ্রান্তির পথে পরিচালিত করে। এই ভ্রান্তি ও মোহ কাটিয়ে উঠতে হবে, যাতে সে ঈশ্বরের সাথে একত্ব অনুভব করতে পারে এবং মায়ার বাইরের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারে।
৪. নমঃ শিবায় ও কর্মের গুরুত্ব
বেদান্ত দর্শনে বিশ্বাস করা হয় যে, মানবজীবন ঈশ্বরেরই এক রূপ, এবং জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো ঈশ্বরের সাথে একাত্মতা অর্জন। এই উদ্দেশ্য অর্জন করার জন্য সৎ কর্ম (কর্মযোগ) অপরিহার্য। ‘কর্ম’ বা কাজের মাধ্যমে মানুষ নিজের মনের কলুষতা ও জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারে। তবে, বেদান্ত মতে, এই কর্ম করা উচিত নির্দ্বিধায় এবং নিষ্কামভাবে, অর্থাৎ ফলের প্রত্যাশা ছাড়াই। এমন কর্মই মানুষকে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করে, কারণ এর মাধ্যমে আত্মসন্তুষ্টি ও সৃষ্টির প্রতি সদাশয়তা প্রকাশ পায়।
৫. জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ
বেদান্ত দর্শনে মুক্তির দুই প্রধান পথ আছে—জ্ঞানযোগ এবং ভক্তিযোগ। জ্ঞানযোগের মাধ্যমে মানুষ আত্মজ্ঞান অর্জন করে ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করতে পারে। এ ক্ষেত্রে, মেধা ও চিন্তাশক্তির মাধ্যমে আত্মের প্রকৃত পরিচয় জানা হয়। অন্যদিকে, ভক্তিযোগ হলো ঈশ্বরের প্রতি পূর্ণ ভক্তি ও প্রেমের মাধ্যমে মুক্তি অর্জন। এ পথে, ঈশ্বরকে একমাত্র স্রষ্টা ও করুণাময় বলেই মেনে নিয়ে তাঁর প্রতি আনুগত্য ও প্রেমের মাধ্যমে আত্ম-মুক্তির উদ্দেশ্য সাধিত হয়।
৬. মুক্তির প্রক্রিয়া
মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয় আত্মজ্ঞান থেকে, যেখানে ব্যক্তি তার প্রকৃত আত্মার পরিচয় পায় এবং বুঝতে পারে যে, সে ঈশ্বরের অংশ। এরপর, যখন এই আত্মজ্ঞান দৃঢ় হয় এবং মানুষ তার অন্তরের মোহ কাটিয়ে উঠতে পারে, তখনই তাকে মায়ার দ্বারা আবদ্ধ থাকা অবস্থায় মুক্তি লাভ হয়। বেদান্তের মতে, মুক্তি বা ‘মোক্ষ’ শুধুমাত্র এই দুনিয়ার সীমাবদ্ধতা ও দুঃখ থেকে মুক্তি নয়, বরং এটা হলো ঈশ্বরের সঙ্গের একাত্মতা, যা চিরকাল স্থায়ী।
৭. নির্বাণ ও পরম আনন্দ
বেদান্ত দর্শনের শেষ লক্ষ্য হলো নির্বাণ বা পরম আনন্দ। মুক্তির পর, ব্যক্তি আর জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আটকে থাকে না। সে সর্বত্র ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করে এবং তার জীবনের প্রতি অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। এটি এক ধরনের চিরস্থায়ী শান্তি ও পরম আনন্দের অবস্থা, যেখানে সব কিছু একতাবদ্ধ হয়ে যায়।
সমালোচনা
বেদান্ত নীতিবিদ্যার সমালোচনা
বেদান্ত দর্শন ভারতের অন্যতম প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ দর্শন শাস্ত্র হলেও, এর কিছু নীতির প্রতি সমালোচনাও রয়েছে। বিশেষত আধুনিক যুগের চিন্তাশীলরা এই দর্শনকে কিছু বিষয় নিয়ে সমালোচনা করেছেন। সমালোচনাগুলি সাধারণত তিনটি প্রধান দৃষ্টিকোণ থেকে হয়: জগৎ ও ঈশ্বরের সম্পর্ক, মুক্তির ধারণা এবং সামাজিক প্রভাব।
১. জগৎ ও ঈশ্বরের সম্পর্ক নিয়ে সমালোচনা
বেদান্ত দর্শনে ঈশ্বর ও জগতের সম্পর্ক অবস্থানবাদের (Idealism) দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বেদান্ত অনুযায়ী, এই জগতটি মায়া (মিথ্যা) এবং আসল সত্য হল ঈশ্বর বা ব্রহ্ম। কিন্তু অনেক দর্শনবিদ বিশেষত নাস্তিক্যবাদী ও বাস্তববাদী চিন্তকরা এই মতবাদকে প্রশ্ন করেছেন। তাদের মতে, যদি এই জগতটি মিথ্যা হয়, তবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞান ও বাস্তবতার প্রতি আমাদের বিশ্বাস কি তাৎপর্যহীন? আবার, যেহেতু মানুষ একটি বাস্তব জগতের মধ্যে বাস করে, তাকে অস্বীকার করার ফলে বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানের জন্য যে চিন্তাভাবনা প্রয়োজন, তা বেদান্তের দৃষ্টিতে উপেক্ষিত হয়।
২. মুক্তির ধারণা নিয়ে সমালোচনা
বেদান্ত দর্শনে মুক্তি বা মোক্ষ হল জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য, যেখানে ব্যক্তি তার মায়ার জাল ছিন্ন করে ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মতা অর্জন করে। তবে, এই দৃষ্টিভঙ্গি কিছু আধুনিক চিন্তাবিদদের কাছে বিভ্রান্তিকর। তাদের মতে, মুক্তির ধারণাটি জীবনের বাস্তব সমস্যার প্রতি কোনো কার্যকরী সমাধান দেয় না। ধরুন, একজন দারিদ্র্যসীমায় বসবাসকারী মানুষ যদি কেবল আত্মমুক্তির দিকে মনোনিবেশ করে, তবে তার কাছে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যাগুলির কোনো গুরুত্ব থাকবে না। একে কিছু সমালোচক “অধিকারহীন নিরাশবাদ” হিসেবে দেখেন, যা বর্তমান সমাজের পরিবর্তন বা উন্নতির জন্য কার্যকর নয়।
৩. সামাজিক প্রভাব নিয়ে সমালোচনা
বেদান্ত দর্শন কখনো কখনো অহিংসা, বৈষম্য এবং ধর্মীয় নিঃস্বার্থতা মতবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে থাকতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, এই দর্শনকে জাতিভেদ ও বর্ণব্যবস্থা সমর্থন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, মুক্তির জন্য উচ্চ বর্ণের মানুষদের বিশেষ সুবিধা পাওয়ার কথা বলা হয়, যার ফলে নিম্নবর্ণের মানুষদের সমাজে সমান অধিকার ও মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে কোনো সঠিক সমাধান পাওয়া যায় না। এই দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে বৈষম্য ও অনৈক্য সৃষ্টি করতে পারে, যা আধুনিক মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
৪. গণমুখী সমাজের জন্য অপর্যাপ্ত
বেদান্ত দর্শনের অন্যতম কেন্দ্রীয় ধারণা হলো “অহং ব্রহ্মাস্মি” বা “আমি ঈশ্বর”, যা একজন ব্যক্তির আত্মার ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মতার উপলব্ধি। তবে, এই ধারণা কিছু সমাজসংক্রান্ত চিন্তাবিদদের কাছে সীমাবদ্ধ মনে হতে পারে, কারণ এটি অনেক সময় সমাজের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যকে অবহেলা করার পক্ষে যুক্তি তৈরি করতে পারে। সমাজের অবস্থা এবং মানবকল্যাণের দিকে মনোনিবেশ করা, বেদান্ত দর্শনের অনেক সময় অনুপস্থিত থাকে, যার ফলে তা পুরোপুরি কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে না।
—
উপসংহার
বেদান্ত দর্শন এমন একটি দর্শন, যা বহু প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় চিন্তাধারার অঙ্গ হয়ে এসেছে। এটি আত্মার প্রকৃত পরিচয় এবং ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মতার মাধ্যমে মুক্তির পথে দিশা দেখানোর চেষ্টা করেছে। তবে, এই দর্শনের কিছু ধারণা আধুনিক সমাজের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় যথেষ্ট কার্যকরী নয়।
বেদান্ত দর্শনের মূলে রয়েছে একাত্মতার অনুভূতি এবং মায়ার বাস্তবতা থেকে মুক্তির তত্ত্ব, কিন্তু এগুলি একদিকে মানুষের আত্মিক উন্নতির দিকে ইঙ্গিত করে, আবার অন্যদিকে কখনো কখনো সমাজের বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার প্রবণতা তৈরি করে। বিশেষ করে আধুনিক যুগের গণতান্ত্রিক ও সামাজিক সচেতনতার পরিপ্রেক্ষিতে, যেখানে সমাজের সমস্যা সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা অপরিহার্য, সেখানে বেদান্ত দর্শন অনেক সময় বাস্তব দুনিয়ার চাহিদার সঙ্গে মিলিয়ে উঠতে পারে না।
অতএব, বেদান্ত দর্শনের ধারণাগুলি অবশ্যই মূল্যবান, তবে এর প্রয়োগকে সময়ের সাথে আধুনিক প্রেক্ষাপটে সংশোধন ও পরিমার্জন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে, ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে জীবনের প্রতিটি স্তরে শান্তি, কল্যাণ এবং উন্নতির জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
বেদান্ত দর্শনে জীবন মুক্তি অর্জনের পথ একটিই—আত্মজ্ঞান ও ঈশ্বরের সঙ্গের একাত্মতা। জীবনের উদ্দেশ্য হলো মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ এবং নিজের সত্য পরিচয় উপলব্ধি করা। বেদান্তের মাধমে মানুষ তার জগতের আসল উদ্দেশ্য ও ঈশ্বরের প্রতি প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে পারে, যা তাকে চিরকাল শান্তি ও আনন্দের দিকে নিয়ে যায়।