বৌদ্ধ নীতিবিদ্যায় কিভাবে বৌধিচিত্ত অর্জন করা যায়? পারমিতা সাধনা ও পঞ্চশীলের ব্যাখ্যা

বৌদ্ধ ধর্মের মূল শিক্ষা হচ্ছে দুঃখের কারণ এবং তার মুক্তি। এই ধর্মের অনুশীলনকারী প্রতিটি বৌদ্ধের উদ্দেশ্য, একদিন বুদ্ধত্ব অর্জন করা, যা হলো সর্বোচ্চ মুক্তি ও পরম শান্তি। এর জন্য, বৌদ্ধ অনুসারীদের বিভিন্ন আধ্যাত্মিক অনুশীলন করতে হয়, যেগুলির মধ্যে অন্যতম হলো বৌধিচিত্ত (Bodhicitta) অর্জন। বৌধিচিত্ত অর্জন হলো সেই মানসিক অবস্থান, যেখানে একজন বৌদ্ধের মন পুরোপুরি পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে দয়া, করুণার ও সদ্ভাবনায়, যাতে তিনি নিজেকে এবং সকল প্রাণীজগতকে মুক্তি দিতে চান। এই পথে চলতে গিয়ে, দুটি প্রধান পথ রয়েছে, যা হলো পারমিতা সাধনা এবং পঞ্চশীল।

এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব কিভাবে বৌধিচিত্ত অর্জন করা যায় এবং কীভাবে পারমিতা সাধনা ও পঞ্চশীল বৌধিচিত্ত অর্জনের পথে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

১. বৌধিচিত্ত অর্জন: 

বৌধিচিত্ত (Bodhicitta) শব্দটি দুইটি অংশে বিভক্ত: “বোধি” মানে হলো জ্ঞান বা বুদ্ধত্ব এবং “চিত্ত” মানে হলো মন বা ইচ্ছা। তাই, বৌধিচিত্তের আক্ষরিক অর্থ হলো বুদ্ধত্ব বা জ্ঞান অর্জনের ইচ্ছা। এটি এমন একটি শক্তিশালী মানসিক অবস্থান যা শুধুমাত্র নিজের মুক্তির দিকে মনোনিবেশ না করে, অন্যদের মুক্তির দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখে। বৌধিচিত্ত অর্জনের মাধ্যমে একজন বৌদ্ধ তাঁর আত্মা ও সমাজের মঙ্গল সাধনে নিবেদিত হন।

বৌধিচিত্ত অর্জনের মূল লক্ষ্য হলো সাম্প্রতিক দুঃখের অবসান, বিশ্বস্তরে দয়া ও করুণার বোধ এবং অন্যদের প্রতি উদার মনোভাব। এটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত মুক্তির দিকে নয়, বরং পৃথিবীজুড়ে সব প্রাণীর জন্য মঙ্গল কামনা করে। যখন এক ব্যক্তি এই বোধি-চিত্ত অর্জন করেন, তখন তাঁর মন শুদ্ধ হয় এবং তিনি একটি গভীর আধ্যাত্মিক উদারতা অনুভব করেন, যা তাকে বুদ্ধত্বের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

২. পারমিতা সাধনা: বৌধিচিত্ত অর্জনের প্রক্রিয়া

পারমিতা (Perfection) সাধনা হলো বৌদ্ধ ধর্মের এক বিশেষ আধ্যাত্মিক অনুশীলন, যার মাধ্যমে বৌধিচিত্ত অর্জন করা যায়। পারমিতা সাধনার উদ্দেশ্য হলো আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা লাভ করা, যা বৌধিচিত্তের মূল উদ্দেশ্য। পারমিতা শব্দটির অর্থ হলো “পূর্ণতা” বা “অত্যুচ্চ উন্নতি”, এবং এটি সাধারণত দশটি প্রধান গুণাবলি বা পরিপূর্ণতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এগুলি হলো:

১. দান পারমিতা (Dana Paramita): দান বা উদারতা সাধনা, যা অন্যদের জন্য স্বেচ্ছায় উপকার সাধনের ইচ্ছা। ২. শীল পারমিতা (Sila Paramita): নৈতিক শুদ্ধতা ও শীল পালন। ৩. ধর্মপরীক্ষা বা ধৈর্য পারমিতা (Kshanti Paramita): ধৈর্য ও সহনশীলতা। ৪. উদ্যম পারমিতা (Virya Paramita): কঠোর পরিশ্রম ও সাহস। ৫. ধ্যান পারমিতা (Dhyana Paramita): ধ্যান বা মনোসংযোগ সাধনা। ৬. প্রজ্ঞা পারমিতা (Prajna Paramita): জ্ঞান বা বুদ্ধির পরিপূর্ণতা।

এই ছয়টি প্রধান পারমিতাই বৌধিচিত্ত অর্জনের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করে। এগুলি কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক উন্নতি নয়, সমাজের মঙ্গল সাধনার উদ্দেশ্যেও গুরুত্বপূর্ণ।

২.১ দান পারমিতা (Dana Paramita)

দান সাধনা হচ্ছে সমস্ত মনের উদারতা দিয়ে অন্যদের সেবা করা। এটি বৌধিচিত্ত অর্জনের পথে একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ, কারণ এটি একজন অনুসারীকে নিজস্ব লোভ, হিংসা ও অহংকার থেকে মুক্তি দেয়। উদারতার মাধ্যমে মানুষ নিজের সম্পদের সাথে সবার প্রতি দয়া ও সহানুভূতির অনুভুতি জাগ্রত করতে পারে।

২.২ শীল পারমিতা (Sila Paramita)

শীল বা নৈতিক শুদ্ধতা সাধনা, যা পঞ্চশীল পালন দ্বারা প্রমাণিত হয়। পঞ্চশীল হলো পাঁচটি মৌলিক নৈতিক বিধি, যা বৌদ্ধ অনুসারীরা পালন করেন (এগুলি পরবর্তী অংশে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে)। এই শীলগুলো একজন অনুসারীকে শুদ্ধ জীবনযাপন করতে এবং নিজের মন ও শরীরকে শুদ্ধ রাখতে সহায়ক হয়। এর মাধ্যমে একজন বৌদ্ধ তার দেহ, মন ও বাক্যকে শুদ্ধ করে।

২.৩ ধর্মপরীক্ষা বা ধৈর্য পারমিতা (Kshanti Paramita)

ধৈর্য সাধনা মানে হলো সকল কষ্ট, গ্লানি ও কষ্টকে সহ্য করা এবং দুঃখের প্রতি সহানুভূতি রাখা। এটা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গুণ, কারণ বৌধিচিত্ত অর্জন করতে গেলে ব্যক্তির মানসিক অবস্থা, মনোবল এবং সহ্যশক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

২.৪ উদ্যম পারমিতা (Virya Paramita)

উদ্যম বা পরিশ্রম সাধনা হলো বুদ্ধত্ব অর্জনের পথে নিরলস প্রচেষ্টা ও সক্রিয় উদ্যোগ। এটা ব্যক্তির সাহস ও উদ্যমকে জাগ্রত করে এবং তার আধ্যাত্মিক যাত্রায় গতিশীলতা আনয়ন করে।

২.৫ ধ্যান পারমিতা (Dhyana Paramita)

ধ্যান সাধনা বা মনোসংযোগ সাধনা হলো বৌধিচিত্ত অর্জনের এক অপরিহার্য অংশ। এর মাধ্যমে একজন বৌদ্ধ তার মনকে শান্ত করতে পারে এবং তার চিন্তা, কথা ও কাজকে শুদ্ধ করতে সক্ষম হয়। ধ্যানের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেকে আরও ভালভাবে বুঝতে পারে এবং তাকে তার আধ্যাত্মিক পথের প্রতি মনোযোগী হতে সহায়তা করে।

২.৬ প্রজ্ঞা পারমিতা (Prajna Paramita)

প্রজ্ঞা পারমিতা হলো বুদ্ধির পরিপূর্ণতা বা জ্ঞানের সাধনা। এটি হলো সেই গুণ যা একজন বৌদ্ধকে “জ্ঞান” বা “বুদ্ধত্ব” অর্জনের দিকে পরিচালিত করে। এই গুণের মাধ্যমে একজন বৌদ্ধ বুঝতে পারেন সব কিছু অবলম্বন বা সাস্মৃতির ওপর ভিত্তি করে; সব কিছুই অস্থায়ী ও পরিবর্তনশীল।

৩. পঞ্চশীল: বৌধিচিত্ত অর্জনের প্রাথমিক পদক্ষেপ

বৌধিচিত্ত অর্জনের পথে পঞ্চশীল (পাঁচটি শীল) পালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্চশীল হলো পাঁচটি মৌলিক নৈতিক বিধি, যা একজন বৌদ্ধ অনুসারী তার জীবনের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে পালন করেন। এগুলো হলো:

১. প্রাণহিংসা মুক্তি: প্রাণী হত্যা বা শারীরিক আঘাত না করা। এটি দয়া ও সহানুভূতির প্রতীক। ২. চুরি না করা: অন্যের সম্পত্তি চুরি না করা বা অযথা লাভ-ক্ষতি না করা। ৩. অশ্লীলতা পরিহার: অবৈধ যৌন আচরণ থেকে দূরে থাকা। ৪. মিথ্যা না বলা: সত্য কথা বলা এবং মিথ্যা বা অসত্য কথা বলার থেকে বিরত থাকা। ৫. মাদক দ্রব্য পরিহার: মদ্যপান ও মাদক দ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকা।

১. প্রাণহত্যা থেকে বিরত থাকা (পাঁচম-রাহিত):

প্রথম শীলটি হল জীবহত্যা থেকে বিরত থাকা। বৌদ্ধধর্মে সমস্ত জীবের প্রতি মমতা ও করুণা প্রকাশের জন্য এই শীলটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি মানুষের মধ্যে অহিংসা বা হিংসামুক্তি চর্চার প্রেরণা দেয়। প্রাণী, পাখি, মাছ, গাছ ইত্যাদি সবার প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি প্রদর্শন করা এই শীলের মূল উদ্দেশ্য।

২. চুরিবিদ্বেষ থেকে বিরত থাকা (অধর্মচুরি):

দ্বিতীয় শীলটি হল চুরি বা অন্যের সম্পত্তি গ্রহণ না করা। এটি মানুষের মধ্যে সততা ও নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করে। এই শীল অনুসরণ করলে ব্যক্তির মধ্যে লোভ, দুঃখ, এবং অপরাধ প্রবণতা কমে যায়, এবং সমাজে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

৩. অশুদ্ধ ভাষা থেকে বিরত থাকা (কপটনির্বাণ):

তৃতীয় শীলটি হল অশুদ্ধ ভাষা বা মিথ্যা বলা, গুজব রটানো, কুৎসা করা, অপবাদ করা বা কটু ভাষা ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা। এই শীল অনুসরণ করলে মানুষের মধ্যে সততা, সজ্জনতা এবং সমঝদারী বৃদ্ধি পায়। এটি সমাজে শান্তি ও বন্ধুত্বের পরিবেশ সৃষ্টি করে।

৪. অনৈতিক কর্ম থেকে বিরত থাকা (অধর্মকর্ম):

চতুর্থ শীলটি হল যৌন জীবনকে শুদ্ধভাবে ধারণ করা। এটি অর্থাৎ অশুদ্ধ যৌনাচরণ থেকে বিরত থাকা। বৌদ্ধধর্মে এই শীলটি ব্যক্তির আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি মানুষের চরিত্র ও নৈতিকতা উন্নত করে এবং সমাজে শালীনতা বজায় রাখে।

৫. মাদকাশক্তি থেকে বিরত থাকা (মদপান):

পঞ্চম শীলটি হল মদ্যপান বা মাদকদ্রব্য থেকে বিরত থাকা। মদ্যপান ও মাদকদ্রব্য গ্রহণ মানসিক বিকৃতি, দেহের ক্ষতি ও নৈতিক অবক্ষয়ের কারণ হতে পারে। এই শীলটি মানুষকে সচেতন ও সুস্থ জীবনযাপন করতে উৎসাহিত করে, যার ফলে শরীর ও মন সুস্থ থাকে এবং আত্মজ্ঞান লাভের পথ সুগম হয়।

পঞ্চশীলের গুরুত্ব: পঞ্চশীল কেবল ধর্মীয় আচরণ বিধির অংশ নয়, বরং এটি একজন ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে সুশৃঙ্খল, সৎ এবং শান্তিপূর্ণ জীবন গঠনের মৌলিক ভিত্তি। এই শীলগুলি মানুষের মনের খারাপ প্রবণতা, যেমন হিংসা, লোভ, মিথ্যাচার, কামনা ইত্যাদি প্রতিরোধ করে। ফলে ব্যক্তি তার চারপাশে একটি শান্ত, সহানুভূতিশীল, এবং সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে।

বৌদ্ধধর্মে পঞ্চশীল পালন করা একান্তই একজন বৌদ্ধের জন্য নয়, বরং সমাজের প্রতিটি মানুষের জন্যই উপকারী। এটি ব্যক্তির আচার-ব্যবহারে মঙ্গল দান করে এবং সমাজের নৈতিক অবস্থানকে মজবুত করে। পঞ্চশীল অনুসরণ করলে জীবন হবে সুস্থ, সঠিক এবং আত্মসম্মানপূর্ণ। এটি বৌদ্ধ নীতিবিদ্যার মূল স্তম্ভগুলির মধ্যে একটি এবং এটি ব্যক্তিগত ও সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে।

পঞ্চশীল পালন একজন বৌদ্ধ অনুসারীকে মানসিক শুদ্ধতা এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির দিকে পরিচালিত করে। যখন একজন ব্যক্তি এই পাঁচটি শীল অনুসরণ করেন, তখন তার মন শান্ত হয় এবং তাকে বৌধিচিত্ত অর্জনের পথে পরিচালিত করতে সহায়ক হয়।

উপসংহার

বৌধিচিত্ত অর্জন একটি দীর্ঘ, কঠিন, কিন্তু পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিক যাত্রা। এই যাত্রায়, পারমিতা সাধনা ও পঞ্চশীল পালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পারমিতা সাধনার মাধ্যমে একজন বৌদ্ধ তার আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা অর্জন করে এবং পঞ্চশীলের মাধ্যমে সে নিজের শুদ্ধতা রক্ষা করতে পারে। এই দুটি প্রক্রিয়া মিলে একজন বৌদ্ধের মন ও চিন্তাকে শুদ্ধ করে এবং তাকে বুদ্ধত্ব অর্জনের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *