চার্বাকরা বিশ্বাস করতেন যে, এই পাঁচটি মৌলিক উপাদান—ক্ষেতি, অপ, তেজ, মরুত এবং আকাশ—এগুলি একে অপরের সঙ্গে মিশে সমস্ত সৃষ্টির উৎপত্তি ঘটিয়েছে। তাদের মতে, প্রতিটি উপাদানই একে অপরের সঙ্গে নির্দিষ্ট পরিমাণে মিশে নতুন নতুন বস্তু সৃষ্টি করে, যেমন প্রাণী, গাছপালা, মানুষ, পাহাড়, নদী ইত্যাদি।
চার্বাক দর্শনে এই মৌলিক উপাদানগুলির মধ্যে কোনো প্রাকৃতিক শক্তি বা অদৃশ্য ঈশ্বরের ক্ষমতা নেই, বরং প্রতিটি উপাদানের গুণাবলী এবং তাদের মিশ্রণ ও পরিবর্তনের মাধ্যমে জগতের সৃষ্টি হয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে, সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোনও চিরস্থায়ী বা অতীন্দ্রিয় শক্তির প্রয়োজন নেই। সব কিছু প্রাকৃতিক নিয়মেই ঘটে এবং সৃষ্টির পরে ধ্বংসও হবে।
মোটের উপর, চার্বাক দর্শনের ভিত্তি হল প্রাকৃতিকবাদ, যেখানে সকল ঘটনা বা সৃষ্টি-ধ্বংস প্রাকৃতিক উপাদানগুলির নির্ধারিত পরিবর্তনের ফলস্বরূপ।
ঈশ্বর, আত্মা ও পরকাল সম্পর্কে তাদের ধারনা:
চার্বাক দর্শন, যা প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের মধ্যে অন্যতম, সেসব ধারণার মধ্যে অন্যতম যা ঈশ্বর, আত্মা এবং পরকাল সম্পর্কে বিরোধী। চার্বাকরা আধ্যাত্মিকতা বা ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি তীব্র সমালোচনা করেছেন এবং প্রাকৃতিক বাস্তবতার উপর জোর দিয়েছেন। তাঁদের দৃষ্টিতে ঈশ্বর, আত্মা এবং পরকাল এইসব ধারণা শুধুমাত্র মানুষের কল্পনা বা ধর্মীয় প্রতারণার ফলস্বরূপ।
১. ঈশ্বর সম্পর্কে চার্বাকদের ধারণা:
চার্বাক দর্শনে ঈশ্বরের কোনও অস্তিত্ব নেই। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, জগতের সৃষ্টি, চলাচল বা পরিণতি কোনও ঈশ্বরের মাধ্যমে ঘটে না, বরং প্রকৃতির নিয়মে ঘটে। তাদের মতে, ঈশ্বরের ধারণাটি মানুষের কল্পনা এবং পুরোহিতদের স্বার্থে তৈরী করা হয়েছে। চার্বাকরা প্রশ্ন তুলতেন, যদি ঈশ্বর থাকেন, তাহলে পৃথিবীতে এত দুঃখ, কষ্ট ও অন্যায় কেন রয়েছে? যদি ঈশ্বর থাকতেন, তবে কেন মানুষের জীবনে এমন সব ঘটনা ঘটে যা তাদের কষ্ট দেয়, যেমন অসুখ-বিসুখ, দারিদ্র্য, যুদ্ধ এবং অনাচার?
তাদের মতে, যদি ঈশ্বর থাকতেন, তাহলে সৃষ্টির মধ্যে এত বিচ্যুতি এবং অমুকের মধ্যে এত ত্রুটি কেন দেখা যাবে? এটি প্রমাণ করে যে, ঈশ্বরের ধারণা অসত্য এবং মানব মনের কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। ঈশ্বর বা আধ্যাত্মিক শক্তির অস্তিত্ব না থাকার কারণে, চার্বাকরা বিশ্বাস করতেন যে, সব কিছু প্রাকৃতিক উপাদানগুলির পরিবর্তন ও সম্পর্কের ফলস্বরূপ ঘটছে।
২. আত্মা সম্পর্কে চার্বাকদের ধারণা:
চার্বাকরা আত্মার অস্তিত্বও অস্বীকার করেছেন। তাঁদের মতে, মানুষ বা জীবের কোনো অদৃশ্য আত্মা নেই যা মৃত্যুর পর জীবিত থাকে। আত্মা বা পরবর্তী জীবনের কোনো বাস্তব প্রমাণ নেই। চার্বাক দর্শনে, মৃত্যু মানেই চিরন্তন নিঃশেষ।
তাঁদের মতে, মৃত্যুর পর শরীর ভেঙে যায়, এবং এর কোনো পরবর্তী জীবন বা আত্মার অস্তিত্ব নেই। মানুষের অনুভূতি, চিন্তা এবং কর্মগুলো তার শারীরিক এবং শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ। তাই, মানুষের জীবনটি শরীরের কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যখন শরীর মারা যায়, তখন সমস্ত কার্যকলাপ, অনুভূতি ও চিন্তাভাবনা শেষ হয়ে যায়। আত্মার কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব বা চিরস্থায়ী সত্তা নেই।
৩. পরকাল বা পুনর্জন্ম সম্পর্কে চার্বাকদের ধারণা:
চার্বাক দর্শন পরকাল বা পুনর্জন্মের ধারণাকেও অস্বীকার করেছে। তাঁদের মতে, মৃত্যুর পর কোনো ধরনের পুনর্জন্ম হয় না, কারণ মৃত্যুর পর ব্যক্তি বা প্রাণী একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যায়। পরবর্তী জীবনের ধারণা, যেমন পুনর্জন্ম বা স্বর্গ-নরক, তাদের কাছে অবাস্তব এবং কল্পনার ফলস্বরূপ।
চার্বাকরা বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের জীবন এই পৃথিবীতেই সীমাবদ্ধ এবং মৃত্যুর পর তার কোনো অস্তিত্ব থাকে না। মৃত্যুর পর, শরীর মাটিতে মিশে যায় এবং সমস্ত অনুভূতি, চিন্তা বা জীবনধারা শেষ হয়ে যায়। সুতরাং, পুনর্জন্মের বা পরকালগত জীবনের কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। তারা মনে করতেন, মানুষকে জীবনে সুখী হতে হবে, কারণ সে একমাত্র এই জীবনে সুখ ও দুঃখের অভিজ্ঞতা করতে পারে। পরবর্তী জীবনের কোনো আশা বা ভয় তাদের কাছে অর্থহীন।