বৃহস্পতিসূত্র সম্পর্কে চার্বাকদের ধারনা

চার্বাক (বা লোকায়ত) দর্শনের বৃহস্পতিসূত্র বা ‘বৃহস্পতি সূত্র’ হল চার্বাকদের মৌলিক দর্শনের একটি ধারণা, যা প্রাকৃতিক ও বস্তুগত জগতের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরে। বৃহস্পতিসূত্রের মাধ্যমে তারা আধ্যাত্মিক বা অতিপ্রাকৃত দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাস্তবিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দিয়েছে। এই সূত্রটি চার্বাক দর্শনের মূল দর্শনকে সংক্ষেপে প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয়েছে:

“যৎ সত্যং তৎ তত্ত্বম্, সত্যেন লভ্যন্তে সরণং”

অথবা “যৎ সত্যং তৎ তত্ত্বম্” — এর মানে হল যে, যা কিছু আমাদের অনুধাবনযোগ্য এবং যা প্রকৃত সত্য, সেটাই একমাত্র বাস্তব। চার্বাকদের মতে, প্রকৃত জ্ঞান হচ্ছে যেটি আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুধাবন করা যায় এবং এর বাইরে কোনো অতিপ্রাকৃত বা আধ্যাত্মিক ধারণার কোনো অস্তিত্ব নেই।

বৃহস্পতিসূত্রের মূল ধারণা:

1. প্রকৃতিবাদী দর্শন

চার্বাকরা বিশ্বাস করতেন যে এই জগৎ কেবলমাত্র প্রকৃতির নিয়মে চলে। আমাদের জীবন ও বিশ্বপ্রকৃতির সমস্ত ঘটনা শারীরিক কারণের উপর নির্ভরশীল, আধ্যাত্মিক বা অতিপ্রাকৃত কোনো কারণ নেই।

2. ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান:

 তাদের মতে, একমাত্র ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রাপ্ত জ্ঞানই সত্য। কোনো কল্পনা, ধর্মীয় বিশ্বাস বা আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা তাদের দৃষ্টিতে মিথ্যা ও অস্বীকারযোগ্য।

3. দেহবাদিতা:

 চার্বাক দর্শনে দেহকে কেন্দ্র করে জীবন ও জগতের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তাদের মতে, মানুষ তার দেহের অংশ, এবং মৃত্যুর পর কোনো আত্মা বা পুনর্জন্মের ধারণা সত্য নয়।

4. আনন্দের সাধনা: 

চার্বাকরা জীবনের উদ্দেশ্যকে শারীরিক সুখ ও আনন্দে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। তাদের মতে, জীবনে সুখ পাওয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য, এবং এ জন্য উপভোগ ও ভোগবাদিতা জরুরি।

বৃহস্পতিসূত্রের মাধ্যমে চার্বাক দর্শন একাধারে বাস্তববাদী, ইন্দ্রিয় নির্ভর এবং ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে। এটি প্রাকৃতিক ও শারীরিক বাস্তবতা দিয়ে জীবনের ব্যাখ্যা দেয় এবং কোনো অতিপ্রাকৃত বা অবাস্তব জ্ঞানের দিকে ঝোঁকতে বলে না।

ক্ষিতি,অপ, তেজ, মরুৎ,আকাশ সম্পর্কে চার্বাকদের ধারনা:

চার্বাক দর্শনে, পৃথিবী ও জগতের সৃষ্টি নিয়ে কোনও ঈশ্বর বা অতীন্দ্রিয় শক্তির ভূমিকা নেই, বরং সব কিছু প্রাকৃতিক উপাদানগুলির সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে। চার্বাকরা বিশ্বাস করতেন যে ক্ষেতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (অগ্নি), মরুত (বাতাস), এবং আকাশ (ইথার) এই পাঁচটি মৌলিক উপাদানই পৃথিবী ও সমগ্র জগতের মূল ভিত্তি।

চার্বাকদের মতে, এই পাঁচটি উপাদানের সংমিশ্রণ ও পরিবর্তনই সৃষ্টির কারণ। প্রতিটি উপাদান একে অপরের সাথে মিশে নতুন নতুন বস্তু বা সৃষ্টির রূপ ধারণ করে।

1. ক্ষেতি (মাটি): 

মাটি বা ক্ষেতি হলো পৃথিবীর স্থিতিশীলতা, যেখানে সব কিছু প্রতিষ্ঠিত এবং দৃঢ়। মাটি শোষণ ও ধারণের ক্ষমতা রাখে, এবং জীবনের উৎপত্তির জন্য এটি অপরিহার্য। এটি পৃথিবীকে গঠন করে এবং সব জীবজগতের ভিত্তি।

2. অপ (জল):

 জল বা অপ হলো জীবনের অন্যতম মৌলিক উপাদান। জল ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। এটি পৃথিবীতে বৃষ্টি, নদী, সাগর ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবেশকে জীবনধারণের জন্য উপযুক্ত করে তোলে। চার্বাকদের মতে, জলই প্রাণের অন্যতম উৎস।

৩.তেজ বা অগ্নি:

 তেজ বা অগ্নি পৃথিবীতে তাপ ও আলো সরবরাহ করে। এটি জীবনের জন্য অপরিহার্য, কারণ তাপ ছাড়া কোনও কিছুই সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। তেজ বা অগ্নি প্রকৃতির শক্তি, যা পৃথিবীতে জীবনের গতিশীলতা ও পরিবর্তন ঘটায়।

4. মরুত (বাতাস): 

মরুত বা বাতাস হলো পৃথিবীর বায়ু, যা জীবনের চলাচল ও শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য অত্যন্ত জরুরি। বাতাস ছাড়া পৃথিবীর সুষম জীবনধারণ সম্ভব নয়। বাতাসের মাধ্যমে পৃথিবীর সমস্ত সজীব ও অজীব গঠন একে অপরের সাথে সম্পর্কিত থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *