ভূমিকা:
নীতিবিদ্যা বা “Ethics” হলো মানুষের ভালো-মন্দ, সঠিক-ভ্রান্ত, ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কিত অধ্যয়ন। এটি এমন একটি শাখা, যা মানবিক আচরণ এবং তার পরিণাম সম্পর্কে চিন্তা করে এবং আমাদের জীবনের বিভিন্ন দিকের জন্য নৈতিক নীতির দিশা নির্ধারণ করে। নীতিবিদ্যা আমাদেরকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে এবং সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে ন্যায় এবং সৎ আচরণের পথে পরিচালিত করে।নীতিবিদ্যার মূল উদ্দেশ্য হলো, কীভাবে মানুষ সঠিকভাবে জীবন যাপন করতে পারে এবং সমাজে ভালো ও ন্যায়সঙ্গত আচরণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তা বোঝানো। এটি কেবলমাত্র ব্যক্তিগত নৈতিকতা নয়, বরং সামাজিক নৈতিকতা, অর্থনৈতিক নৈতিকতা, রাজনৈতিক নৈতিকতা এবং পরিবেশগত নৈতিকতাও অন্তর্ভুক্ত করে।
নীতিবিদ্যার বিভিন্ন শাখা রয়েছে। এর মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শাখা হল: ১. বৈষয়িক নীতি (Normative Ethics): এটি নীতির মূল কাঠামো তৈরি করে এবং আমাদের জানতে সাহায্য করে যে কীভাবে আমাদের আচরণ করতে হবে। এটি সাধারণত বিভিন্ন নৈতিক নীতি যেমন সৎ আচরণ, কর্তব্য, কল্যাণের চিন্তা, পরিণামবাদ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে। ২. বর্গীকরণ নীতি (Meta-Ethics): এই শাখা নীতির মূল ধারণাগুলির বিষয়ে চিন্তা করে, যেমন “ভালো” বা “খারাপ” কি? নীতির ভিত্তি কী? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে। ৩. প্রাকটিক্যাল নীতি (Applied Ethics): এটি নীতিবিদ্যার বাস্তবিক প্রয়োগে মনোনিবেশ করে, যেমন চিকিৎসাবিজ্ঞানে নীতি, পরিবেশ নীতি, ব্যবসায়িক নীতি ইত্যাদি। এটি নৈতিক সিদ্ধান্তগুলির বাস্তব জীবনে প্রয়োগ দেখায়। ৪. বৈষম্যবাদ (Descriptive Ethics): এটি মানুষের আচরণ ও নৈতিকতা কীভাবে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ও সমাজে পরিবর্তিত হয় তা পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে।
নীতিবিদ্যা মূলত দুটি প্রধান প্রশ্নের উত্তর খোঁজে:
কী সঠিক? (What is right?)
কী ভালো? (What is good?)
নীতিবিদ্যার আলোচনা মানব সভ্যতার ইতিহাসের অংশ। প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো, এবং অ্যারিস্টটল নীতিবিদ্যার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। তারা মানুষের সঠিক জীবন যাপনের পথ অনুসন্ধান করেছিলেন। পরবর্তীতে, হেগেল, কন্ট, এবং নীতি-মূলক দার্শনিকরা নীতিবিদ্যার ভিন্ন ভিন্ন স্কুল তৈরি করেছেন।
প্রাচ্যের নীতিবিদ্যার ২০টি বৈশিষ্ট্য
প্রাচ্যের নীতিবিদ্যা, যা সাধারণত প্রাচ্য দর্শন বা প্রাচ্য চিন্তাধারার অংশ হিসেবে গণ্য হয়, বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি, এবং ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এই নীতিবিদ্যাটি মূলত আত্মার উন্নতি, মানব জীবনকে ধর্ম ও নৈতিকতার ভিত্তিতে গঠন, এবং পৃথিবী ও মহাবিশ্বের মধ্যে সম্পর্কের আলোচনা করে। এটি প্রাচ্যের চিন্তাভাবনার মূলে থাকা মূল বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম। এখানে প্রাচ্যের নীতিবিদ্যার কিছু বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো:
১. অহিংসা (Non-violence)
প্রাচ্যের নীতিবিদ্যায় অহিংসার গুরুত্ব অত্যন্ত উচ্চ। অহিংসা শুধুমাত্র শারীরিক হিংসার প্রতি বিরোধিতা নয়, বরং মন ও ভাষার মাধ্যমেও সহিংসতা থেকে বিরত থাকার শিক্ষা প্রদান করা হয়। যেমন, বৌদ্ধ ধর্ম এবং জৈন ধর্মে অহিংসার গুরুত্ব অত্যন্ত গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত।
২. ধর্ম (Dharma)
প্রাচ্য চিন্তাধারায় ‘ধর্ম’ শব্দটি একটি গভীর এবং বিস্তৃত ধারণা। এটি ধর্মীয়, নৈতিক, এবং সামাজিক দায়িত্বের সমষ্টি হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রত্যেক মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য ধর্ম অনুসরণ করা, যা সমাজে সঠিক এবং ন্যায়পরায়ণ জীবনযাপন নিশ্চিত করে।
৩. মোক্ষ (Liberation)
প্রাচ্য নীতিবিদ্যার প্রধান লক্ষ্য হল মোক্ষ বা মুক্তি, যা জন্ম ও মরণের চক্র থেকে মুক্তি পাওয়ার অবস্থাকে নির্দেশ করে। এটি মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধি এবং অন্তর্দৃষ্টির উন্নতির দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার পথ।
৪. কারণ ও ফল (Karma and Rebirth)
প্রাচ্য নীতিবিদ্যার একটি মৌলিক ধারণা হল ‘কর্ম’। যে কাজ করা হবে তার ফলাফল একদিন নিশ্চিতভাবে পাওয়া যাবে। এই ধারণা জন্ম ও মরণের পুনরাবৃত্তির (সংসার) মাধ্যমে আত্মার পরিণতি নির্ধারণ করে।
৫. অত্মান (Atman)
প্রাচ্য চিন্তাধারায় আত্মান বা আত্মার ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি এক অভ্যন্তরীণ স্বরূপ, যা সৃষ্টির মূল এবং চিরন্তন। আত্মান ব্যক্তির সকল চিন্তা, অনুভূতি, ও কর্মের মূল।
৬. ব্রাহ্ম (Brahman)
ব্রাহ্ম হল বিশ্বজগতের অদৃশ্য, অবিনশ্বর, এবং অমূর্ত সত্তা। এটি সবকিছুর মূল, যা সর্বত্র বিরাজমান এবং সবার মধ্যে রয়েছে। আত্মান ও ব্রাহ্মের মধ্যে সম্পর্ক হলো, আত্মান হল ব্রাহ্মের একটি প্রতিফলন।
৭. ধ্যান (Meditation)
ধ্যান বা সাধনা প্রাচ্য নীতিবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এটি মন ও আত্মার শুদ্ধি সাধনের প্রক্রিয়া। ধ্যানের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের মধ্যে গভীর আত্মতত্ত্বের অনুসন্ধান করেন এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করেন।
৮. সর্বজনীনতা (Universality)
প্রাচ্য নীতিবিদ্যায় সব মানুষের জন্য এক ধরনের সর্বজনীন নীতির প্রতি শ্রদ্ধা থাকে। সবাইকে সমানভাবে সম্মান করা এবং তাদের নিজ নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি সহানুভূতির মনোভাব পোষণ করা হয়।
৯. সংযম (Self-control)
সংযম বা আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রাচ্য নীতিবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এটি শরীর, মন এবং অনুভূতির উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়া। এটি আত্মপ্রকাশ ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
১০. ব্রহ্মচর্য (Celibacy)
ব্রহ্মচর্য, যা সাধনাকে জীবনযাত্রার মূল শৃঙ্খলা হিসাবে ধরে, প্রাচ্য নীতিবিদ্যায় আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আধ্যাত্মিক উদ্দীপনার জন্য একটি মৌলিক নীতি। এটি নিজেকে প্রাকৃতিক ও দৈহিক কামনা থেকে বিরত রেখে আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনের পথ।
১১. সহিষ্ণুতা (Tolerance)
প্রাচ্য নীতিবিদ্যায় সহিষ্ণুতার গুরুত্ব অপরিসীম। এটা অন্যের মতামত, বিশ্বাস, ও ধর্মকে সম্মান এবং গ্রহণ করার ধারণা। এটি শান্তি ও সম্প্রীতির সৃষ্টির জন্য অপরিহার্য।
১২. সামাজিক দায়িত্ব (Social Responsibility)
প্রাচ্য চিন্তায় সামাজিক দায়িত্বকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। একে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত উন্নতির পথ হিসেবে দেখা হয় না, বরং সমাজের কল্যাণেও এই নীতিগুলির প্রয়োগ প্রয়োজন।
১৩. প্রাকৃতিক ভারসাম্য (Natural Balance)
প্রাচ্য নীতিবিদ্যায় প্রকৃতির সাথে ম harmony থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি বিশ্বাস করে যে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে, এবং মানুষের জীবনধারা প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত।
১৪. শান্তি (Peace)
শান্তির দিকে অগ্রসর হওয়া প্রাচ্য নীতিবিদ্যার অন্যতম লক্ষ্য। এটি শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক শান্তির প্রেক্ষাপটে, যা সমগ্র মানবজাতির জন্য কল্যাণকর।
১৫. প্রত্যাহার (Renunciation)
প্রাচ্য নীতিবিদ্যায় জীবনের অস্থায়ী আনন্দ এবং ভোগ-বিলাস থেকে মুক্তি লাভের পক্ষে প্রত্যাহারের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটি জীবনের আসল উদ্দেশ্য অন্বেষণ করার জন্য আবশ্যক।
১৬. বিশ্বাস ও অন্তর্দৃষ্টি (Faith and Intuition)
প্রাচ্য চিন্তায় যুক্তির পাশাপাশি বিশ্বাস এবং অন্তর্দৃষ্টির গুরুত্বও রয়েছে। এটি বিশ্বাস করে যে, অতিরিক্ত যুক্তি দিয়ে সবকিছু বুঝা সম্ভব নয়, কিছু কিছু জ্ঞান অন্তর্দৃষ্টি এবং আধ্যাত্মিক উপলব্ধির মাধ্যমে আসে।
১৭. আধ্যাত্মিক উন্নতি (Spiritual Progress)
প্রাচ্য নীতিবিদ্যার মূল লক্ষ্য হল আধ্যাত্মিক উন্নতি। এটি বিশ্বাস করে যে, একজন ব্যক্তি যখন আধ্যাত্মিকভাবে পরিপূর্ণ হয়, তখন তার সমস্ত দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে যায় এবং সে শাশ্বত শান্তির অভিজ্ঞতা লাভ করে।
১৮. পুনর্জন্ম (Reincarnation)
প্রাচ্য চিন্তাধারায় পুনর্জন্মের ধারণা বিশেষভাবে প্রতিস্থাপিত। এটি বিশ্বাস করে যে, মানুষ একাধিক জন্মের মাধ্যমে আত্মার উন্নতি সাধন করে এবং শেষে একদিন মুক্তি লাভ করে।
১৯. তত্ত্ব ও বাস্তবতার ঐক্য (Unity of Theory and Practice)
প্রাচ্য নীতিবিদ্যায় তত্ত্ব এবং বাস্তবতার মধ্যে কোন ফাঁক নেই। জীবনযাত্রা এবং দর্শন একে অপরকে পরিপূরক। এটি জীবনকে তত্ত্বের আলোকে পরিচালনা করার ওপর জোর দেয়।
২০. অন্তর্দৃষ্টি (Inner Wisdom)
প্রাচ্য নীতিবিদ্যায় অন্তর্দৃষ্টির উপর খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়। একে ‘অন্তঃপ্রজ্ঞা’ বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান হিসেবে দেখা হয়, যা মানুষের ভিতরের গভীর বোধ ও উপলব্ধির মাধ্যমে অর্জিত হয়।
প্রাচ্যের নীতিবিদ্যা একটি গভীর এবং সমৃদ্ধ চিন্তাধারা, যা মানব জীবনের আধ্যাত্মিক উন্নতির পাশাপাশি সমাজের কল্যাণে বিশাল ভূমিকা পালন করে। অহিংসা, ধর্ম, মোক্ষ, Karma, এবং ব্রাহ্মের মতো মৌলিক ধারণাগুলি প্রাচ্যের নীতিবিদ্যাকে একটি প্রজ্ঞাময় এবং শান্তিপূর্ণ জীবনের দিকে পরিচালিত করে। মানবতার উন্নতির জন্য এই নীতিগুলির প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি।