“দর্শনের জনক বলে খ্যাত থেলিস প্রাচীন গ্রিসের আয়নীয় দ্বীপের মাইলেটাস নগরের অধিবাসী। তিনি আনুমানিক ৬২৪ খ্রিস্টপূর্ব সালে জন্মগ্রহণ করেন।” এরিস্টেটল ও তার পূর্ববর্তী গ্রিক দার্শমিক ঐতিহ্য সম্পর্কে যে সকল বর্ণনা প্রদান করেছেন থেলিস সম্পর্কে জানার সেটি আমাদের প্রধান উৎস। তার সম্পর্কে জানা যায়, “তিনি জগত ও জীবনে নানা বিষয় নিয়ে ভাবতেন। প্রচলিত সংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বদলে তিনি যুক্তিযুক্ত বিশ্বতাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জনের প্রচেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। জগতের উৎপত্তি বিষয়ে তিনি একটি মতবাদ প্রদান করেন এই মতবাদটি পানি তত্ত্ব বলে পরিচিত লাভ করে।”জ্যোতিবিদ্যা ও জ্যামিতিতে তিনি বিশেষ পারদর্শী ছিলেন বলে জানা যায়। একটি সূর্য গ্রহণ সম্পর্কে তিনি নাকি সঠিক ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। এই সূর্যগ্রহণ ৫৮৫ খ্রিস্টপূর্ব সালে হয়েছিল। মিশরীয় সভ্যতার কিছু ভালো দিক সম্পর্কে তিনি জ্ঞান লাভ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। “জ্যামিতি সম্পর্কে অনেক জ্ঞান তিনি মিশরীয়দের কাছ থেকে লাভ করেছিলেন বলে মনে করা হয় । ব্যাবলিলিওনের নিকট থেকে তিনি জ্যোতিবিদ্যা শিখেছিলেন বলেও শোনা যায়। মিশরে অবস্থানকালে তিনি পিরামিড নিয়ে গবেষণা করেছিলেন বলে জানা যায়। তিনি সমুদ্রের তীরের দুটি বিন্দু থেকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সমুদ্রের ভাসমান জাহাজের দূরত্ব কিভাবে নির্ণয় করতে হয় তা জেনেছিলেন” তৎকালীন গ্রিসের সাতজন জ্ঞানী ব্যক্তির মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। অবশ্য সাতজন ঐতিহাসিক সুনিদিষ্ট কোন ব্যক্তিবর্গ নয়। এদের নিয়ে লেখক বিভিন্ন রকম বর্ণনা দিয়েছেন। বিভিন্ন তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল কিন্তু সব তালিকাতেই থেলিস নামক ব্যক্তির অবস্থান ছিল। “চাঁদ ও সূর্যের অবস্থান পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কিভাবে ঋতু পরিবর্তনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি করা যাবে সেসব বিষয়ে তার যথেষ্ট জ্ঞান ছিল” তার দর্শনকে প্রধানত দুটি উক্তির মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়। “প্রথমত পানি হচ্ছে জগতের আদি উপাদান। আর দ্বিতীয়ত পৃথিবী হচ্ছে একটি চ্যাপ্টা থালার মত যা পানির উপর ভাসমান, এ উক্তি দুটির প্রথম টি মূলত দার্শনিক উক্তি” এই উক্তির মাধ্যমে তিনি দেখাতে চান যে জগতের সকল বস্তুগত দ্রব্যের মূলে রয়েছে একক বস্তু সত্তা। এই একক বস্তু সত্তা হল পানি। পানি জগতের আদি কারণ। সবকিছু পানি দ্বারা সৃষ্ট। এবং পানিরই এগুলো বিভিন্ন প্রকার মাত্র। পানি বিবর্তিত হয়ে জগতের সব কিছু সৃষ্টি হয়। জগতের পরিবর্তন মানে তাই পানির বিভিন্ন অবস্থার পরিবর্তন। কেবল পানি দ্বারা সবকিছু সৃষ্ট হয় তাই নয়; থেলিসের মতে “পানিতে সবকিছু বিলীন হয়ে যাবে। কোন বস্তু ধ্বংসের মাধ্যমে তার চূড়ান্ত পরিণতিও পানি হবে” “সম্ভবত সকল বস্তুর জলীয় অংশ রয়েছে দেখে থেলিস মনে করতে পারেন যে পানি জগতের আদি উপাদান। তা ছাড়া পানি প্রাণী জগতকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। পানি ছাড়া কোন জীবের উদ্ভব হয় না। এটা প্রমাণ করে যে পানি থেকে সবকিছুর উৎপত্তি হতে পারে”
থেলিসের পানি তত্ত্ব সম্পর্কে আমরা যা জানি তা অতি সামান্য। বার্ট্রন্ড রাসেল এ সম্পর্কে বলেছেন “দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে দর্শনের ইতিহাস জানতে আগ্রহী কোন প্রাথমিক শিক্ষার্থীর নিকট এ বিষয়টি নিরাশার সৃষ্টি করতে পারে” সকল পদার্থের মধ্যে পানি বিভিন্ন রূপে ধারণ করতে পারে সহজে। অর্থাৎ পদার্থের যে তিনটি অবস্থা
- কঠিন
- তরল
- বায়বীয়
পানি খুব তাড়াতাড়ি এগুলে ধারণ করতে পারে। পানি বরফ হলে কঠিন, উত্তপ্ত হলে বায়বীয়ভাগ। আর সহজ অবস্থা হলো তরল অবস্থা। তিনি মনে করতেন সব বস্তুর মধ্যে আত্মা বা প্রাণ আছে। আর ঈশ্বরের জগতের আত্মা। আর সকল বস্তুর মধ্যে ঈশ্বর আছেন। যেহেতু তিনি পানিকেই জগতের আদি উপাদান বলেছেন। সেদিক থেকে তিনি জড়বাদী। সব বস্তুর মধ্যে পানিরূপে আত্মা রয়েছে। এদিক থেকে তিনি সজীব জড়বাদী। থেলিস পানি তত্ত্ব প্রথমত তিনি বিশ্বতত্ব নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার পানিতত্ত্ব জগত সম্পর্কিত, জগতের প্রকৃতি, উৎপত্তি, গতিপ্রণীতি ও গঠনমূলক দার্শনিক ভাবনা তার চিন্তার মূল বিষয়। জগতের অন্তরালে কোন আদি সত্তা রয়েছে থেলিসের দর্শনের তা সুস্পষ্ট প্রমান ঘটে। তিনি দেখাতে চেষ্টা করেন জগতের সবকিছু কোন না কোন উৎসের দারা উৎপত্তি লাভ করেছে আর সেই সত্তাটাই হলো আদি কারণ। তিনি একজন একত্ববাদী। জগতের উৎপত্তির আদি কারণ হিসেবে যে ধারণা দিয়েছিলেন তার সংখ্যা একটি। তা হল পানি। পানির সাথে অন্য কিছুকে তিনি যোগ করেননি বা একাত্মা বলে ঘোষণা করেনি। পানি একমাত্র আদি কারণ। এজন্য তিনি একত্ববাদী। থেলিস তার পানি দর্শনের জন্য জড়বাদী। জগতের আদি হিসেবে তিনি পানিকে চিহ্নিত করেছেন।তাই তিনি জড়বাদী। “ আবার তিনি পানিতে আত্মা, ঈশ্বরের অবস্থান এগুলো বলেছেন। তখন তার পানিকে আর সাধারণ পানি বলা যায় না। সে দিক থেকে এ পানি হল আধ্যাত্মিক প্রকৃতির। এদিক থেকে তিনি ভাববাদী ও বলা চলে”
থেলিসকে সজীব জড়বাদীও বলা চলে। কেননা তিনি মনে করতেন “জড়-অজড় সকল পদার্থের মধ্যে প্রাণ হিসেবে পানি রয়েছে। পানির মাধ্যমে সকল বস্তু তার আত্মার জীবনীশক্তি ফিরে পায়। ঈশ্বরের পানি হতে সকল বস্তু সৃষ্টি করেন। এমন ধারণা থেকে থাকে তাই তাকে সজীব জড়বাদী দিয়ে বলা চলে” সত্তাতত্ত্বিক মতবাদ হিসেবে জড়বাদী। তিনি বলেছেন ঈশ্বর পরম আধ্যাত্মিক সত্তা। পানির মধ্যে তিনি কোন শক্তি বা স্পিড প্রদান করেছেন বলে পানি দিয়ে সবকিছু সৃষ্টি করা যায়। এক্ষেত্রে পরম ঈশ্বরই হলো জড়ের স্রষ্টা।
থেলিস এর পানি তত্ত্বের গুরুত্ব:
তাই প্রথম দার্শনিক হিসেবে তার গুরুত্ব অপরিসীম। তৎকালীন যুগের বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক, কুসংস্কারক এবং কবি সাহিত্যিক যুক্তিহীন রূপক উপখ্যানের বদলে যুক্তি প্রমাণের নিরিখে জগত নিয়ে গবেষণা করার প্রাথমিক উদ্যোক্তা তিনি। W.T stace এর ভাষায়”The significance of Thelis is not that his watwr philosophy has any value in itself,but that was the first recorder attempt to explain the universe on naturalistics and scientific principles without the aid of myths qnd anthromorphic gods” থেলিসের বিজ্ঞান ও দর্শন ছিল অপরিপক্ক। কিন্তু তা আমাদের চিন্তাও পর্যবেক্ষণ কে উদ্দীপ্ত করতে সমর্থ্য ছিল।
থেলিসকে যে কারণে দর্শনের জনক বলা হয়:
কোন বিষয়ে জনক হতে হলে কি কি যোগ্যতা বা কর্ম করতে হয় তার কোন মাপ, যোগ ও বিধি-বিধান নেই। তবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যেসব দৃষ্টিভঙ্গিতে কাউকে কোন কিছু জনক বলে বিবেচনা করা হয়। তার প্রধান তিনটি বিষয় হলো,
- কোন বিষয়ের প্রাথমিক উদ্যোক্ত হলে তাকে ওই বিষয়ের জনক বলা চলে।
- কোন বিষয়ের প্রাথমিক উদ্যোক্ত হোক বা না হোক ওই বিষয়ে স্বতন্ত্র একটি বিষয় হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য প্রাথমিকভাবে যিনি ভূমিকা পালন করেন তাকে জনক বলা হয়।
- তৃতীয়ত কোনো বিষয়ের অগ্রগতিতে যদি কারো এমন ভূমিকা থাকে যে তাকে অনুসরণ করেই ঐ বিষয়টি একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে হিসেবে পরিচিত হয়েছে বা প্রগতি লাভ করেছে তখন তাকে ওই বিষয়ের জনক বলা যেতে পারে।
উপরোক্ত তিনটি বৈশিষ্ট্যই থেলিসের ক্ষেত্রে
প্রযোজ্য। তাই থেলিসকেই দর্শনের জনক বলা হয়। কারণ তিনি প্রথমও দার্শনিক।স্বাধীনভাবে জগতের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদ দিয়েছেন। জগতের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি কোন প্রকার সংস্কারে আশ্রয় নেন নি। তিনি ছিলেন সর্বপ্রকার অথোরিটি মুক্ত একজন স্বাধীন চিন্তাবিদ। তাই তাকে প্রাথমিক উদ্যোক্তা বলা চলে। দর্শনকে স্বতন্ত্র একটি বিদ্যা হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাই এসব দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে দর্শনের জনক বলা হয়।