নাগরিক সাংবাদিকতার উত্থান: সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ

সাংবাদিকতা এক সময় ছিল একটি বিশেষ পেশা, যেখানে কিছু নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাদার সাংবাদিকেরা সংবাদ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ এবং পরিবেশন করতেন। তবে প্রযুক্তির বিকাশ এবং ইন্টারনেটের প্রভাবের ফলে সাংবাদিকতা একটি ব্যাপক পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়েছে। এই পরিবর্তনের অন্যতম বড় দিক হলো নাগরিক সাংবাদিকতার উত্থান। নাগরিক সাংবাদিকতা এমন একটি ধারণা যেখানে সাধারণ জনগণ, যাদের সাংবাদিকতার পেশাগত প্রশিক্ষণ নেই, তারা নিজেরাই খবর সংগ্রহ, তৈরি এবং বিতরণ করতে সক্ষম হচ্ছে।

আজকের ডিজিটাল যুগে, প্রায় প্রতিটি মানুষের হাতে একটি স্মার্টফোন থাকে, যার মাধ্যমে তারা যে কোন ঘটনার ছবি, ভিডিও, টেক্সট অথবা মন্তব্য দ্রুত শেয়ার করতে পারে। সামাজিক মিডিয়া যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, স্ন্যাপচ্যাট এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলি নাগরিক সাংবাদিকতার জন্য এক বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনার রিপোর্টিং করতে পারে এবং সেই তথ্য বিশ্বের যে কোন প্রান্তে দ্রুত পৌঁছাতে পারে। নাগরিক সাংবাদিকতা শুধু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্যই নয়, বরং অনেক সময় এটি বৃহৎ সামাজিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনকেও সহায়তা করে থাকে। তবে, নাগরিক সাংবাদিকতার এই উত্তরণের সাথে কিছু চ্যালেঞ্জও তৈরি হয়েছে।

নাগরিক সাংবাদিকতার একটি উদাহরণ হিসেবে ২০১১ সালের আরব বসন্ত আন্দোলনকে ধরা যেতে পারে। ওই সময় মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে জনগণের বিক্ষোভ, প্রতিবাদ এবং বিদ্রোহের ঘটনা ঘটছিল। এই সময়, সামাজিক মিডিয়া এবং নাগরিক সাংবাদিকতার মাধ্যমে এই আন্দোলনের খবর বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে, প্রাথমিকভাবে স্থানীয় মানুষ, যারা সরাসরি প্রতিবাদী কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছিলেন, তারা সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে ছবি এবং ভিডিও শেয়ার করেছিলেন, যা গণমাধ্যমের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক স্তরে ছড়িয়ে পড়ে। সাংবাদিকরা সম্ভবত ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগে, নাগরিক সাংবাদিকরা সেই ঘটনার প্রমাণ তুলে ধরেছিলেন। এটি শুধু আন্দোলনকে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি দিয়েছিল, বরং সরকারের দমন-পীড়ন এবং জনগণের প্রতিবাদের মুখে জনগণের দাবি তুলে ধরেছিল।

নাগরিক সাংবাদিকতার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো ২০১৪ সালে ভারতের দিল্লি গ্যাং রেপের ঘটনা। এই ঘটনা অত্যন্ত বিপুলভাবে গণমাধ্যমে আলোচিত হয়েছিল, কিন্তু তখন নাগরিক সাংবাদিকদের মাধ্যমে সামাজিক মিডিয়ায় প্রচুর তথ্য এবং প্রতিবেদন শেয়ার করা হয়েছিল। বিভিন্ন ব্লগ, টুইটার পোস্ট, ফেসবুক স্ট্যাটাস এবং ভিডিওর মাধ্যমে, নেটিজেনরা তাদের মতামত প্রকাশ করছিলেন এবং এই ঘটনা সম্পর্কে এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তথ্য দিচ্ছিলেন। এটি একদিকে যেমন গণমাধ্যমের গতি এবং সঠিক তথ্য পৌঁছানোর ক্ষমতা বাড়িয়েছে, তেমনি নাগরিকদের সংবাদ পরিবেশন এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

তবে, নাগরিক সাংবাদিকতার পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে, যেগুলি এই ক্ষেত্রটির কার্যকারিতা এবং সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়। প্রথমত, এটি একটি অপ্রশিক্ষিত ক্ষেত্র, এবং এর ফলে তথ্যের সঠিকতা এবং নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হতে পারে। অনেক সময় ফেক নিউজ, গুজব এবং অর্ধসত্য তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যা জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ সালে ভারতের একটি রাজ্যে সামাজিক মিডিয়ায় একাধিক ভুয়া ভিডিও এবং ছবি ছড়িয়ে পড়ে, যার মধ্যে দাবি করা হয়েছিল যে সেখানে ধর্মীয় সংঘর্ষ ঘটেছে। যদিও পরবর্তীতে এটি প্রমাণিত হয়েছিল যে এসব তথ্য ছিল ভিত্তিহীন, তবুও এটি স্থানীয় জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছিল।

দ্বিতীয়ত, নাগরিক সাংবাদিকতা কোনো পেশাদার সাংবাদিকতার প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করে না, যার ফলে অনেক সময় রিপোর্ট করা তথ্য বা ঘটনা পেশাদারিত্বের অভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থক যদি কোনো ঘটনার ওপর নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন, তবে সে তথ্যটি নিরপেক্ষ বা নির্ভরযোগ্য নাও হতে পারে। এটি গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতা এবং পেশাদারিত্বের মানদণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।

তৃতীয়ত, সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে তথ্য শেয়ার করা, কখনও কখনও ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর নিরাপত্তার জন্য হুমকির কারণ হতে পারে। অনেক সময় নাগরিক সাংবাদিকরা সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে নিজের জীবনের ঝুঁকি নেন। ২০১৭ সালে মাল্টার অনুসন্ধানী সাংবাদিক ড্যাফনি কারুয়ানা গ্যালিজিয়ার হত্যাকাণ্ড উদাহরণ হিসেবে টানা যেতে পারে। তিনি সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করছিলেন এবং তার মৃত্যু সাংবাদিকতার স্বাধীনতা এবং নাগরিক সাংবাদিকতার ওপর ঝুঁকির বিষয়টিকে তুলে ধরে।

তবে, এই চ্যালেঞ্জগুলির মাঝেও নাগরিক সাংবাদিকতার সুফল অনেক রয়েছে। প্রথমত, এটি গণতন্ত্রের মুল ভিত্তি “জনগণের কণ্ঠস্বর” হিসেবে কাজ করে। যখন কোনো ঘটনার রিপোর্টিং একটি পেশাদার সাংবাদিকের মাধ্যমে হয়, তখন তার প্রতিবেদনে মূলত পূর্বনির্ধারিত দৃষ্টিকোণ থাকতে পারে। কিন্তু নাগরিক সাংবাদিকতা বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভিজ্ঞতাকে সম্মান প্রদর্শন করে এবং একাধিক প্রেক্ষাপট থেকে ঘটনাগুলি তুলে ধরে। এটি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কণ্ঠস্বর নিশ্চিত করে।

দ্বিতীয়ত, নাগরিক সাংবাদিকতার মাধ্যমে বিভিন্ন মহলের সমস্যা এবং বিষয় সামনে আসে, যা প্রথাগত সাংবাদিকতা মাঝেমধ্যে আড়াল করে ফেলে। এক্ষেত্রে, গণমাধ্যমের দিকে আগ্রহী না হওয়া মানুষ বা কম গুরুত্ব পাওয়া ইস্যুগুলি সামনে আসে, এবং সমাজে সমান সুযোগ পাওয়ার অধিকার গড়ে ওঠে।

অতএব, নাগরিক সাংবাদিকতা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এক শক্তিশালী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। যদিও এর সঙ্গে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবুও এর সুযোগ এবং উপকারিতা অনেক বেশি। যদি এটি সঠিকভাবে পরিচালিত হয় এবং ফেক নিউজ ও পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তবে নাগরিক সাংবাদিকতা গণতন্ত্র এবং সামাজিক অগ্রগতির একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *