প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে সাংবাদিকতার ধরন এবং তথ্যের বিস্তারেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এক সময় যেখানে পত্রিকা, রেডিও, এবং টেলিভিশন ছিল সংবাদ প্রচারের একমাত্র মাধ্যম, আজকের দিনে সামাজিক মাধ্যম তার শক্তিশালী উপস্থিতি তৈরি করেছে। সামাজিক মাধ্যম যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব এবং লিঙ্কডইন, আজ সাংবাদিকতার ধারাকে আমূল পরিবর্তন করেছে। এটি শুধুমাত্র তথ্য ছড়ানোর পদ্ধতিতেই পরিবর্তন আনে নি, বরং সাংবাদিকতার নৈতিকতা, বিশ্বাসযোগ্যতা, এবং এর সমাজে ভূমিকা সম্পর্কে নতুন প্রশ্ন তুলেছে। সামাজিক মাধ্যমের উত্থান সাংবাদিকতার পুরোনো কাঠামোকে বিপর্যস্ত করেছে এবং তার সাথে বহুলাংশে সাংবাদিকতার কার্যক্রমকে আরো গতিশীল এবং বহুমুখী করেছে।
প্রথমত, সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে খবরের দ্রুত বিস্তার সাংবাদিকতার দ্রুতগতির পরিবর্তনকে সম্ভব করে তুলেছে। এক সময় যে সংবাদ প্রচার হতে দিন, সপ্তাহ কিংবা মাসের পর মাস সময় নিতো, তা এখন মুহূর্তে বিস্তৃত হয়। একদিকে এটি খবরের সরবরাহের গতি বৃদ্ধি করেছে, অন্যদিকে সংবাদ পরিবেশকদের জন্য এটি একটি নতুন চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি করেছে। যেমন ২০১১ সালে তিউনিসিয়ায় আরব বসন্তের আন্দোলন এবং ২০১৪ সালের ফার্গুসন দাঙ্গার সময় সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যে ছবি এবং ভিডিওগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল, তা ঐতিহ্যবাহী গণমাধ্যমগুলোর চেয়ে অনেক আগে খবর পৌঁছাতে সাহায্য করেছিল।
সামাজিক মাধ্যমের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হলো সিটিজেন জার্নালিজম বা নাগরিক সাংবাদিকতার উদ্ভব। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষও সংবাদ সংগ্রহ, সৃষ্টি এবং বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছেন। অতীতে শুধুমাত্র পেশাদার সাংবাদিকরা সংবাদ তৈরি করতেন, কিন্তু এখন সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যে সাধারণ মানুষও গুরুত্বপূর্ণ খবর এবং ঘটনা শেয়ার করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে রানা প্লাজা ধসের ঘটনা যখন ঘটে, তখন সাধারণ মানুষ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ঘটনার ছবি এবং ভিডিও শেয়ার করে পুরো বিশ্বকে খবর দিয়েছিল, অনেক আগে সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই। এতে সাংবাদিকতার ক্ষমতা এবং কার্যকারিতা আরও বিস্তৃত হয়েছে, এবং প্রচলিত সাংবাদিকতাকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে।
তবে সামাজিক মাধ্যমের এই দ্রুতগতি এবং তথ্যের বিস্তার সাংবাদিকতার জন্য কিছু চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি করেছে। যে তথ্যগুলো সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়াচ্ছে, তার মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই সঠিকতা এবং নির্ভুলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। মিথ্যা বা ভুল তথ্য সহজেই ছড়িয়ে পড়ে এবং তা জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। সামাজিক মাধ্যমে এমন অনেক ঘটনা বা তথ্য তুলে ধরা হয় যা অযাচিত এবং ভিত্তিহীন হতে পারে, ফলে পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য তাদের তথ্য যাচাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গি আরও জোরালো হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে ঐতিহ্যবাহী গণমাধ্যমও সামাজিক মাধ্যমের সাথে নিজের অবস্থান ধরে রাখার জন্য বিবিধ কৌশল গ্রহণ করেছে। অনেক পুরনো সংবাদ মাধ্যম এখন সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে সংবাদ পরিবেশন করছে এবং নিজেদের পাঠকগণকে সাইটে আকৃষ্ট করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে ঝুঁকছে। এছাড়াও সংবাদমাধ্যমগুলো এখন একাধিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিজেদের উপস্থিতি শক্তিশালী করতে সক্রিয় হয়েছে, যাতে তারা তাদের দর্শকদের কাছে দ্রুত পৌঁছাতে পারে এবং তাদের ব্যাপ্তি আরও বৃদ্ধি করতে পারে। এটি একই সাথে সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে একটি সঙ্গতিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা যা একদিকে ঐতিহ্যবাহী গণমাধ্যমকে উপকৃত করছে, অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যমের তথ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কিছুটা ভারসাম্যও আনছে।
একটি নজির হিসেবে, বিবিসি এবং নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের সংবাদ প্রচার করছে। তারা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে সরাসরি লাইভ স্ট্রিমিং, ভিডিও শেয়ারিং, নিউজ আপডেট এবং নানান আকর্ষণীয় কন্টেন্ট শেয়ার করে পাঠকদের আকৃষ্ট করে চলেছে। সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে এসব গণমাধ্যম তাদের তরুণ প্রজন্মের পাঠকদের আকর্ষণ করছে, যারা পর tradițional মাধ্যমে কম আগ্রহী। তাছাড়া তারা সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি সরাসরি গণমাধ্যমে আলোচিত বিষয়গুলোর উপর মতামত, আলোচনা এবং প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করছে।
অন্যদিকে, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ঐতিহ্যবাহী গণমাধ্যমের মধ্যে সম্পর্ক কিছু ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক সময় সোশ্যাল মিডিয়া সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নতুন ট্রেন্ড তৈরি করে এবং এই ট্রেন্ডগুলি অনেক দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে, যা ঐতিহ্যবাহী গণমাধ্যমের জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, গত কয়েক বছরে “ভাইরাল নিউজ” বা ভাইরাল কনটেন্টের ধারণা অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কোন খবর যদি দ্রুত ভাইরাল হয়, তবে ঐতিহ্যবাহী সংবাদ মাধ্যমও সে খবরকে নিজেদের নিউজ কভারেজের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।
তবে, সোশ্যাল মিডিয়ার এই দ্রুতগতি কখনও কখনও অপ্রত্যাশিত বা ভুল তথ্যের বিস্তার ঘটাতে পারে। সংবাদ পরিবেশনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় তথ্য যাচাইয়ের কাজ কম করতে পারে, যা পরে বিভ্রান্তি বা অবিশ্বাসের সৃষ্টি করে। এর ফলে, একদিকে সংবাদমাধ্যমের কাজ আরও জটিল হয়ে দাঁড়ায়, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে সংবাদ নির্ভরযোগ্যতার প্রতি সন্দেহও বাড়ে।
এই পরিবর্তনগুলো সাংবাদিকতার ভবিষ্যতের দিকে মনোযোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। পেশাদার সাংবাদিকদের এখন তাদের পুরনো পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ডিজিটাল পরিবেশে দক্ষ হতে হবে। এটি সঠিক, নির্ভুল এবং বৈশ্বিক শ্রোতাদের কাছে সংবাদ পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয়। সঠিক তথ্য যাচাই, নৈতিকতা, এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে যেন সাংবাদিকতা তার কর্তব্য পালন করতে পারে। সামাজিক মাধ্যম এবং ঐতিহ্যবাহী গণমাধ্যমের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে, জনগণের সামনে সঠিক সংবাদ পৌঁছানোর প্রক্রিয়া আরও উন্নত হতে পারে।
অতএব, সামাজিক মাধ্যম এবং ঐতিহ্যবাহী সাংবাদিকতার সম্পর্ক একদিকে যেমন একটি নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, তেমনি এটি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রকে নতুন দিকে উন্মোচিত করেছে। এই যুগের নতুন তথ্য পরিবেশনায় একে অপরের থেকে শেখার অনেক কিছু রয়েছে, এবং দুইটি মাধ্যমই একে অপরকে পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে।