গ্লোবালাইজেশন এবং সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের উপর তার প্রভাব

গ্লোবালাইজেশন একধরনের প্রক্রিয়া, যা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, এবং প্রযুক্তিগত সংযোগ এবং সম্পর্ককে বাড়িয়ে তোলে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, দেশগুলো একে অপরের সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হতে শুরু করে, এবং এর ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্র, যেমন ব্যবসা, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সাংবাদিকতা, একে অপরের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে থাকে। গ্লোবালাইজেশনের কারণে সাংবাদিকতা এবং গণমাধ্যম ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এক সময় যেখানে সংবাদ এবং তথ্য স্থানীয় বা জাতীয় পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা আন্তর্জাতিক পরিসরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এই প্রভাব সাংবাদিকতা এবং গণমাধ্যমের কাঠামো, পদ্ধতি, এবং এর প্রভাবের দিকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসেছে।

গ্লোবালাইজেশনের মাধ্যমে সাংবাদিকতার পরিবর্তন

গ্লোবালাইজেশনের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হলো সংবাদ দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া। আগের যুগে যেখানে সংবাদ পাঠক বা দর্শকরা কেবলমাত্র তাদের দেশীয় বা স্থানীয় সংবাদপত্র, রেডিও বা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে পেতেন, সেখানে এখন ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন দেশ এবং ভাষার সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।

উদাহরণস্বরূপ, ২০০৮ সালে ভারতীয় মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার খবর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে আন্তর্জাতিক সংবাদ চ্যানেলগুলির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। একইভাবে, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম যেমন টুইটার, ফেসবুক, এবং ইউটিউব ব্যবহার করে সাধারণ মানুষও সরাসরি ঘটনার সাক্ষী হতে পারছে এবং সংবাদ পরিবেশন করতে পারছে। এক্ষেত্রে, সাংবাদিকদের পেশাগত সীমাবদ্ধতারও অবসান ঘটেছে, কারণ যে কেউ এখন নিজেকে একজন সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এবং ঘটনার সাক্ষী হওয়ার পর তা প্রকাশ করতে পারে।

গ্লোবালাইজেশনের মাধ্যমে সাংবাদিকতার পেশাগত কাঠামো

গ্লোবালাইজেশন সাংবাদিকতার পেশাগত কাঠামোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের বিস্তার, আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলির বিস্তার এবং একাধিক ভাষার মাধ্যমে সংবাদ পরিবেশন, এসব কিছুই সাংবাদিকতা পেশাকে একটি আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণে উন্নীত করেছে। যেমন, বিশ্বজুড়ে সংবাদ সংস্থাগুলি যেমন বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরা, এবং রয়টার্স এখন আন্তর্জাতিক ঘটনাগুলির কাভারেজ দিয়ে থাকে, যেটি একসময় শুধুমাত্র জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে সীমাবদ্ধ ছিল।

এছাড়া, সাংবাদিকরা এখন বিভিন্ন দেশের সংবাদ পরিবেশন করতে পারে এবং বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো সম্পর্কে বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে রিপোর্ট করতে পারে। আন্তর্জাতিক সংবাদে এখন বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে জাতিগত, ধর্মীয়, এবং সাংস্কৃতিক সংহতির উপর, এবং এতে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সমাজের জন্য গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এই পরিবর্তন সাংবাদিকদের জন্য একদিকে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, তবে অন্যদিকে এটি তাদের আরও বৃহত্তর, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সংবাদ পরিবেশন করার সুযোগ দিয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়া এবং গ্লোবালাইজেশন

গ্লোবালাইজেশন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার উত্থান একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। সোশ্যাল মিডিয়া যেমন টুইটার, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং ইউটিউব সাংবাদিকতার একটি নতুন দিক উন্মোচন করেছে। একসময় যে সমস্ত খবর শুধুমাত্র সংবাদপত্র বা টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে প্রচারিত হতো, এখন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তা সরাসরি বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে যখন কোনও ঘটনা ঘটে, তখন তা মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়, যা আরও বৃহত্তর জনগণের কাছে পৌঁছে যায়।

২০১১ সালের আরব বসন্তের ঘটনা এই ধরনের উদাহরণের মধ্যে একটি। এই সময়ে, আরব বিশ্বে চলমান প্রতিবাদ এবং বিপ্লবের সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। যেখানে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলি এ ধরনের ঘটনাগুলিকে বা সেগুলোর রিপোর্টিংয়ে ব্যর্থ ছিল, সেখানে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারকারীরা নিজেরাই সরাসরি সংবাদ তৈরি ও শেয়ার করতে সক্ষম হয়েছিল। এটি একটি বড় পরিবর্তন, যা গ্লোবালাইজেশনের ফলে এসেছে এবং সাংবাদিকতার পদ্ধতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

গ্লোবালাইজেশনের সাংবাদিকতার উপর প্রভাব: ইতিবাচক এবং নেতিবাচক

গ্লোবালাইজেশনের ফলে সাংবাদিকতার বেশ কিছু ইতিবাচক এবং নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ইতিবাচক দিকগুলির মধ্যে, প্রথমত, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়ার কারণে, বিশ্বব্যাপী মানুষ তাদের চারপাশের ঘটনা সম্পর্কে অবগত থাকতে পারছে। সংবাদ পরিবেশন ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা যেমন মানবাধিকার লঙ্ঘন, পরিবেশগত সংকট, যুদ্ধ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, গ্লোবালাইজেশনের কারণে সাংবাদিকদের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে আন্তর্জাতিক ঘটনার প্রতি নজর দিতে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে সোজা সোজা খবর প্রেরণ করতে। তৃতীয়ত, ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া মাধ্যমগুলো সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, যেমন ক্রাউডসোর্সিং, ডিজিটাল রিপোর্টিং, এবং লাইভ টুইটিং।

তবে, গ্লোবালাইজেশন সাংবাদিকতার নেতিবাচক দিকও তৈরি করেছে। যেমন, বড় বড় আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলি এখন স্থানীয় সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলির উপর আধিপত্য বিস্তার করছে, যার ফলে স্থানীয় সংবাদ গুলি পিছিয়ে পড়তে পারে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি অর্থনৈতিক কারণে নির্দিষ্ট এজেন্ডা বা পক্ষের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করতে পারে। এছাড়া, সোশ্যাল মিডিয়াতে মিথ্যা খবরের প্রভাব বেড়ে যাওয়ার কারণে জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। গ্লোবালাইজেশন সাংবাদিকদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে যেন তারা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে খবর তৈরি করে, তবে সেই খবর অনেক সময় সঠিকতা বা বৈচিত্র্যের অভাবে ক্ষতিকর হতে পারে।

কেস স্টাডি: ‘ব্রেক্সিট’ এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা

ব্রেক্সিট বা ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্তে গণমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, বিশেষত যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের সংবাদমাধ্যমগুলি ব্যাপকভাবে ব্রেক্সিট প্রসঙ্গে বিতর্ক তৈরি করেছে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন নিউজ সাইটগুলির মাধ্যমে এই বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের মতামত ছড়িয়েছে, যা একদিকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রকাশ, তবে অন্যদিকে বিভ্রান্তি এবং ভুল ধারণা তৈরি করেছিল। অনেক সংবাদ পোর্টাল এবং ব্যক্তিগত ব্লগগুলো ব্রেক্সিটের প্রভাব এবং তার নেপথ্যে শক্তি সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করেছিল, যা গ্লোবালাইজেশনের নেতিবাচক প্রভাবের একটি উদাহরণ।

উপসংহার

গ্লোবালাইজেশন সাংবাদিকতা এবং গণমাধ্যমে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। যেখানে একদিকে এটি তথ্যের প্রবাহকে ত্বরান্বিত করেছে, অন্যদিকে এটি সংবাদ পরিবেশনের নিরপেক্ষতা, সঠিকতা এবং বৈচিত্র্যকে চ্যালেঞ্জ করেছে। গণমাধ্যমের জন্য এটা নতুন সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। সেই সঙ্গে, জনগণের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছানোর ক্ষেত্রে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে সাংবাদিকদের, যাতে গ্লোবালাইজেশনের এই সময়েও সাংবাদিকতা তার মৌলিক নৈতিকতার উপর অটুট থাকতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *