বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইন্টারনেটের উন্নতির ফলে, তথ্য আদান-প্রদান একেবারে সহজ ও দ্রুত হয়ে গেছে। তবে, এই সুবিধার পাশাপাশি একটি বড় বিপদও তৈরি হয়েছে – তা হলো, ভুয়া সংবাদ এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য। এটি সমাজের নানা স্তরে প্রভাব ফেলছে, যা মানুষের মানসিকতা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, এবং সামাজিক সম্পর্ককে গুরুতরভাবে প্রভাবিত করছে। ভুয়া সংবাদ, অথবা ফেক নিউজ, এমন তথ্য যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা বা ভুলভাবে প্রচার করা হয়, এটি একটি নতুন ধরনের সমস্যা যা আমাদের বর্তমান সমাজে ভয়াবহভাবে বিস্তার লাভ করেছে।
প্রথমত, ভুয়া সংবাদ এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যের প্রভাব সমাজের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপর বিশেষভাবে পড়ছে। নির্বাচনী প্রচারণায় বা রাজনৈতিক বিতর্কে, বিভ্রান্তিকর তথ্যের ব্যবহার বেড়েছে, যা জনগণের রায়কে প্রভাবিত করতে পারে। ২০১৬ সালের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়, ভুয়া খবর এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যের বড় ধরনের বিস্তার হয়েছিল, বিশেষত সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে। একাধিক ভুয়া খবর ছড়ানো হয়েছিল, যা মানুষকে ভুল ধারণায় ফেলে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, হিলারি ক্লিনটনকে নিয়ে যে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছিল, তা জনগণের মনোভাবকে প্রভাবিত করার জন্যই ছিল। কিছু মিডিয়া আউটলেটও এসব ভুয়া খবরকে সমর্থন দেয় এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
দ্বিতীয়ত, ভুয়া সংবাদ সমাজের মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। যখন একটি সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী বা শ্রেণী বিভ্রান্তিকর তথ্য বিশ্বাস করতে শুরু করে, তখন তা তাদের মধ্যে ভুল ধারণা ও সন্দেহ সৃষ্টি করে। এই বিভ্রান্তি ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সমাজের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশে ২০১৩ সালে গুজব ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বেড়ে গিয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া কিছু ভুয়া খবরের কারণে, একাধিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হয়েছিল, যা দেশে শৃঙ্খলা এবং সামাজিক শান্তি ভঙ্গ করেছিল। এর ফলে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক বা সামাজিক অস্থিরতা নয়, এমনকি মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তিতেও গভীরভাবে আঘাত হানে।
তৃতীয়ত, ভুয়া সংবাদ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যেও প্রভাব ফেলতে পারে। বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং ভুয়া খবরের কারণে মানুষ উদ্বিগ্ন এবং আতঙ্কিত হতে পারে। কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে, পৃথিবীজুড়ে ভুয়া খবর এবং গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, যা মানুষের মনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল। কিছু ভুয়া খবর ছিল যেমন, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য কিছু অদ্ভুত পদ্ধতি যেমন ‘করোনা ভ্যাকসিন’ নিয়ে ভুয়া তথ্য বা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত ভুল ধারণা। এর ফলে, কিছু মানুষ অপ্রয়োজনীয়ভাবে ভয় পেয়েছিল, যা তাদের মানসিক শান্তি এবং স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলেছিল। এমনকি, কিছু সময় এমনও হয়েছে যে, মানুষ এই ধরনের ভুয়া তথ্য বিশ্বাস করে খারাপ স্বাস্থ্যসংকটের মধ্যে পড়েছে।
ভুয়া সংবাদ বা গুজব প্রচারের পেছনে কিছু গোপন উদ্দেশ্য থাকে। এটি এক ধরনের রাজনৈতিক, আর্থিক বা সামাজিক ফায়দা অর্জনের কৌশল। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তবে কিছু সংবাদ মাধ্যম বা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম নিজেদের স্বার্থের জন্য মানুষের বিশ্বাস ভাঙতে এবং তাদের মানসিকতা নিয়ন্ত্রণ করতে ভুয়া তথ্য ছড়াতে পারে। যেমন, কিছু মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি অন্যের উপর অপপ্রচার চালাতে পারে। সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে, ক্ষমতাধর গোষ্ঠী বা ব্যক্তি সাধারণ জনগণের মনোভাব নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়।
এছাড়াও, ভুয়া সংবাদ যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বা সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে তা নয়, এটি ব্যবসা এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ক্ষতি করতে পারে। কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোক্তা নিজেদের লাভের জন্য ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দেয়, যেমন নতুন পণ্যের ভালো গুণাবলি বা অতিরিক্ত সস্তায় বিক্রি করার জন্য বিভ্রান্তিকর প্রচার। এই ধরনের ভুয়া তথ্য সাধারণ জনগণকে প্রভাবিত করে, যারা বিশ্বাস করে ভুল পণ্য কিনে ফেলতে পারে, যার ফলে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালে ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়ায় এক ধরনের ভুয়া খবর ছড়িয়ে পড়েছিল যে, একটি প্রখ্যাত কোম্পানির পণ্যগুলো শরীরের জন্য উপকারী, যা পরে বিভ্রান্তি এবং প্রতারণার কারণে অনেক গ্রাহক ক্ষতির শিকার হয়েছিল।
ভুয়া সংবাদ এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকার, মিডিয়া এবং জনগণের সক্রিয় ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সরকারকে অবশ্যই সঠিক আইন প্রণয়ন করতে হবে, যাতে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো যায়। উদাহরণস্বরূপ, অনেক দেশে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তথ্য যাচাই করার জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি এবং সংস্থা তৈরি করা হয়েছে, যা বিভ্রান্তিকর বা ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এছাড়া, জনগণকে সঠিক তথ্য সঠিকভাবে যাচাই করার জন্য উৎসাহিত করা উচিত। মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার স্তরে মিডিয়া সাক্ষরতা শিক্ষা দেয়া, যাতে মানুষ ভুল তথ্য থেকে সতর্ক থাকতে পারে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, অত্যন্ত জরুরি।
ভুয়া সংবাদ এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য শুধু যে সমাজের শৃঙ্খলাকে বিঘ্নিত করে তা নয়, বরং এটি গণতন্ত্র, অর্থনীতি এবং মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই, আমাদের সবাইকে এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে সচেতন এবং সক্রিয় হতে হবে, যাতে সত্য এবং সঠিক তথ্য সবসময় জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারে।