অন-ডিমান্ড বিশ্বে সম্প্রচার সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ

বর্তমান সময়ে, আমরা একটি ডিজিটাল যুগে বাস করছি যেখানে তথ্যের প্রবাহ গতিশীল এবং দ্রুত। টেলিভিশন, রেডিও, এবং অন্যান্য প্রচারমাধ্যমে সংবাদ এবং তথ্য পেতে, এক সময় দর্শকদের নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান দেখতে বাধ্য করা হতো। কিন্তু আজকের প্রযুক্তির যুগে, “অন-ডিমান্ড” পরিষেবা যেমন নেটফ্লিক্স, ইউটিউব, এবং অ্যামাজন প্রাইম, সংবাদ বা বিনোদন পাওয়ার সময়ের উপর কোনো সীমাবদ্ধতা রাখে না। এর ফলে সম্প্রচার সাংবাদিকতার কার্যক্রমে গভীর পরিবর্তন এসেছে, যার প্রভাব পড়ছে পুরো মিডিয়া শিল্পে। আজকের আধুনিক বিশ্বে, যেখানে সবকিছু অন-ডিমান্ড ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে, সম্প্রচার সাংবাদিকতার ভবিষ্যত কী হবে তা ভাবনাযোগ্য এক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অন-ডিমান্ড প্রযুক্তির প্রভাব

অন-ডিমান্ড মিডিয়া বা স্ট্রিমিং পরিষেবাগুলির আবির্ভাব সাংবাদিকতার ভুবনে বিপ্লব ঘটিয়েছে। আগে যেখানে দর্শককে নির্দিষ্ট সময়ে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান বা খবরের সঙ্গী হতে হতো, সেখানে আজকের দিনে ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, হুলু, এবং অ্যামাজন প্রাইমের মতো প্ল্যাটফর্মগুলি দিয়ে, মানুষ তাদের সুবিধামতো সময়ে খবর বা ভিডিও দেখার সুযোগ পায়।

এটি একই সঙ্গে সাংবাদিকতার জন্য একদিকে সুযোগ এবং অন্যদিকে চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। যেখানে দর্শকরা এখন ইচ্ছামতো ভিডিও দেখতে পারেন, সেখানে “লাইভ” সম্প্রচার বা টেলিভিশনে খবরের সময়সূচী অনুসরণ করার আগ্রহ কমে গেছে। এর ফলস্বরূপ, ঐতিহ্যবাহী সম্প্রচার সাংবাদিকতা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাদের শ্রোতাদের ধরে রাখার জন্য আরও নতুন উপায় খুঁজে বের করছে, কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে চ্যালেঞ্জ এবং প্রতিযোগিতার মুখে।

স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের উত্থান এবং গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ

এখনকার দিনে, অনেক মানুষ আর টেলিভিশনের নির্দিষ্ট সময়সূচী অনুসরণ করে খবর দেখে না। তারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে যখন ইচ্ছে, তখনই সংবাদ বা তথ্য খোঁজে। এই পরিবর্তন গণমাধ্যমের জন্য নতুন একটি বাস্তবতা তৈরি করেছে। স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো যেমন ইউটিউব, ভিমিও, এবং নেটফ্লিক্স এগুলি মিডিয়া প্রযোজকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ এখান থেকে দর্শকরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী সংবাদ বা বিনোদন উপভোগ করতে পারে। এর ফলে প্রচার মাধ্যমের ব্যবসায়িক মডেলও বদলে যাচ্ছে।

একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে: নেটফ্লিক্স একটি উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে, যা এখন শুধুমাত্র বিনোদনমূলক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিত নয়, বরং এটি নিউজ কন্টেন্ট, ডকুমেন্টারি এবং বাস্তব জীবনের ঘটনাসমূহের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানও প্রদান করছে। এটি প্রচার সাংবাদিকতার জন্য এক নতুন ধারণা উপস্থাপন করছে। এখন সংবাদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও তাদের স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সংবাদ সরবরাহের পথ খুলে দিতে হবে, যদি তারা তাদের দর্শক ধরে রাখতে চায়।

স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং ইউটিউব

ইউটিউব এবং অন্যান্য সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে সাংবাদিকতাও নতুন এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে জনগণ এখন তাঁদের মতামত প্রকাশ করতে পারে এবং নিজেরাই ঘটনার ভিডিও বা সংবাদ প্রচার করতে পারে। একদিকে এটি জনগণের হাতে সংবাদ উপস্থাপনার ক্ষমতা দিচ্ছে, অন্যদিকে এটি প্রথাগত সাংবাদিকতার অখণ্ডতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

এটি সাংবাদিকতা সম্প্রসারণে সুযোগ তৈরি করেছে, কারণ সাংবাদিকরা সরাসরি সামাজিক মিডিয়া বা ইউটিউবের মাধ্যমে তাঁদের দর্শকদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারছেন। একটি উদাহরণ হিসেবে কমলা হ্যারিসের নির্বাচনী প্রচারণা টানা লাইভ সম্প্রচার এবং অন-ডিমান্ড ভিডিওতে উঠে এসেছে। এখানে সাংবাদিকরা সঙ্গতি রেখে সংবাদটি সরাসরি জনগণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন, যা এক ধরনের নতুন যুগের সাংবাদিকতা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

নতুন প্রযুক্তির প্রভাব: ভিআর, এআই এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স

নতুন প্রযুক্তি যেমন ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর), আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) এবং মেশিন লার্নিং সাংবাদিকতার জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। এই প্রযুক্তিগুলির মাধ্যমে সংবাদপ্রচারের পদ্ধতি আরও দ্রুত, আরও সঠিক এবং আরও গভীর হতে পারে।

এআই এর সাহায্যে সাংবাদিকরা দ্রুত সংবাদ সংগ্রহ এবং প্রক্রিয়া করতে সক্ষম হচ্ছেন। যেমন, আজকাল অনেক নিউজ রুমে এআই টুলস ব্যবহৃত হচ্ছে, যা দ্রুত খবর সংগ্রহ করে এবং সম্পাদনা করে। এর ফলে, প্রতিদিনের সংবাদ সংগ্রহ এবং পরিবেশন সহজতর হচ্ছে।

এছাড়া, ভিআর প্রযুক্তি ব্যবহার করে, একটি নতুন ধরণের সাংবাদিকতা তৈরি করা হচ্ছে যেখানে দর্শকরা ঘটনার মধ্যে প্রবাহিত হতে পারে। যেমন, ২০১৬ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ওপর একটি ভিআর রিপোর্ট তৈরি করা হয়, যেখানে দর্শকরা যুদ্ধক্ষেত্রের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে পারেন, যা সাধারণ প্রচার সাংবাদিকতার সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে এসে একটি সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা প্রদান করেছে।

সংকট এবং উপায়

অবশ্যই, অন-ডিমান্ড বিশ্বে সম্প্রচার সাংবাদিকতা অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। যেমন, প্রচার সাংবাদিকতার প্রতিষ্ঠানগুলো ঐতিহ্যগত সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে তাদের শ্রোতাদের ধরে রাখতে পারছে না। তবুও, এর একটি সমাধান হলো, সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের মিডিয়া কনটেন্ট অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ করতে হবে।

এছাড়া, সাংবাদিকতা শিক্ষার্থীদের নতুন প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে সাংবাদিকতার নতুন ধরনের দক্ষতা অর্জন করতে হবে। তাদের ডিজিটাল সাংবাদিকতা এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত দক্ষতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা অন-ডিমান্ড প্ল্যাটফর্মে সংবাদ সরবরাহে সক্ষম হতে পারে।

উপসংহার

অতএব, ভবিষ্যতে সম্প্রচার সাংবাদিকতা একটি নতুন রূপে পরিণত হবে যেখানে টেলিভিশন এবং রেডিওর পর্দা থেকে বেরিয়ে এসে অন-ডিমান্ড প্ল্যাটফর্মে সংবাদ পরিবেশন করবে। তবে এর জন্য প্রথাগত সাংবাদিকতা পদ্ধতির সাথে নতুন প্রযুক্তি ও প্ল্যাটফর্মের ব্যবহারকে সমন্বিত করতে হবে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পূর্বের মডেলগুলিকে সমালোচনামূলকভাবে পুনর্বিবেচনা করে, অন-ডিমান্ড বিশ্বে সংবাদ সরবরাহের একটি নতুন পথ তৈরি করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *