সংবাদ রিপোর্টিংয়ে সেন্সেশানালিজমের নৈতিকতা

সংবাদ মাধ্যমের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল জনগণকে সঠিক তথ্য প্রদান করা, যাতে তারা তাদের চারপাশের বিশ্বের বাস্তবতা বুঝতে পারে এবং সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে সংবাদ মাধ্যমের বাজারের চাপ এবং বিজ্ঞাপন আয়ের প্রতিযোগিতা প্রায়শই সাংবাদিকদের পক্ষে সঠিক এবং নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন করা কঠিন করে তোলে। এখানে সেন্সেশানালিজমের প্রবণতা দেখা দেয়, যেখানে সংবাদ মাধ্যম অত্যধিক রঙিন বা উত্তেজনাপূর্ণ খবর পরিবেশন করে, যাতে দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়। এই প্রক্রিয়াটি যে শুধু সংবাদ মাধ্যমের বিক্রির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে তা নয়, বরং এটি সমাজের নৈতিক অবস্থা এবং গণমাধ্যমের প্রতি জনগণের আস্থাও হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

সেন্সেশানালিজমের প্রকৃতি এবং its উদাহরণ

সেন্সেশানালিজম শব্দটির মানে হল এমন সংবাদ প্রচার করা যা সঠিকভাবে বা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঘটনা তুলে ধরার বদলে অতিরঞ্জিত বা অত্যধিকভাবে আবেগপ্রবণ করে উপস্থাপন করা হয়। এর লক্ষ্য হল পাঠকের বা দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করা, যা মিডিয়া হাউসের জন্য লাভজনক হতে পারে। যখন কোনো ঘটনা বা খবরকে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করা হয়, তখন সাধারণত এর প্রকৃত পটভূমি, তথ্য এবং বিবরণ চাপিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে এটি একটি ক্ষতিকর, গুজবভিত্তিক ধারণা তৈরি করে।

একটি উদাহরণ হিসেবে, ধরুন ২০০৫ সালের লন্ডন বিস্ফোরণের ঘটনা। সংবাদ মাধ্যমগুলি প্রথম দিকে ব্যাপকভাবে এই ঘটনা নিয়ে সেন্সেশানালিজম প্রদর্শন করে, যার ফলে জনগণের মধ্যে আতঙ্ক এবং ভীতি সৃষ্টি হয়। বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ এবং এর নেপথ্যের ঘটনাগুলি যথাযথভাবে বিশ্লেষণ না করে, মিডিয়া প্রথমে এর সাথে সম্পর্কিত কোনো তথ্য না দিয়ে শুধু ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বা ‘বিশাল বিপদ’ শিরোনাম দিয়েছিল। এতে জনগণের মধ্যে উদ্বেগ এবং ভীতি বাড়ে, যদিও পুরো পরিস্থিতি পরবর্তী সময়ে আরেকভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

সেন্সেশানালিজমের প্রভাব

সেন্সেশানালিজমের সাংবাদিকতার ফলে কিছু নেতিবাচক পরিণতি দেখা দিতে পারে। প্রথমত, এটি জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাস ভেঙে দেয়। যখন কোনো সংবাদ ঘটনাটির প্রকৃত মর্ম বোঝানোর বদলে, শুধুমাত্র উত্তেজনা তৈরি করার জন্য উপস্থাপন করা হয়, তখন সাধারণ জনগণ মনে করে যে তাদের সঙ্গে অসত্য বা বিভ্রান্তিকর তথ্য শেয়ার করা হচ্ছে। এটা তাদের জন্য একটি বিরূপ অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে গণমাধ্যমের প্রতি তাদের আস্থা ক্ষুন্ন হয়।

দ্বিতীয়ত, সেন্সেশানালিজম সমাজে ভুল ধারণা সৃষ্টি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু মিডিয়া হাউস অপরাধমূলক ঘটনা বা রাজনৈতিক দুর্নীতির খবর প্রচার করার সময়, এটি অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করতে পারে যাতে এটি সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। এর ফলে মানুষ অস্থির এবং দুশ্চিন্তায় থাকে, এবং তারা পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভ্রান্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে, মিডিয়া কেবলমাত্র সেই ঘটনার বিকৃত চিত্রই প্রদান করে, যা সঠিক সমাজকাঠামোকে ভেঙে দিতে পারে।

তৃতীয়ত, এটি সমাজে বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোর কারণ হতে পারে। যেসব মিডিয়া হাউস হিংসাত্মক বা জাতিগত সহিংসতার ঘটনা সেন্সেশানালভাবে তুলে ধরে, তাদের প্রচারিত তথ্যের মাধ্যমে তারা সামাজিক বিভাজন তৈরি করতে পারে। অনেক সময়, সমাজের কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব বা আক্রমণাত্মক বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারে, যা পরবর্তীতে সহিংসতা বা জাতিগত সংঘর্ষে পরিণত হতে পারে।

এথিক্যাল প্রশ্নাবলী এবং সেন্টেশনালিজম

এখানে নৈতিকতা বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। যখন মিডিয়া অতিরঞ্জিতভাবে কোনো ঘটনা উপস্থাপন করে, তখন তারা সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করে এবং সেই ঘটনার প্রকৃত মর্মকে আড়াল করে দেয়। এটি সাংবাদিকতার মৌলিক নীতি যেমন ‘সত্য’ এবং ‘ন্যায়’ এর বিরোধী। সাংবাদিকতার প্রধান উদ্দেশ্য হল জনগণকে সত্য সংবাদ প্রদান করা এবং তাদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশে সহায়তা করা, কিন্তু যখন সেন্সেশানালিজম এই উদ্দেশ্যকে ক্ষুণ্ণ করে, তখন তা মিডিয়ার মূল দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হওয়া।

কেস স্টাডি: ১৯৯১ সালে প্রথম যুদ্ধের সময় ‘বর্ণবাদী ছবি’

১৯৯১ সালে প্রথম গোলাবারুদ যুদ্ধের সময়, সংবাদমাধ্যমগুলি মিডিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন খারাপ ছবি, শিরোনাম এবং যুদ্ধের বিশাল স্কেল তুলে ধরেছিল। বিশেষত যুদ্ধে সাংবাদিকরা এমন কিছু ছবি ছড়িয়েছিল যা যুদ্ধের মানবিক দিকগুলির প্রতি বেশি মনোযোগ দিয়েছে, এমনকি যুদ্ধের প্রকৃত কারণ এবং তা কিভাবে বিভিন্ন জাতির রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করছে, তা ব্যাপকভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর ফলস্বরূপ, জনগণের কাছে যুদ্ধের প্রকৃত পরিস্থিতি অনেক ভিন্নভাবে পৌঁছেছিল, যেটি শেষ পর্যন্ত গণমাধ্যমের প্রতি আস্থা হারানোর কারণ হয়েছিল।

মিডিয়ায় সেন্টেশনালিজমের জন্য নৈতিক সমাধান

তবে, সেন্টেশনালিজমের বিরুদ্ধে কিছু সতর্কতা এবং সমাধান রয়েছে। প্রথমত, মিডিয়া হাউসগুলিকে তাদের মূল উদ্দেশ্য—‘সত্য’—প্রতিপালন করতে হবে। একজন সাংবাদিকের কাজ কেবল খবর সংগ্রহ করা নয়, বরং সেটি সঠিকভাবে, নিরপেক্ষভাবে এবং জনস্বার্থে প্রকাশ করা। এটি নিশ্চিত করতে হবে যে সংবাদটি কোনো বিশেষ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক উদ্দেশ্য নিয়ে পরিবেশিত হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, মিডিয়া হাউসগুলিকে আরও বেশি প্রশিক্ষিত সাংবাদিক নিয়োগ করতে হবে, যারা নিজেদের নৈতিকতার প্রতি সজাগ থাকবে এবং সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে তাদের পেশাগত দায়িত্বের প্রতি অনুগত থাকবে।

উপসংহার

সংবাদ মাধ্যমের সেন্সেশানালিজম সত্যিই একটি নৈতিক সমস্যা। এটি তথ্যের মান, সমাজে একে অপরের প্রতি সহানুভূতি এবং জনগণের মনোভাবের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। যেহেতু মিডিয়া সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সেক্ষেত্রে এর নৈতিক দায়িত্ব অবজ্ঞা করা কোনোভাবেই উচিত নয়। মিডিয়ার উচিত সঠিক তথ্য প্রদান এবং জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি তৈরি না করা। সঠিক সংবাদ প্রদান এবং সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণকে সাহায্য করার মাধ্যমে মিডিয়া তার প্রকৃত দায়িত্ব পালন করতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *