আজকের ডিজিটাল যুগে, মিডিয়া আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া, সংবাদ মাধ্যম, ব্লগ, ওয়েবসাইট, টেলিভিশন এবং রেডিও—সবই এখন তথ্য ও যোগাযোগের প্রধান উৎস। তবে, এই তথ্যের প্রাচুর্য এবং সহজলভ্যতা আমাদেরকে একটি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে, যেটি হলো—কীভাবে আমরা এই তথ্যগুলো সঠিকভাবে বিশ্লেষণ, যাচাই এবং বুঝে গ্রহণ করতে পারি? এই চ্যালেঞ্জটি মোকাবিলা করার জন্য ‘মিডিয়া সাক্ষরতা’ বা ‘Media Literacy’ এর গুরুত্ব বাড়ছে, যা শুধু তথ্য গ্রহণের দক্ষতা নয়, বরং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজনীয়তাকেও নিশ্চিত করে।
মিডিয়া সাক্ষরতার মূল ধারণাটি হল, মানুষের মধ্যে এমন ক্ষমতা তৈরি করা, যা তাদের মিডিয়ার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য সঠিকভাবে বিশ্লেষণ, যাচাই এবং প্রাসঙ্গিকতার ভিত্তিতে গ্রহণ করতে সক্ষম করে। আজকাল, তথ্যের প্রবাহ এত দ্রুত এবং ব্যাপক যে, সঠিক এবং ভুল তথ্যের মধ্যে পার্থক্য করতে না পারলে সমাজে বিভ্রান্তি, ভুল ধারণা এবং মিথ্যা প্রচারের সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষত, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ফেক নিউজ বা মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে, যা সমাজে বিভ্রান্তি এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
ডিজিটাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের এমন একটি যুগে নিয়ে এসেছে, যেখানে আমরা সংবাদ, তথ্য, বিনোদন এবং মতামত একসাথে পাই। কিন্তু এটি একটি সমস্যা তৈরি করতে পারে যদি মানুষ সেই তথ্যগুলো যাচাই না করে। ২০১৬ সালে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে মিথ্যা তথ্য এবং বিভ্রান্তিকর খবর ছড়ানো হয়েছিল। ‘ফেক নিউজ’ এর মাধ্যমে ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছিল, যার ফলে নির্বাচনের ফলাফলেও প্রভাব পড়েছিল। এই ঘটনা আমাদের জানিয়ে দেয় যে, ডিজিটাল যুগে শুধু তথ্য পাওয়া নয়, বরং সেই তথ্যের সত্যতা এবং নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এখানে মিডিয়া সাক্ষরতার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিডিয়া সাক্ষরতা মানুষকে এই সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে সাহায্য করে যাতে তারা সহজে বুঝতে পারে, একটি সংবাদ বা একটি তথ্যের উত্স কি, তা কি সত্যি, বা এর পিছনে কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যখন আমরা কোনো সংবাদ পড়ি, তখন তা কেবল বিশ্বাস না করে, আমাদের উচিত তার উত্স, লেখক বা প্রতিষ্ঠানের খ্যাতি, সংবাদটির প্রেক্ষাপট, এবং সম্ভাব্য পক্ষপাতিত্ব বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে চিন্তা করা। এছাড়া, তথ্যের যাচাই করার জন্য আমরা বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য উত্সের সাথে মিলিয়ে দেখতে পারি, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ওই তথ্যটি প্রকৃতপক্ষে সত্য।
এমন একটি উদাহরণ পাওয়া যায় ২০১৭ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বেশ কিছু ছবি এবং ভিডিও ছড়ানো হয়েছিল, যা দাবী করছিল যে, পাকিস্তান সীমান্তে অনুপ্রবেশ করছে এবং ভারতীয় সেনা প্রতিরোধ করছে। বেশ কিছু সময় পর যাচাইয়ের মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়েছিল যে, এটি একটি পুরনো ভিডিও ছিল যা নতুন করে ছড়ানো হয়েছে। যদি মানুষের মধ্যে মিডিয়া সাক্ষরতা না থাকত, তাহলে এই ধরনের মিথ্যা তথ্য তাদের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারত। তবে, যারা মিডিয়া সাক্ষরতা সম্পর্কে সচেতন ছিল তারা এটি সহজেই যাচাই করে ভুল তথ্য থেকে দূরে সরে গিয়েছিল।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে জনগণের মতামত এবং দৃষ্টিভঙ্গি একে অপরকে প্রভাবিত করতে পারে। যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়া একটি উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম, সেখানে কোনো তথ্য বা মতামত কতটা প্রকৃত বা পক্ষপাতিত্বপূর্ণ, তা সহজে বোঝা যায় না। ফলে, একদিকে যেমন এটি ব্যক্তির স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয়, অন্যদিকে, এটি মিথ্যা বা অসত্য তথ্যের প্রসারে সাহায্যও করতে পারে। এজন্য, মিডিয়া সাক্ষরতা একটি বড় ভূমিকা পালন করে—এটি মানুষের মধ্যে এমন মনোভাব তৈরি করে, যা তাদের যেকোনো ধরনের তথ্য বা সংবাদ বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা প্রদান করে।
এছাড়া, মিডিয়া সাক্ষরতা মানুষের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটায়, যা তাদের কেবল তথ্য গ্রহণে নয়, বরং সমাজের নানান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পর্যালোচনা এবং চিন্তা করতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকার, অভিবাসন সমস্যা ইত্যাদি বিষয়গুলি সম্পর্কে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে মিডিয়া সাক্ষরতা অত্যন্ত কার্যকর। যখন মানুষ একটি বিশেষ ইস্যু সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করতে সক্ষম হয়, তখন তারা সামাজিক পরিবর্তনে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে।
আজকের ডিজিটাল যুগে, মিডিয়া সাক্ষরতার গুরুত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনেক দেশ এবং সংস্থা এটি প্রচার করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), ইউনিসেফ এবং বিভিন্ন এনজিও গোষ্ঠী ইতিমধ্যেই ফেক নিউজ এবং মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে। এসব প্রতিষ্ঠান মিডিয়া সাক্ষরতা প্রশিক্ষণ প্রদান করে, যাতে মানুষ ফেক নিউজ চিনতে পারে এবং সেই অনুযায়ী সঠিক তথ্য গ্রহণ করতে পারে।
পরিশেষে, মিডিয়া সাক্ষরতা ডিজিটাল যুগে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি কেবল তথ্য গ্রহণের ক্ষমতা বাড়ায় না, বরং একটি নাগরিকের মনোভাব এবং সমাজের নৈতিকতা উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মানুষের মধ্যে যদি মিডিয়া সাক্ষরতা থাকত, তবে তারা সহজেই বিভ্রান্তিকর তথ্য থেকে বাঁচতে পারত এবং সমাজে সঠিক তথ্যের প্রচার ঘটাতে পারত। এজন্য, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং মিডিয়া সাক্ষরতা প্রবর্তন এবং প্রসারে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, যা আমাদের ডিজিটাল যুগে একটি সুষ্ঠু, সুশৃঙ্খল এবং সচেতন সমাজ গঠনে সহায়ক হবে।