মিডিয়া এবং সাংবাদিকতায় নৈতিক সমস্যা

মাস মিডিয়া ও সাংবাদিকতা এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে তথ্য উপস্থাপন, সংবাদ সংগ্রহ এবং পরিবেশন করা হয় জনগণের সামনে। কিন্তু এই কাজের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন নৈতিক সমস্যা ও প্রশ্ন উঠতে থাকে, কারণ একজন সাংবাদিকের কাজ শুধুমাত্র খবর তুলে ধরা নয়, বরং তা যেন সঠিক, ন্যায্য এবং বৈধ হয়, তাও নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাংবাদিকতা একটি নিরপেক্ষ, সৎ ও নৈতিক কাজ হিসেবে স্বীকৃত, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এখানে অনেক ক্ষেত্রেই সাংবাদিকরা নৈতিক দিক থেকে চাপের মধ্যে পড়ে এবং তাদের পেশাগত শুদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

একটি খুব সাধারণ উদাহরণ হিসেবে, সাংবাদিকরা যখন কন্ট্রোভার্সিয়াল বা সংঘর্ষমূলক খবর সংগ্রহ করেন, তখন তাদের কাছে একাধিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে এবং প্রশ্ন হয়—কি ঠিক, কি ভুল, এবং কিভাবে এই খবরটি জনগণের কাছে পৌঁছানো উচিত? একই সময়ে, ব্যবসায়িক স্বার্থ, রাজনৈতিক চাপ, বা ব্যক্তিগত লাভের তাগিদে সাংবাদিকরা কখনো কখনো তাদের পেশাগত শুদ্ধতার পরিপন্থী আচরণ করতে পারেন। এর ফলে তারা পাঠকদের কাছে ভুল তথ্য পৌঁছে দিতে পারেন, যা দীর্ঘমেয়াদীভাবে গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়ে দেয়।

এই নৈতিক সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো তথ্যের নির্ভুলতা এবং তা যাচাই করা। সাংবাদিকদের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো যে খবর তারা প্রকাশ করছেন তা সঠিক এবং সত্যি কিনা তা যাচাই করা। কিন্তু বর্তমান ডিজিটাল যুগে, যেখানে সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, সাংবাদিকদের কাছে এমন খবর পৌঁছানোর চাপ থাকে যা তারা নির্ভুলভাবে যাচাই করতে পারেন না। ফলে, অনেক সময় মিথ্যা, ভিত্তিহীন বা বিকৃত তথ্য সংবাদ মাধ্যমে পরিবেশন হয়। ২০১৬ সালের নির্বাচনকালীন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে “ফেক নিউজ” বা মিথ্যা খবরের উপস্থাপনা ছিল একটি বড় সমস্যা। এমন অনেক খবর ছিল যা ইচ্ছাকৃতভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রকাশিত হয়েছিল, যা জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল। এ ধরনের খবর সাংবাদিকতার নৈতিকতা ভঙ্গ করে এবং জনমতকে বিভ্রান্ত করে।

একইভাবে, গোপনীয়তা এবং ব্যক্তিগত জীবনের অঙ্গীকারও একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক সমস্যা। সংবাদমাধ্যমের কাজ হচ্ছে জনগণের উদ্দেশ্যে সঠিক তথ্য প্রদান করা, কিন্তু কখনও কখনও সাংবাদিকরা ব্যক্তিগত জীবন বা গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে এমন খবর প্রকাশ করেন, যা তাদের নৈতিক দায়িত্বের পরিপন্থী। উদাহরণস্বরূপ, একজন সেলিব্রিটির ব্যক্তিগত জীবন বা অশালীন ছবির খবর প্রকাশ করার সময় তা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, এবং এটি তার গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করা হয়। যদিও সংবাদপত্র বা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর উদ্দেশ্য কখনোই ক্ষতিকর হওয়া উচিত নয়, তারা প্রায়ই শো-ব্যস বা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ব্যক্তিগত তথ্য এবং ছবি প্রকাশ করে। এতে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ হয়, কিন্তু এটি সমাজে একটি ভুল বার্তা পাঠায়, যা সেই ব্যক্তির মানবাধিকার এবং গোপনীয়তার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করে।

বিষয় নির্বাচনেও নৈতিকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাংবাদিকদের কখনও কখনও প্রয়োজন হয় একটি কাহিনী বা ইস্যু নিয়ে কাজ করার জন্য যা গণমাধ্যমের প্রতি তাদের দায়িত্বকে সমর্থন করে। তবে কখনও কখনও তারা অত্যধিক মনোযোগ প্রদান করতে পারে এমন বিষয়ের প্রতি, যা পাঠকদের মধ্যে আতঙ্ক বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে, তবে এতে তেমন কোন গুরুত্ব নেই। উদাহরণস্বরূপ, কোনো দুর্ঘটনা বা সংঘর্ষের খবর প্রকাশিত হলে, সেটা বাস্তব ঘটনা হলেও কখনও কখনও অতিরঞ্জিতভাবে চিত্রিত করা হয়, যা সমাজে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। এটি আসলে সংবাদপত্রের প্রভাবশালী ভূমিকার অপব্যবহার হতে পারে, যেটি জনগণের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছাতে পারে।

তবে সংবাদমাধ্যমে নৈতিকতার সংকট শুধু তথ্যের সঠিকতা বা গোপনীয়তা লঙ্ঘন করেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বাণিজ্যিক বা রাজনৈতিক আগ্রহের প্রভাবও হতে পারে। সংবাদপত্র বা টেলিভিশন চ্যানেলগুলি কখনও কখনও এমন খবর প্রকাশ করতে পারে যা তাদের নিজস্ব ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক স্বার্থকে সমর্থন করে। বিশেষভাবে নির্বাচনী সময়ে বা রাজনৈতিক অবস্থানে, মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলি রাজনৈতিক পক্ষ বা নেতাদের পক্ষ থেকে একপেশে খবর প্রকাশ করতে পারে, যা গণমাধ্যমের নৈতিকতা ভঙ্গ করে। একটি উদাহরণ হিসেবে, ২০১৯ সালের বাংলাদেশের নির্বাচনকালীন সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলোর মধ্যে কিছু কিছু সংবাদ একপেশে এবং পক্ষপাতিত্বপূর্ণ ছিল, যা জনগণের ন্যায্য মতামত তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এটি গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা সৃষ্টি করে এবং সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়ে দেয়।

তবে, সাংবাদিকদের নৈতিক দায়িত্ব এবং তাদের পেশাগত শুদ্ধতা যে শুধু সংবাদের সঠিকতা বজায় রাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাদের একটি সামাজিক দায়িত্বও রয়েছে। তারা সমাজে উন্নয়নমূলক, নৈতিক এবং ইতিবাচক বার্তা পৌঁছানোর জন্য কাজ করতে পারেন। ১৯৮৪ সালে, মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত একটি সাংবাদিক সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান বলেছিলেন, “গণমাধ্যমের কাজ হচ্ছে সত্য প্রকাশ, সমাজের পক্ষে কাজ করা এবং জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া।” এর মাধ্যমে তিনি সাংবাদিকদের প্রতি তাদের পেশাগত শুদ্ধতা বজায় রাখার এবং নৈতিকভাবে সংবাদ পরিবেশন করার আহ্বান জানিয়েছেন। সংবাদমাধ্যম শুধু খবর দেওয়ার মাধ্যমে নয়, সমাজের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের জন্যও দায়ী।

তবে, গণমাধ্যমে নৈতিকতা নিশ্চিত করতে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রথমত, সাংবাদিকদের জন্য নৈতিক কোড বা গাইডলাইন তৈরি করা উচিত, যাতে তারা তাদের কাজের সময় নৈতিকতা বজায় রাখতে পারেন। দ্বিতীয়ত, সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা প্রদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে তারা জানেন কোন পরিস্থিতিতে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত এবং কোন খবর তারা প্রকাশ করতে পারবেন না। তৃতীয়ত, গণমাধ্যমের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই তাদের সাংবাদিকদের স্বাধীনতা বজায় রাখতে হবে এবং রাজনৈতিক বা বাণিজ্যিক স্বার্থে খবরের সত্যতা বিকৃত করতে বাধ্য করা উচিত নয়।

অতএব, সাংবাদিকতা শুধুমাত্র একটি পেশা নয়, এটি একটি সামাজিক দায়িত্বও। এটি জনমতের নির্মাণে এবং সমাজে ন্যায়বিচারের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গণমাধ্যমের জন্য নৈতিকতার মানদণ্ডকে সমুন্নত রাখা জরুরি, যাতে সঠিক তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারে এবং সমাজে বিভ্রান্তি বা অস্থিরতা সৃষ্টি না হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *