ইসলামের দ্যাভাইন জাস্টিস (ঈশ্বরের ন্যায়বিচার) শিয়া ও সন্নী দৃষ্টিকোণ

ইসলামের অন্যতম মৌলিক ধারণা হলো ঈশ্বরের ন্যায়বিচার, যা মুসলিম সমাজের প্রতিটি স্তরের আদর্শের মধ্যে বিরাজমান। ঈশ্বরের ন্যায়বিচার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যার মাধ্যমে মানুষের প্রতি ঈশ্বরের আচরণ এবং সিদ্ধান্ত বোঝা যায়। ইসলামের শিয়া এবং সন্নী ধর্মমতের মধ্যে এই ন্যায়বিচারের ব্যাখ্যাও কিছুটা ভিন্ন, যদিও মৌলিক মূলনীতি এক। এই নিবন্ধে, আমরা শিয়া এবং সন্নী ধর্মমতের দৃষ্টিকোণ থেকে ঈশ্বরের ন্যায়বিচার নিয়ে আলোচনা করব।

প্রথমে, আমরা শিয়া এবং সন্নী উভয়ের দৃষ্টিকোণ থেকেই ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের মূল বিষয়গুলো তুলে ধরব। ইসলামে ঈশ্বরের ন্যায়বিচার হলো একটি অপরিবর্তনীয় সত্ত্বা, যা কোনো সময়ের পরিবর্তন দ্বারা প্রভাবিত হয় না। এর মানে, ঈশ্বর যা করেন, তা সঠিক ও ন্যায্য, এবং তাঁর সিদ্ধান্তে কোনো ধরনের অন্যায় বা পক্ষপাতিত্ব থাকতে পারে না। শিয়া ও সন্নী উভয় ধর্মমতেই ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের প্রতি এই আস্থা দৃঢ়, তবে তাদের ব্যাখ্যাগুলো কিছুটা আলাদা।

সন্নী দৃষ্টিকোণ

সন্নী মুসলিমরা ঈশ্বরের ন্যায়বিচার সম্পর্কে একটি অতীব বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণ অনুসরণ করেন। সন্নী মুসলিমদের বিশ্বাস অনুযায়ী, ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের মূলনীতি হলো “আল-আদল” বা ন্যায়। সন্নী বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বরের সব সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ ন্যায্য এবং পরিপূর্ণ। একে আধ্যাত্মিক, নৈতিক এবং দৈনন্দিন জীবন বিষয়ক এক অভিন্ন বিধান হিসেবে দেখা হয়। সন্নী মুসলিমদের কাছে ঈশ্বরের ন্যায়বিচার শুধুমাত্র মহাসম্মানিত ও পরিপূর্ণ সত্ত্বার গুণাবলী হিসেবে চিহ্নিত হয় না, বরং এটি মানব জীবন ও সমাজে প্রভাব বিস্তার করে।

সন্নী বিশ্বাসে, ঈশ্বরের ন্যায়বিচার মূলত তাঁর কুরআনের নির্দেশাবলী এবং হাদিসের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। ইসলামী শরিয়া (আইন) মানুষের জীবন পরিচালনার জন্য এই ন্যায়বিচারের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। সন্নী মুসলিমদের কাছে, কোনো একটি নির্দিষ্ট সামাজিক, রাজনৈতিক, বা ধর্মীয় বিষয়ে ঈশ্বরের সিদ্ধান্ত সঠিক এবং ন্যায্য হিসেবে ধরা হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো ব্যক্তির প্রতি অনিয়ম বা অন্যায় হয়, তবে ঈশ্বরের ন্যায়বিচার অনুযায়ী, ওই ব্যক্তি যদি তওবা করে, তবে তিনি ঈশ্বরের করুণার মাধ্যমে মুক্তি পাবেন।

সন্নী মুসলিমদের মতে, ঈশ্বর তাঁর বান্দাদের জন্য সবসময় মঙ্গলকর সিদ্ধান্ত নেন। এতে তারা বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের কোনো প্রকার লঙ্ঘন সম্ভব নয়। তবে সন্নী মুসলিমরা সাধারণভাবে বিশ্বাস করেন যে, ঈশ্বরের এই ন্যায়বিচার মানুষের পক্ষে পূর্ণাঙ্গভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়, কারণ ঈশ্বরের জ্ঞান ও ক্ষমতা অসীম, এবং মানুষের সীমিত বোধে তা ধরার মতো নয়। তবে, মুসলিম হিসেবে তাদের কর্তব্য হচ্ছে ঈশ্বরের আদেশ মেনে চলা এবং তাঁর ন্যায়বিচারের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।

শিয়া দৃষ্টিকোণ

শিয়া মুসলিমরা ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের ব্যাখ্যায় কিছুটা আলাদা দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করেন। শিয়া বিশ্বাস অনুসারে, ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ইমামদের বিশেষ ভূমিকা। শিয়া মুসলিমদের মতে, ঈশ্বর তাঁর ন্যায়বিচারের পূর্ণতা নিশ্চিত করার জন্য তাঁর বাছাইকৃত ইমামদের মাধ্যমে সমাজে নেতৃত্ব প্রদান করেন। এই ইমামরা ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে কাজ করেন এবং ঈশ্বরের আইন ও আদেশের যথার্থ ব্যাখ্যা প্রদান করেন। শিয়াদের কাছে, ঈশ্বরের ন্যায়বিচার শুধুমাত্র মানুষের উপকারে আসার জন্য নয়, বরং ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে ইমামদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়।

শিয়া মুসলিমদের মতে, ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের ভিত্তি শুধুমাত্র মানব সমাজের ন্যায় নয়, বরং এটি মহাবিশ্বের সমগ্র সৃষ্টির দিকে লক্ষ্য রেখে স্থাপিত। ঈশ্বরের সিদ্ধান্তের প্রতি শিয়া মুসলিমদের এক ধরনের আধ্যাত্মিক আবদ্ধতা থাকে। তারা বিশ্বাস করেন যে, ঈশ্বর যখন কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তখন তা মানবের সীমিত বোধের বাইরে চলে যায়। তাই ঈশ্বরের সিদ্ধান্তের সঙ্গে কখনোই আপোস করা উচিত নয় এবং ঈশ্বরের ন্যায়বিচারে কোনো ধরনের সন্দেহ করা অনুচিত।

শিয়া দৃষ্টিকোণ থেকে, ঈশ্বরের ন্যায়বিচার তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে এবং মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম ফলস্বরূপ প্রকাশ পায়। শিয়ারা বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বর মানুষকে তাঁর সৃষ্টি হিসেবে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন, তবে এই স্বাধীনতা ঈশ্বরের ইচ্ছা ও ন্যায়বিচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর মানে হলো, একদিকে মানুষকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু অন্যদিকে তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য ঈশ্বর তাঁর আইন ও ইমামদের মাধ্যমে পথ প্রদর্শন করেন।

ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের সম্পর্ক

যদিও শিয়া এবং সন্নী উভয়ই ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের দিকে গুরুত্ব দেন, তাদের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য হলো, শিয়া মুসলিমরা ঈশ্বরের ন্যায়বিচারকে তাঁর ইমামদের মাধ্যমে প্রকাশিত হিসেবে বোঝেন, যেখানে সন্নী মুসলিমরা ঈশ্বরের সিদ্ধান্তকে কুরআন এবং হাদিসের মাধ্যমে উপলব্ধি করেন। শিয়া বিশ্বাসে, ইমামদের ভূমিকা ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের একটি অপরিহার্য অংশ, যেখানে সন্নী মুসলিমরা ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের ব্যাখ্যায় তেমন কোনো বিশেষ মানবিক প্রতিনিধি ধারণা রাখেন না।

এছাড়াও, শিয়া মুসলিমরা ঈশ্বরের ন্যায়বিচারকে মুলত মানবজাতির মুক্তির পথ হিসেবে চিহ্নিত করেন, যেখানে সন্নী মুসলিমরা ঈশ্বরের ন্যায়বিচারকে ব্যক্তিগত নৈতিকতা ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন। এর ফলে, শিয়া এবং সন্নী দৃষ্টিকোণ থেকে ঈশ্বরের ন্যায়বিচার আলাদা হলেও, দুটোই ইসলামের মূলনীতি ও বিশ্বাসের অংশ হিসেবে গৃহীত হয়।

উপসংহার

ইসলামের ন্যায়বিচার হলো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা শিয়া ও সন্নী মুসলিমদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কেন্দ্রে রয়েছে। শিয়া মুসলিমরা ঈশ্বরের ন্যায়বিচারকে ইমামদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হওয়ার বিষয় হিসেবে দেখেন, যেখানে সন্নী মুসলিমরা ঈশ্বরের ন্যায়বিচারকে কুরআন এবং হাদিসের মাধ্যমে জানেন। তবে, উভয় ক্ষেত্রেই ঈশ্বরের ন্যায়বিচার এক অনস্বীকার্য গুণাবলী হিসেবে চিহ্নিত হয়, যা মানুষের জীবনে এবং সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজনীয়।

উৎস

  • আল-ইমাম: শিয়া ইসলামের মৌলিক ধারণা।
  • কুরআন শরীফ: ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের উপর কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন আয়াত।
  • হাদিসের সংকলন: সন্নী মুসলিমদের ঈশ্বরের ন্যায়বিচার সম্পর্কে বর্ণিত হাদিস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *