ভূমিকা:
জাতিগত এবং বর্ণগত বিভেদ সমাজে একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক বিষয়। মানুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য যেমন ত্বক, চুলের রঙ, এবং অন্যান্য বর্ণগত গুণাবলী বিভিন্ন সমাজে আলাদা আলাদা অর্থ বহন করে। তবে, বর্ণ বা জাতি কেবল শারীরিক বৈশিষ্ট্য নয়, বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে একটি তৈরি করা গঠন। সমাজের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এটি তৈরি হয়, যা ব্যক্তিগত এবং সামাজিক পরিচয়কে প্রভাবিত করে। এই প্রবন্ধে জাতিগত এবং বর্ণগত গঠনের তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার সমাজে প্রভাবগুলো আলোচনা করা হবে।
জাতিগত এবং বর্ণগত গঠনের ধারণা:
জাতিগত বা বর্ণগত গঠন একটি সামাজিক প্রক্রিয়া, যেখানে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলী মানুষের মধ্যে একটি শ্রেণিবদ্ধকরণ তৈরি করে, যা সমাজের সদস্যদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে। এটি কোনো শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে নয়, বরং সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মাপকাঠিতে গড়ে ওঠে। জাতি এবং বর্ণ দুটি মূলত সামাজিক ধারণা, যা বিভিন্ন ইতিহাস এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। ১৯৬০-এর দশকে তাত্ত্বিকরা এই ধারণা সামনে আনেন যে, জাতি এবং বর্ণের বিভাজন একটি সামাজিক নির্মাণ, যা নির্দিষ্ট সময়, স্থান এবং সামাজিক প্রসঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারে।
বর্ণগত এবং জাতিগত গঠনের তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি:
জাতিগত এবং বর্ণগত গঠন সংক্রান্ত কয়েকটি তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো:
১. সামাজিক নির্মাণবাদ:
সামাজিক নির্মাণবাদ বা কনস্ট্রাকটিভিজম এই ধারণা পোষণ করে যে, জাতি এবং বর্ণ সামাজিকভাবে গঠিত ধারণা। অর্থাৎ, এগুলো শারীরিক বৈশিষ্ট্য থেকে উদ্ভূত নয়, বরং মানুষের তৈরি বিশ্বাস এবং সামাজিক শর্তগুলির ফলস্বরূপ। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, কোন এক সময় সমাজে বিশেষ কোনো গুণাবলীকে একটি জাতিগত বা বর্ণগত শ্রেণীর সঙ্গে যুক্ত করা হতে পারে, যা পরে ঐ সমাজে একটি নরমাল এবং গ্রহণযোগ্য ধারণা হয়ে ওঠে।
উদাহরণ: ১৯ শতকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান-আমেরিকানদের সাথে সম্পর্কিত “কৃষক” বা “কোলো” মতো ধারণাগুলি সেগুলি শারীরিক বৈশিষ্ট্য দ্বারা নির্ধারিত হলেও, সমাজের গঠনমূলক বিশ্বাসের ফলে এ ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হয়।
২. মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি:
মার্কসবাদী তত্ত্ব মতে, বর্ণ এবং জাতিগত বিভাজন মূলত অর্থনৈতিক শ্রেণীবিন্যাসের অংশ। এ দৃষ্টিভঙ্গি মতে, ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল শ্রেণী গঠন, যা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামো দ্বারা পরিচালিত, সমাজের মধ্যে জাতিগত এবং বর্ণগত বিভাজন সৃষ্টি করে। পুঁজির মালিকানাধীন শ্রেণী বিভিন্ন জাতি এবং বর্ণের মানুষকে শ্রমশক্তি হিসেবে কাজে লাগায় এবং তাদের বৈষম্যের শিকার করে।
উদাহরণ: ১৯ শতকে পশ্চিমা উপনিবেশবাদী শক্তিগুলি তাদের উপনিবেশিত দেশগুলিতে স্থানীয় জনগণকে শোষণ করার জন্য তাদের জাতিগত এবং বর্ণগত পরিচয় নির্ধারণ করেছিল, যাতে তাদের শ্রমের মূল্য কমানো যায় এবং পুঁজির মালিক শ্রেণী আরও লাভবান হতে পারে।
৩. সিম্বলিক ইন্টারঅ্যাকশনিজম:
সিম্বলিক ইন্টারঅ্যাকশনিজম অনুযায়ী, জাতি এবং বর্ণ একটি অর্থপূর্ণ সামাজিক সম্পর্কের অংশ। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, জাতিগত এবং বর্ণগত পরিচয় নির্ধারিত হয় সামাজিক ইন্টারঅ্যাকশন বা যোগাযোগের মাধ্যমে। মানুষের মধ্যে প্রতিদিনের আচরণ, ভাষা, এবং সামাজিক সমীকরণ জাতি ও বর্ণের ধারণাকে প্রভাবিত করে।
উদাহরণ: একজন কালো মানুষকে যখন একজন সাদা মানুষের সাথে প্রথম দেখা হয়, তাদের পারস্পরিক আচরণে একটি সামাজিক রীতি বা মানদণ্ড কাজ করে, যা তাদের পরিচয় এবং সামাজিক ভূমিকাকে প্রভাবিত করে। এর মধ্যে কিছু অজানা বা অবচেতন বিশ্বাস থাকতে পারে, যা তাদের জাতিগত বা বর্ণগত অবস্থানকে সুনির্দিষ্ট করে তোলে।
৪. ফেমিনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি:
ফেমিনিস্ট তত্ত্বে জাতি এবং বর্ণের সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য একটি আরও ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করা হয়, যেখানে মহিলাদের জাতিগত ও বর্ণগত সমস্যাগুলোর সমন্বয় ঘটানো হয়। এখানে দেখা হয় যে, মহিলাদের জাতিগত বা বর্ণগত অবস্থান কেবল তাদের লিঙ্গের পরিচয় এবং সামাজিক বৈষম্যের দৃষ্টিকোণ থেকেও প্রভাবিত হয়।
উদাহরণ: কালো মহিলাদের অভিজ্ঞতা সাদা পুরুষের তুলনায় খুবই ভিন্ন ছিল। তাদের উপর লিঙ্গভেদী, জাতিগত এবং বর্ণগত সহিংসতা একসাথে ছিল। এদের সমষ্টিগত অবস্থানকে বোঝার জন্য একাধিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় প্রয়োজন।
৫. কোলোনিয়াল থিওরি:
কোলোনিয়াল থিওরি জাতিগত এবং বর্ণগত গঠনের বিষয়ে উপনিবেশিক ইতিহাসের প্রভাব বিশ্লেষণ করে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, উপনিবেশিক শক্তি তাদের উপনিবেশিত অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে জাতিগত এবং বর্ণগত বিভাজন তৈরি করে, যা পরবর্তীতে সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করে।
উদাহরণ: উপনিবেশবাদী শাসনাধীন ভারতবর্ষে, ইংরেজ শাসকরা ভারতীয়দের মধ্যে জাতি, ধর্ম এবং বর্ণভেদ তৈরি করে, যা পরবর্তীতে ভারতীয় সমাজের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণী ও বৈষম্য তৈরি করে।
উপসংহার:
জাতিগত এবং বর্ণগত গঠন কেবল শারীরিক বৈশিষ্ট্য নয়, বরং এটি একটি সমাজের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে গঠিত ধারণা। সমাজে এই বিভাজন সৃষ্টি হয় এবং তা বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিভিন্ন তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি, যেমন সামাজিক নির্মাণবাদ, মার্কসবাদ, সিম্বলিক ইন্টারঅ্যাকশনিজম, ফেমিনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি এবং কোলোনিয়াল থিওরি, জাতিগত এবং বর্ণগত গঠনের পেছনের সামাজিক প্রক্রিয়া এবং তার সমাজে প্রভাবকে বুঝতে সাহায্য করে।