ভূমিকা: পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম একটি তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি যা ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে উদ্ভূত হয় এবং এটি মূলত সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কাঠামো, ভাষা, এবং জ্ঞানকে বিশ্লেষণ করে। পোস্ট-স্ট্রাকচারালিস্ট দৃষ্টিকোণ থেকে, সমাজের নর্ম বা নিয়মগুলো শক্ত, চিরস্থায়ী, এবং নির্দিষ্ট নয়; বরং এগুলো পরিবর্তনশীল, আপেক্ষিক, এবং কখনো কখনো ধ্বংসযোগ্য। পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর ডিকনস্ট্রাকশন (Deconstruction), যা মূলত কোনো একটি কাঠামো, মতবাদ, অথবা টেক্সটের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব এবং পরস্পরবিরোধিতাকে উন্মোচন করতে কাজ করে। পোস্ট-স্ট্রাকচারালিস্ট দার্শনিকদের মধ্যে মিশেল ফুকো এবং জ্যাক দেরিডা এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এই প্রবন্ধে পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজমের মূল ধারণা, সামাজিক নর্মের ডিকনস্ট্রাকশনের ব্যাখ্যা, এবং এটির বাস্তব জীবনে প্রভাব বা উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করা হবে।
পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজমের মূল ধারণা:
পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম সাধারণত স্ট্রাকচারালিজম থেকে উত্সাহিত হলেও, এটি স্ট্রাকচারালিজমের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সুনির্দিষ্ট কাঠামো ও বিশ্লেষণ পদ্ধতিগুলির প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে। স্ট্রাকচারালিজম সমাজ, ভাষা, এবং সংস্কৃতিকে একটি সামগ্রিক কাঠামোর মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পোস্ট-স্ট্রাকচারালিস্টরা মনে করতেন যে, এই কাঠামোগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধতা এবং শক্তি সম্পর্কের অধিকারী কিছু ছদ্ম-অথর্বতা (hidden hierarchies) বিদ্যমান।
ডিকনস্ট্রাকশন:
জ্যাক দেরিডা এর ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজমের একটি প্রধান দিক। ডিকনস্ট্রাকশন মূলত কোনো একটি নির্দিষ্ট অর্থ বা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে এবং তার অন্তর্নিহিত গঠনগত দ্বন্দ্বগুলো প্রকাশ করতে চায়। এটি কোনও একটি নির্দিষ্ট সামাজিক বা সাংস্কৃতিক নর্মের অন্তর্নিহিত অসমতা এবং দ্বন্দ্বকে উন্মোচন করে।
উদাহরণস্বরূপ, যখন আমরা গণতন্ত্র বা মানবাধিকার এর মতো সামাজিক নর্মের প্রতি একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে খোঁজ নিতে শুরু করি, তখন আমরা দেখতে পারি যে এসব ধারণা কোথাও নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বা শ্রেণীর জন্য তৈরি হয়েছে, এবং প্রতিটি নর্ম সমাজের একটি বিশেষ অংশের জন্য গঠনমূলকভাবে প্রযোজ্য হতে পারে না।
সামাজিক নর্ম এবং তাদের ডিকনস্ট্রাকশন:
সামাজিক নর্ম বলতে আমরা এমন আদর্শ বা নিয়মাবলীকে বুঝি, যা সমাজে একে অপরের আচরণ, বিশ্বাস এবং প্রথাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এগুলো সমাজে গ্রহণযোগ্যতা, কাঠামো, এবং কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। যেমন, পরিবার, লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকা, শ্রেণী ও জাতি ভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিধিনিষেধ ইত্যাদি সামাজিক নর্মের অংশ। পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম এই নর্মগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে এবং এগুলির মধ্যে লুকানো শক্তির সম্পর্ক, অবিচার, এবং গোপন শোষণের অঙ্গীকার উন্মোচন করতে চায়।
লিঙ্গের সামাজিক নর্ম:
লিঙ্গের সামাজিক নর্ম ডিকনস্ট্রাকশন এর একটি বড় ক্ষেত্র। প্রচলিত সমাজে লিঙ্গ নির্ধারণকারী নর্মগুলো হল: পুরুষরা আক্রমণাত্মক, শক্তিশালী, এবং আত্মবিশ্বাসী হবে, আর নারীরা কোমল, স্নেহশীল, এবং বাধ্য হবে। এই নর্মগুলো আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, কিন্তু পোস্ট-স্ট্রাকচারালিস্টরা বলছেন যে এগুলি প্রাকৃতিক নয়, বরং সামাজিকভাবে নির্মিত। এভাবে, এই সমস্ত লিঙ্গভিত্তিক নর্মকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে এবং একে নস্ট করা উচিত।
উদাহরণ: যখন একজন পুরুষ সন্তান জন্ম দেয় এবং তাকে পরিবারের সব ধরনের ক্ষমতা দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়, কিন্তু নারী একই কাজ করতে গিয়ে তথাকথিত “অত্যাচারিত” হিসেবে বিবেচিত হন, তখন এখানে লিঙ্গের সামাজিক নর্মের বিভাজন স্পষ্টভাবে দেখা যায়। পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজমের দৃষ্টিতে, এই ধরনের নর্মের তত্ত্বাবধানে কোনও বৈধতা নেই, কারণ তারা প্রতিটি ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস এবং আত্মসম্মানকে অস্বীকার করে।
শ্রেণী ভিত্তিক সামাজিক নর্ম:
শ্রেণীভিত্তিক সামাজিক নর্ম গুলোর ডিকনস্ট্রাকশন সমাজের অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্যকে দেখানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে সাধারণত এক শ্রেণীর মানুষের জন্য কাজ করার নিয়ম এবং জীবনযাত্রা স্থির থাকে, অন্যদিকে আরেক শ্রেণীর মানুষের জন্য শর্ত তৈরি হয় যাতে তারা সম্পদ এবং ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
উদাহরণ: শ্রমিক শ্রেণী এবং ধনী শ্রেণী এর মধ্যে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও শক্তির সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে শ্রমিকরা মূলত পুঁজির শোষণের শিকার, কিন্তু সমাজে তাদের গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হয়। পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম এই সামাজিক শ্রেণীভিত্তিক নর্মকে চ্যালেঞ্জ করে, এবং প্রমাণ করে যে সমাজের শক্তির কাঠামো এবং শ্রেণীভেদ সামাজিক নর্মের মাধ্যমে শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
ধর্মীয় নর্মের ডিকনস্ট্রাকশন:
ধর্মীয় নর্মগুলি সমাজে রীতিনীতি এবং আচরণের জন্য একটি শক্তিশালী কাঠামো তৈরি করে। কিন্তু পোস্ট-স্ট্রাকচারালিস্টরা ধর্মীয় নর্মগুলিকে শুধুমাত্র বিশ্বাসের বিষয় হিসেবে নয়, বরং এগুলো শক্তির কাঠামো হিসাবে দেখেন। এক্ষেত্রে ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতা কাঠামো হিসেবে চ্যালেঞ্জ করা হয়।
উদাহরণ: ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির মধ্যে পুরুষদের প্রাধান্য এবং নারীদের অধীনস্থ অবস্থান পোস্ট-স্ট্রাকচারাল দৃষ্টিতে যে ধরনের আক্রমণের অধীনে তা হচ্ছে – নারীরা কখনো কখনো ধর্মীয় তত্ত্ব এবং নর্মগুলির দ্বারা অপরাধী ও নীচু হিসেবে বিবেচিত হন, যা ধর্মের সৃষ্ট একটি সামাজিক নির্মাণ।
পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজমের সমালোচনা এবং সীমাবদ্ধতা:
পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজমের সবচেয়ে বড় সমালোচনা হলো এর বিশ্লেষণের আপেক্ষিকতা। পোস্ট-স্ট্রাকচারালিস্টরা সামাজিক নর্মের ডিকনস্ট্রাকশন করতে গেলে অনেক সময় তারা বৃহত্তর সামাজিক কাঠামো বা পরিপ্রেক্ষিতের ব্যাপারে অবহেলা করে, যা সমাজের সাধারণ উদ্দেশ্য বা কল্যাণের প্রতি মনোযোগ দিতে বাধা দেয়। এছাড়া, ডিকনস্ট্রাকশন কখনো কখনো আত্মবিশ্বাসহীনতা এবং অস্পষ্টতার সৃষ্টি করতে পারে।
উপসংহার:
পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম একটি শক্তিশালী তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ যা সামাজিক নর্ম এবং সাংস্কৃতিক কাঠামোকে পুনর্বিবেচনা এবং সমালোচনা করে। এটি আমাদেরকে সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং নর্মগুলোকে প্রশ্ন করতে শেখায় এবং এসব নর্মের অন্তর্নিহিত অর্থ এবং শক্তি সম্পর্ককে উন্মোচন করে। তবে, এর সীমাবদ্ধতা এবং বিশ্লেষণের আপেক্ষিকতা থেকেও সজাগ থাকতে হবে।