ভূমিকা
পোস্টমডার্নিজম একটি তাত্ত্বিক ধারনা, যা ২০ শতকের শেষের দিকে আধুনিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে আবির্ভূত হয়। এই তত্ত্বের মূল উদ্দেশ্য ছিল আধুনিকতার নির্দিষ্টতা এবং সার্বভৌম সত্যের ধারণা সমালোচনা করা, যা পূর্ববর্তী যুগের দার্শনিক এবং তাত্ত্বিকরা অনুসরণ করেছিলেন। সমাজবিজ্ঞানে পোস্টমডার্নিজমের প্রভাব ব্যাপক ছিল এবং এটি সমাজবিজ্ঞানীদের চিন্তাভাবনা এবং গবেষণার পদ্ধতিতে মৌলিক পরিবর্তন এনেছে। এই লেখায় পোস্টমডার্নিজমের মূল ধারণা এবং তার সমাজবিজ্ঞানে প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
পোস্টমডার্নিজমের মূল ধারণা
পোস্টমডার্নিজম, আধুনিকতাবাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে উদ্ভূত, এটি প্রথাগত বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা, সঠিকতা, এবং অভ্যন্তরীণ বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। পোস্টমডার্নিজমের মতে, সমাজের বাস্তবতা এবং জ্ঞান একমাত্র অক্ষুণ্ন, স্থিতিশীল, বা অভ্যন্তরীণ সত্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি নয়, বরং এটি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের মধ্যে বিকশিত হয়। এর অর্থ হলো, যে সত্য এবং বাস্তবতার ধারণা আমরা গ্রহণ করি তা বাস্তবতার একক বা নির্দিষ্ট ছবি নয়, বরং এটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা একটি প্রকল্প।
পোস্টমডার্নিজমের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
- অনিশ্চয়তা ও আপেক্ষিকতা: পৃথিবী এবং সমাজের ধারণাগুলোর কোনো একক বা অব্যর্থ ব্যাখ্যা নেই।
- বিভ্রান্তি এবং প্যারাডক্স: বাস্তবতার বিভিন্ন রূপের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং বৈপরীত্য থাকতে পারে।
- বিভিন্নতা এবং সাংস্কৃতিক বিশিষ্টতা: পোস্টমডার্নিজমের মধ্যে সংস্কৃতির বহু বৈশিষ্ট্য এবং অনুভূতির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
- মেটান্যারেটিভের সমালোচনা: বৃহত্তর বা সার্বভৌম গল্পগুলো, যেমন মানব ইতিহাসের বিকাশ বা একক সত্যের ধারণা, সমালোচিত হয়।
পোস্টমডার্নিজম এবং সমাজবিজ্ঞানে প্রভাব
পোস্টমডার্নিজমের সমাজবিজ্ঞানে প্রভাব অনেক গভীর এবং বিস্তৃত। এটি সমাজবিজ্ঞানীদের প্রথাগত চিন্তাধারা, গবেষণার পদ্ধতি, এবং সমাজের বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো:
১. নির্ভুল এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সমালোচনা
পোস্টমডার্নিজম সমাজবিজ্ঞানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির নির্ভুলতা এবং সার্বভৌমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আধুনিকতাবাদী সমাজবিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন যে, সমাজের সকল ঘটনা এবং প্রক্রিয়া বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণযোগ্য এবং সুনির্দিষ্ট ফলাফল পাওয়া যাবে। কিন্তু পোস্টমডার্নিস্ট সমাজবিজ্ঞানীরা এ ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের মতে, সমাজে বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী, এবং সাংস্কৃতিক শক্তির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতা থাকে, এবং সেই কারণেই সমাজবিজ্ঞানে কোনো একক বা সার্বভৌম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।
এটা উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, যে সমাজের বৈষম্য নিয়ে প্রচলিত আধুনিক তত্ত্ব যেমন ম্যাক্স ওয়েবারের শ্রেণী বিশ্লেষণ বা কার্ল মার্কসের অর্থনৈতিক তত্ত্ব সমাজের একক বাস্তবতা থেকে আসে বলে ধরা হয়েছিল। তবে পোস্টমডার্নিজম এসব তত্ত্বের ওপর প্রশ্ন তোলে এবং দাবি করে যে, একক ব্যাখ্যা সমাজের জটিলতা, বৈচিত্র্য এবং অসংগতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম নয়।
২. সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট এবং সমাজের পঠন-পাঠন
পোস্টমডার্নিজমের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এটি সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট এবং সমাজের পঠন-পাঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করে। পোস্টমডার্নিজমে সমাজের সকল ঘটনা ও কাহিনির মধ্যেই বহুসংখ্যক সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং ব্যাখ্যা গঠন করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে সমাজে প্রচারিত নানা ঘটনা একেক জনের জন্য বিভিন্ন রকমের প্রভাব ফেলতে পারে। অর্থাৎ, একটি সমাজে কোন একটি বিষয় বা ঘটনা সবার কাছে একইভাবে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে, বরং তা ব্যক্তির সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভরশীল।
এর মাধ্যমে পোস্টমডার্নিজম সমাজবিজ্ঞানে সাংস্কৃতিক সমালোচনা এবং গবেষণার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচন করেছে, যা গবেষকদেরকে সমাজের বিভিন্ন ধরনের ভাষা, আচার-আচরণ এবং প্রথার মধ্যে নিহিত শক্তি সম্পর্কিত আরো গভীর ধারণা প্রদান করে।
৩. সামাজিক নির্মাণ এবং বাস্তবতার প্রতীকী বিশ্লেষণ
পোস্টমডার্নিজম সমাজে বাস্তবতার গঠনমূলক এবং প্রতীকী দিক নিয়ে আলোচনা করে। এর মতে, সমাজের বাস্তবতা কোনো নির্দিষ্ট বস্তুগত জিনিস নয়, বরং এটি মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমে তৈরি হয়। এটি ‘সামাজিক নির্মাণ’ বা Social Constructionism তত্ত্বের প্রতি সমর্থন জানায়, যেখানে বাস্তবতা সামাজিকভাবে গঠিত এবং পুনর্নির্মিত। এর মানে হলো, সমাজে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস এবং মানদণ্ডের মাধ্যমে আমাদের ‘বাস্তবতা’ গড়ে ওঠে।
এটি সমাজবিজ্ঞানীদের আরও গভীরভাবে সমাজের গঠনমূলক দিক নিয়ে ভাবতে সাহায্য করেছে এবং সমাজের নানা কাঠামো, যেমন লিঙ্গ, জাতি, শ্রেণী, এবং জাতীয়তা, কিভাবে বাস্তবতার গঠনে প্রভাবিত হয় তা বিশ্লেষণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, লিঙ্গ সম্পর্কিত সামাজিক নির্মাণের মধ্যে নারী-পুরুষের ভূমিকার পার্থক্য এবং সমাজে তাদের অবস্থান বুঝতে পোস্টমডার্নিজমের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত কার্যকর।
৪. নির্দিষ্ট ধারণার বিরুদ্ধে সমালোচনা এবং বৈচিত্র্যের গ্রহণ
পোস্টমডার্নিজম সামাজিক বৈচিত্র্য এবং বৈষম্যের গুরুত্বকে স্বীকার করে এবং তা প্রচার করতে সাহায্য করে। একক সত্যের বা একক ধারণার বিরুদ্ধে এটি সমালোচনা করে এবং সামাজিক বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান দেখানোর উপর গুরুত্ব দেয়। এক্ষেত্রে এটি বর্ণবাদ, যৌনতা, শ্রেণীভেদ, এবং সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য নিয়ে বিশ্লেষণের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছে।
উপসংহার
পোস্টমডার্নিজম সমাজবিজ্ঞানে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও গবেষণার পদ্ধতি নিয়ে এসেছে। এটি আধুনিকতার অভ্যন্তরীণ বৈজ্ঞানিক নির্ভুলতা এবং সার্বভৌম সত্যের ধারণার বিপরীতে সামাজিক বাস্তবতার অসীম বিভাজন, সাংস্কৃতিক শক্তি, এবং মানুষের অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। পোস্টমডার্নিজম সমাজবিজ্ঞানে গবেষণার পদ্ধতি, দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের নতুন পরিসর সৃষ্টি করেছে।