ভূমিকা
মার্কসবাদী তত্ত্ব বা মার্কসবাদ, কার্ল মার্কসের মৌলিক চিন্তা-ধারার উপর ভিত্তি করে তৈরি। তিনি সমাজের কাঠামো, শ্রেণীসংগ্রাম এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সামাজিক পরিবর্তন ও ইতিহাসের অগ্রগতি ব্যাখ্যা করেছেন। মার্কসবাদী তত্ত্বের মূল ধারণা হলো, পুঁজিবাদী সমাজ একটি শ্রেণীগত বিভাজন তৈরি করে, যেখানে একটি শ্রেণী (পুঁজিপতি বা বস্তুবাদী শ্রেণী) অন্য শ্রেণী (শ্রমিক শ্রেণী) থেকে লাভবান হয়। ২১ শতকে এসে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে এই তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা এবং কার্যকারিতা নিয়ে নতুন প্রশ্ন উঠেছে। এই লেখায়, মার্কসবাদী তত্ত্বের পুঁজিবাদের সমালোচনা এবং ২১ শতকে তার প্রভাব ও প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণ করা হবে।
মার্কসবাদী তত্ত্বের মূল ভিত্তি
মার্কসবাদী তত্ত্বের মূল স্তম্ভ হলো শ্রেণীসংগ্রাম, যেখানে শ্রমিক শ্রেণী (প্রোলেতারিয়েট) এবং পুঁজিপতি শ্রেণী (বুর্জোয়া) এর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। মার্কসের মতে, পুঁজিবাদী সমাজের মূল চরিত্র হলো শোষণ। পুঁজিপতি শ্রেণী শ্রমিকদের শ্রম থেকে অতিরিক্ত মুনাফা নিয়ে যায়, এবং শ্রমিকরা শুধুমাত্র তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ উপার্জন করতে পারে। মার্কস বিশ্বাস করতেন যে, এই শোষণের ফলে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি হয় এবং এক সময়ে শ্রমিক শ্রেণী বিদ্রোহ করে এই শোষণ ব্যবস্থাকে উৎখাত করবে, যা পরবর্তী সময়ে একটি সমাজতান্ত্রিক এবং পরে কমিউনিস্ট সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে।
মার্কসের সবচেয়ে পরিচিত গ্রন্থ ক্যাপিটাল (Capital) এর মাধ্যমে তিনি পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত শোষণের মেকানিজম ব্যাখ্যা করেছেন, যেখানে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, পুঁজিপতিরা মূলত শ্রমিকের উৎপাদিত মূল্যের তুলনায় কম মজুরি প্রদান করেন, যার ফলে অতিরিক্ত মুনাফা (surplus value) তাদের কাছে চলে যায়।
২১ শতকে পুঁজিবাদ: পরিবর্তন এবং সমালোচনা
২১ শতকে এসে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, যেমন প্রযুক্তিগত উন্নতি, বৈশ্বিকায়ন, এবং আর্থিক সেক্টরের আধিপত্য। তবে, এসব পরিবর্তনেও পুঁজিবাদী শোষণ ও বৈষম্য বাড়ানোর অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। মার্কসবাদী তত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে, এই পরিবর্তনগুলির মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় রয়েছে যা পুঁজিবাদের সমালোচনার ক্ষেত্রে এখনও প্রাসঙ্গিক।
অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি
বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বড় আকারে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। পুঁজিপতিরা আরও বেশি লাভবান হচ্ছে, কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি এবং জীবনের মানের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। ২১ শতকের প্রথম দিকে, অর্থনৈতিক মন্দা (2008 financial crisis) পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি অনেকটাই পুঁজিবাদী বাজারের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এই সময়ে, বৃহৎ কোম্পানি ও ব্যাংকগুলো সরকারের সহায়তায় আবারও পুনরুদ্ধার পেয়েছে, কিন্তু শ্রমিক শ্রেণী বিশেষ কিছু সুবিধা লাভ করেনি। এই ঘটনা মার্কসের পূর্বাভাসকে সমর্থন করে, যেখানে তিনি বলেছিলেন যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শোষণ বৃদ্ধি পাবে এবং শ্রেণীভেদ গভীর হবে।
বৈশ্বিকায়ন এবং তার প্রভাব
বৈশ্বিকায়ন (Globalization) পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করেছে, তবে এটি সমাজের মধ্যে বৈষম্যকে আরও তীব্র করেছে। বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলি উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে স্থানান্তরিত হয়েছে এবং নিম্ন মজুরির শ্রমিকদের কাজে নিযুক্ত করছে। এতে শ্রমিক শ্রেণী নতুনভাবে শোষিত হচ্ছে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ভিয়েতনাম এবং চীন এর মতো দেশগুলোতে শ্রমিকদের মজুরি কম রাখা হয়, যেখানে বড় কোম্পানি তাদের কারখানায় উৎপাদন করাচ্ছে।
কোম্পানির আধিপত্য এবং কর্মসংস্থান
২১ শতকে কোম্পানির আধিপত্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তি এবং আর্থিক খাতে। অ্যামাজন, অ্যাপল, গুগল ইত্যাদি বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তার করছে, এবং তাদের কর্মী সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও তারা যে লাভ করছে তা আকাশচুম্বী। এতে শ্রমিক শ্রেণীর উন্নতি হলেও মুনাফা সেই কম কোম্পানির হাতেই কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এই ব্যাপারে মার্কসের তত্ত্বের ভিত্তিতে বলা যায়, যে মূলধন ব্যবস্থার আধিপত্য সৃষ্টি হওয়াতে শ্রমিক শ্রেণীর জন্য প্রয়োজনীয় ন্যায্যতা ও অধিকার ধীরে ধীরে খর্ব হচ্ছে।
মার্কসবাদী তত্ত্বের সমালোচনা
যদিও মার্কসবাদী তত্ত্বের অনেক মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি আজও প্রাসঙ্গিক, তবে ২১ শতকের পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কিছু ত্রুটি লক্ষ্য করা যায় যা মার্কসবাদী তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগে বাধা সৃষ্টি করে। তার তত্ত্বের কয়েকটি ত্রুটি নিম্নরূপ:
- রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিবর্তন: মার্কসবাদী তত্ত্ব অনুযায়ী, শ্রমিক শ্রেণী এক সময়ে বিদ্রোহ করে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তর করবে। কিন্তু আধুনিক সমাজে, রাষ্ট্রগুলো অনেক সময় শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে, সামাজিক নিরাপত্তা এবং শ্রমিক অধিকার উন্নত হয়েছে, যা মার্কসের পূর্বাভাসের সঙ্গে মিল খায় না।
- বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং প্রযুক্তি: মার্কসবাদী তত্ত্ব, বিশেষ করে শোষণের ধারণা, প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা কঠিন হতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তি শ্রমিকদের কাজের ধরন পরিবর্তন করে ফেলেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্থানান্তরের সুযোগ তৈরি করেছে। এটি মার্কসের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের বাইরে।
উপসংহার
মার্কসবাদী তত্ত্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শোষণ এবং শ্রেণীসংগ্রামের উপর গুরুত্ব আরোপ করে, যা আজও বিশ্বব্যাপী সমাজে প্রাসঙ্গিক। ২১ শতকের পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নতুন প্রযুক্তি, বৈশ্বিকায়ন এবং অর্থনৈতিক শোষণ নিশ্চিতভাবে মার্কসবাদী তত্ত্বের মাধ্যমে বিশ্লেষিত হতে পারে। তবে, কিছু আধুনিক পরিবর্তন মার্কসের পূর্বাভাস এবং দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, যা তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। এই পরিবর্তনগুলো, যেমন বৈশ্বিক অর্থনীতি, প্রযুক্তি, এবং শ্রেণীভেদ, মার্কসবাদী তত্ত্বের অন্তর্নিহিত বিশ্লেষণকে পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করে।