আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রিয়েলিজম: শক্তি, নিরাপত্তা এবং সংঘাত

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যয়ন একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক ক্ষেত্র, যেখানে বিভিন্ন তত্ত্ব এবং ধারণার মাধ্যমে বিশ্বের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করা হয়। এই তত্ত্বগুলির মধ্যে রিয়েলিজম একটি প্রভাবশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতিশীলতাকে একেবারে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে। রিয়েলিজমের মূল তত্ত্বটি হল যে রাষ্ট্রের জন্য নিরাপত্তা এবং শক্তি অর্জন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এবং বিশ্বব্যাপী সংঘাত এবং প্রতিযোগিতা অপরিহার্য। এটি মানব জাতির স্বাভাবিক প্রবৃত্তি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি একটি রুদ্ধদ্বার, সংঘাতপূর্ণ এবং শত্রুপূর্ণ পরিবেশে পরিণত হয়, যেখানে রাষ্ট্রগুলো নিজেদের নিরাপত্তা এবং ক্ষমতা বজায় রাখতে সর্বদা লড়াই করে। রিয়েলিজমের প্রেক্ষাপটে, যুদ্ধ, সহিংসতা এবং কূটনৈতিক সংঘাতের মতো বিষয়গুলি অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করা হয়।

রিয়েলিজমের মূল তত্ত্ব এবং ধারণা

রিয়েলিজমের মূল তত্ত্বের ভিত্তি হলো মানব প্রকৃতি এবং রাষ্ট্রের স্বার্থ। রিয়েলিস্টরা বিশ্বাস করেন যে, মানুষ এবং রাষ্ট্রের মৌলিক লক্ষ্য হলো নিজেদের অস্তিত্ব এবং নিরাপত্তা রক্ষা করা, এবং তারা এটি অর্জন করতে সবরকম উপায় ব্যবহার করবে। রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে তার সীমানা রক্ষা করা এবং বৈশ্বিক ব্যবস্থায় নিজের অবস্থান শক্তিশালী করা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, শক্তি এবং নিরাপত্তা অর্জন হলো রাষ্ট্রের জন্য প্রধান উদ্বেগ। রিয়েলিজমের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শক্তির ভারসাম্য বা ব্যালান্স অফ পাওয়ার তত্ত্ব। এটি বলে যে, বিশ্বে রাষ্ট্রগুলো যখন নিজেদের শক্তির পরিমাণ বাড়াতে চায়, তখন অন্য রাষ্ট্রগুলো সেই শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে শুরু করবে। এই প্রক্রিয়া সংঘাত এবং যুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

রিয়েলিজমের তত্ত্বে বেশ কয়েকটি মৌলিক উপাদান রয়েছে: ১. শক্তি – রিয়েলিস্টদের মতে, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব এবং নিরাপত্তা শক্তির উপর নির্ভরশীল।
২. নিরাপত্তা – রাষ্ট্রের প্রধান উদ্বেগ হলো নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
৩. জাতীয় স্বার্থ – আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সব কর্মকাণ্ড জাতীয় স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি রেখে পরিচালিত হয়।
৪. অবিশ্বাস – রিয়েলিজম বিশ্বাস করে যে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কোন ধরনের বিশ্বাস এবং সহযোগিতা স্থায়ী নয়, বরং প্রতিযোগিতা এবং শত্রুতার প্রকৃতিতে আস্থা রাখা উচিত।

রিয়েলিজমের ইতিহাস এবং উদাহরণ

রিয়েলিজমের গোড়ার দিকে দেখা যায় যে, এটি প্রাচীন সময়ের রাজনৈতিক চিন্তাধারা থেকে উদ্ভূত। প্রাচীন গ্রিস এবং রোমে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা এবং শক্তির সংগ্রাম ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে আধুনিক রিয়েলিজমের সূচনা ঘটে উনিশ শতকে, যখন ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মধ্যে সংঘাত এবং রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বাড়ে। হোবস এবং ম্যাকিয়াভেলি এর মতো চিন্তাবিদরা রিয়েলিজমের তত্ত্বের প্রাথমিক রূপ তৈরি করেছিলেন, যা পরবর্তীতে হান্স মোর্গেনথাউ এবং কেনেথ ওয়ালৎজ এর মতো রাজনৈতিক বিজ্ঞানী দ্বারা আরও গভীরভাবে বিশ্লেষিত হয়।

একটি প্রামাণিক উদাহরণ হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮)। এই যুদ্ধটি ছিল রিয়েলিজমের তত্ত্বের একটি নিখুঁত উদাহরণ, যেখানে রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজস্ব শক্তি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একে অপরকে প্রতিযোগিতা করেছিল। এই যুদ্ধের সময়, প্রতিটি রাষ্ট্র তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে এবং এর মাধ্যমে অন্য রাষ্ট্রগুলোর ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছিল। শক্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য, তারা আলায়েন্স এবং কূটনৈতিক চুক্তি সই করেছিল, কিন্তু অবশেষে এই প্রতিযোগিতার ফলস্বরূপ একটি ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হয়।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো কোল্ড ওয়ার (১৯৪৭-১৯৯১)। এই সময়কালে, যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন দুইটি শক্তিশালী দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক দৃশ্যে উপস্থিত ছিল। কোল্ড ওয়ার ছিল রিয়েলিজমের একটি নিখুঁত প্রতিফলন, কারণ দুটি প্রধান পরাশক্তির মধ্যে ছিল শক্তির প্রতিযোগিতা, যা সরাসরি সামরিক সংঘাতে পরিণত না হলেও, বিভিন্ন দেশ এবং অঞ্চলে প্রক্সি যুদ্ধ, কূটনৈতিক চাপ, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং ক্ষমতার দখল নিয়ে সংঘাত ছিল। এই পর্বে, নিরাপত্তা এবং শক্তির জন্য দেশগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল, যেখানে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কাঠামো ছিল একেবারে সংঘাতপূর্ণ।

রিয়েলিজমের মূল উপাদান: শক্তি এবং নিরাপত্তা

শক্তি এবং নিরাপত্তা রিয়েলিজমের দুইটি কেন্দ্রীয় উপাদান। রিয়েলিস্টরা বিশ্বাস করেন যে, একটি রাষ্ট্র শুধুমাত্র নিজের শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে নিরাপত্তা অর্জন করতে পারে। শক্তির ধারণাটি কেবলমাত্র সামরিক শক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত এবং সাংস্কৃতিক শক্তিও অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্রগুলি যখন নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য চেষ্ট করে, তখন তারা তাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর প্রতি হুমকি হিসেবে প্রতিস্থাপন হতে পারে, যা পরবর্তীতে সংঘাতের সৃষ্টি করতে পারে।

শক্তির ভারসাম্য তত্ত্ব অনুযায়ী, যেকোনো শক্তির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি অন্যান্য রাষ্ট্রের মধ্যে আতঙ্ক এবং প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের কারণ হতে পারে। এই নীতির আলোকে, শক্তির ভারসাম্য একটি অনিবার্য চাহিদা হিসেবে দেখা হয়, কারণ বিশ্বব্যাপী শক্তির বন্টন প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজস্ব নিরাপত্তা এবং স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সমসাময়িক উদাহরণ: ইউক্রেন যুদ্ধ

বর্তমানে ইউক্রেনের সংকট এবং রাশিয়ার আক্রমণ একটি নিখুঁত রিয়েলিস্টিক উদাহরণ। রাশিয়া ইউক্রেনের সীমান্তে সামরিক বাহিনী পাঠানোর মাধ্যমে তার শক্তি এবং নিরাপত্তা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। ইউক্রেনের সাথে সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইন এবং নীতিগুলি রাশিয়াকে আটকানোর চেষ্টা করলেও, রাশিয়া তাদের শক্তির মাধ্যমে ইউক্রেনের ভূখণ্ড দখল করার পদক্ষেপ নিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব এবং NATO শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং রাশিয়ার নিরাপত্তা উদ্বেগ এই সংঘাতের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ক্ষেত্রে, রিয়েলিজমের তত্ত্ব অনুসারে, রাষ্ট্রগুলো নিজেদের নিরাপত্তা এবং ক্ষমতা রক্ষায় লড়াই করছে, যেখানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা খুবই সীমিত এবং যুদ্ধ ও সংঘাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।

উপসংহার

রিয়েলিজম আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি শক্তিশালী তত্ত্ব যা বিশ্বের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে শক্তি, নিরাপত্তা এবং সংঘাতের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে। রাষ্ট্রগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সর্বদা যুদ্ধের মতো সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। রিয়েলিজমের তত্ত্বের আলোকে, যুদ্ধ, সহিংসতা এবং প্রতিযোগিতা আন্তর্জাতিক রাজনীতির স্বাভাবিক উপাদান হিসেবে দেখা হয়। তবে, রিয়েলিজমের ব্যাখ্যা কখনো কখনো আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, শান্তি বা বিশ্বসংগঠনের গুরুত্বকে অবহেলা করে, যেহেতু এটি কেবল শক্তির ভিত্তিতে বিশ্বরাজনীতি বিশ্লেষণ করে। এটি সঠিকভাবে বিশ্বের জটিল সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে, তবে বিশ্বে শান্তির প্রতিষ্ঠা এবং আন্তর্জাতিক আইন ও নীতির বিকাশের জন্য অন্য তত্ত্বগুলিরও প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *