অ্যানথ্রোপলজি, বা মানববিদ্যা, একটি এমন শাখা যা মানুষের আচরণ, সংস্কৃতি, সমাজ এবং তাদের আন্তঃসম্পর্কের অধ্যয়ন করে। এর মধ্যে “অদ্ভুততা” বা “অন্যত্ব” (Otherness) একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা যা সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য এবং ভিন্নতা বুঝতে সহায়ক। “অন্যত্ব” শব্দটি সাধারণত ব্যবহৃত হয় সেইসব মানুষ বা গোষ্ঠীকে বোঝাতে, যারা একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতি, জাতি বা সমাজের বাইরে থাকে। এটি একটি সামাজিক নির্মাণ যা মানুষ তাদের পরিচয় এবং নিজের জাতিগত, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অবস্থানকে সংজ্ঞায়িত করতে ব্যবহার করে। অ্যানথ্রোপলজিতে “অন্যত্ব” একদিকে যেমন একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া, তেমনি এটি মানুষের চিন্তা এবং আচরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
“অন্যত্ব” ধারণাটি সৃষ্টির মূল কারণ হলো সাংস্কৃতিক ভিন্নতা এবং সমাজের অভ্যন্তরীণ বিভাজন। যে কোনো সমাজ, যে কোনো সংস্কৃতি তার সীমানার মধ্যে একটি ঐক্য এবং সংহতি তৈরি করতে চায়। তবে সেই ঐক্য এবং সংহতি একধরনের বর্হিসংগঠন বা বাইরের অন্যদের প্রতি বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে। এইভাবে, “অন্য” বা “বাইরের” মানুষরা সাধারণত সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথক হয়। সমাজের মূলধারার সংস্কৃতি এবং বিশ্বাসের সাথে তাদের সাংস্কৃতিক অবস্থান, আচরণ এবং মূল্যবোধ ভিন্ন হতে পারে, যা সমাজের অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
এই ধারণার উদাহরণ হিসেবে আমরা দেখতে পারি যে, পৃথিবীজুড়ে নানা সমাজ ও সংস্কৃতিতে কীভাবে “অন্য” এবং “নিজ” এর মধ্যে একটি তফাৎ তৈরি হয়। পাশ্চাত্য সভ্যতায়, বিশেষ করে ঔপনিবেশিক যুগে, বিভিন্ন অঞ্চলের জাতি বা গোষ্ঠীকে “অন্য” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বারা শাসিত দেশগুলোতে, যেমন আফ্রিকা, এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকা, স্থানীয় জনগণকে বাইরের চোখে পরাজিত, বর্বর, অগ্রসর না হওয়া, এবং পাশ্চাত্যের বুদ্ধিমত্তা ও সভ্যতার তুলনায় নিচু হিসাবে দেখানো হত। এখানেই “অন্যত্ব” বা “অদ্ভুততা”র ধারণা শুরু হয়েছিল, যেখানে শক্তিশালী জাতিগুলোর মধ্যে নিজেদের “উন্নত” হিসেবে তুলে ধরা হতো এবং স্থানীয় জনগণের সংস্কৃতি, ভাষা ও বিশ্বাসের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করা হতো।
ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ থেকে একে বোঝানোর জন্য একটি বড় উদাহরণ হলো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন। ব্রিটিশরা যখন ভারত উপমহাদেশে শাসন করতে আসে, তারা স্থানীয় জনগণকে তাদের সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা এবং বিশ্বাসের দিক থেকে অপরিচিত ও নিম্নমানের হিসেবে চিহ্নিত করে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছে ভারতীয় জনগণ ছিল “অন্য”, যারা তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এবং ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান জানানোর পরিবর্তে, তাদের সংস্কৃতি এক ধরনের “প্রাচীন” এবং “বর্বর” হিসেবে দেখা হতো। এই “অন্যত্ব” ধারণাটি একদিকে যেমন ঔপনিবেশিক শাসনের শক্তি এবং আধিপত্য বজায় রাখার একটি অস্ত্র ছিল, তেমনি এটি স্থানীয় জনগণের মধ্যে সংস্কৃতির প্রতি একধরনের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছিল।
একটি আধুনিক উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম অভিবাসীরা পশ্চিমা দেশে স্থানান্তরিত হলে যে “অন্য” দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয়। পশ্চিমা সমাজে মুসলিম অভিবাসীরা অনেক সময় তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, পোশাক এবং জীবনযাত্রার কারণে “অন্য” হিসেবে চিহ্নিত হয়। বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের সাথে সম্পর্কিত অনেক চিত্র পশ্চিমা মিডিয়াতে এক ধরনের ভয়াবহতা বা বিরোধী প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যার ফলে মুসলিম জনগণদের প্রতি এক ধরনের অবিশ্বাস এবং বৈষম্য তৈরি হয়। পশ্চিমা সমাজে মুসলিম জনগণকে অনেক সময় তাদের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক আচরণ অনুযায়ী “অন্য” হিসেবে ভাবা হয়, যা তাদের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অন্তর্ভুক্তির পথে একটি বাধা সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে, এই ধারণার বিপরীতে কিছু সমাজ এবং সংস্কৃতি “অন্যত্ব” কে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বা সামাজিক বৈচিত্র্য হিসেবে গ্রহণ করে। উদাহরণস্বরূপ, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া এর মতো দেশগুলোতে অভিবাসী জনগণকে তাদের সংস্কৃতি এবং পরিচয় বজায় রাখার সুযোগ দেয়, যদিও তাদের মাঝে কিছু পার্থক্য বা “অন্যত্ব” থাকতে পারে। এই দেশে বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির মানুষ একত্রে বাস করে এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে একটি বৈচিত্র্যময় সমাজ গড়ে ওঠে। এমনকি এখানে “অন্য” হওয়ার পরিবর্তে অভিবাসীরা তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং ঐতিহ্যকে সম্মানিত হতে পারে, যা সমাজের বৃহত্তর পরিচয়ের অংশ হয়ে ওঠে।
একটি চমৎকার উদাহরণ হতে পারে, মেলবোর্ন শহর এর অভিবাসী সম্প্রদায়। মেলবোর্নে বিভিন্ন দেশের অভিবাসীরা তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে, খাবারের উৎসবে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করে, এবং তাদের ভাষা এবং ঐতিহ্য বজায় রাখে। যদিও মেলবোর্নে কিছু অভিবাসী সমাজের মূলধারার সংস্কৃতি থেকে আলাদা হতে পারে, তবুও তাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে একটি শক্তি হিসেবে দেখা হয় এবং স্থানীয় সমাজের মধ্যে এটি সমর্থিত হয়। এখানে “অন্যত্ব” একটি সীমাবদ্ধতা নয়, বরং এটি সমাজের সামগ্রিক বৈচিত্র্য এবং উন্নতির অংশ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
এছাড়া, আমাদের দেশে বাংলাদেশের অভিবাসীদের উদাহরণ দিয়ে “অন্যত্ব” এর ধারণাকে আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। বাংলাদেশি অভিবাসীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলে গিয়ে সেখানে এক নতুন সমাজ গড়ে তোলে। যদিও তারা সেখানে “অন্য” বা বিদেশি হিসেবে পরিচিত, তবে তারা সেখানে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য বজায় রাখে, যেমন সামাজিক অনুষ্ঠান, খাবার, এবং ভাষা ব্যবহার। তাদের “অন্য” হিসেবে দেখা হলেও, তারা নিজেদের সংস্কৃতির মাধ্যমে নতুন সমাজে তাদের অবস্থান তৈরি করে, যা স্থানীয় সমাজের সঙ্গে এক ধরনের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন তৈরি করে।
অ্যানথ্রোপলজিতে “অন্যত্ব” বা “অদ্ভুততা” শুধুমাত্র বিভাজন বা ভয় তৈরি করার জন্য নয়, বরং এটি আমাদের সেই পার্থক্য এবং বৈচিত্র্য বোঝার এক উপায়, যা সমাজের সীমানার ভিতরে এবং বাইরের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলে। একদিকে যেমন এটি পারস্পরিক বৈষম্য ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে পারে, তেমনি অন্যদিকে এটি একটি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া ও অন্তর্ভুক্তির সুযোগও তৈরি করতে পারে, যা সমাজের সমৃদ্ধি এবং একতার দিকে নিয়ে যায়।