নৃবিজ্ঞান ও মানবাধিকার: সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা বনাম বিশ্বজনীনতা

নৃবিজ্ঞান এবং মানবাধিকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা মানব সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে। এই দুটি ধারণা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত, তবে কিছু ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে বিরোধও সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে, সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা (Cultural Relativism) এবং বিশ্বজনীনতা (Universalism) এই দুটি ধারণা নৃবিজ্ঞান এবং মানবাধিকার সম্পর্কিত আলোচনায় বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দেয়। সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা ও বিশ্বজনীনতা এই দুটি ধারণার মধ্যে পার্থক্য, সম্পর্ক এবং তাদের মধ্যে উত্তরণের সম্ভাবনা নিয়ে বিশদ আলোচনা করা প্রয়োজন।

সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা (Cultural Relativism) কী?

সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা একটি ধারণা যা বলে যে, কোন সংস্কৃতির রীতিনীতি, বিশ্বাস বা আচরণগুলো কেবল সেই সংস্কৃতির মধ্যে সঠিক এবং গ্রহণযোগ্য। এটি মানে এই যে, একটি সমাজের নৈতিকতা বা আইন অন্য কোনো সমাজের নৈতিকতা বা আইনের সাথে তুলনা করা উচিত নয়। নৃবিজ্ঞানীরা অনেক সময় এই ধারণাকে গ্রহণ করেন কারণ তারা বিশ্বাস করেন যে, বিভিন্ন সমাজের মধ্যে ভিন্নতা থাকবে এবং এই ভিন্নতাগুলির প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো উচিত। উদাহরণস্বরূপ, কিছু সমাজে নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে দেখা হয়, যা পশ্চিমা সমাজে কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়, তবে সেই সমাজের সংস্কৃতি অনুযায়ী এটি সঠিক বলে মনে করা হয়।

সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা অনুযায়ী, বিশ্বস্তরীয় কোনো নৈতিক মূল্য বা মানবাধিকার থাকতে পারে না, কারণ প্রতিটি সমাজ তার নিজস্ব ঐতিহ্য এবং বিশ্বাসের ভিত্তিতে নীতিমালা তৈরি করে থাকে। এই ধারণা, যদিও একদিকে ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে, অন্যদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রেও অজুহাত সৃষ্টি করতে পারে।

বিশ্বজনীনতা (Universalism) কী?

বিশ্বজনীনতা হলো সেই ধারণা, যা বলছে যে, মানবাধিকার এবং নৈতিক মূল্যবোধগুলো সবার জন্য একই হতে হবে, যার মানে হলো, পৃথিবীর সব মানুষের জন্য কিছু মৌলিক অধিকার এবং নৈতিক নিয়ম থাকা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণা, যা ১৯৪৮ সালে প্রণীত হয়, এর মধ্যে বলা হয়েছে যে, পৃথিবীর সব মানুষের জন্য কিছু মৌলিক অধিকার যেমন, জীবনের অধিকার, স্বাধীনতা, দাসত্বের অবসান ইত্যাদি থাকা উচিত। বিশ্বজনীনতা মনে করে যে, সমস্ত মানুষ একটি নির্দিষ্ট মৌলিক অধিকার পাবে, irrespective of তাদের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, বা আঞ্চলিক পার্থক্য।

বিশ্বজনীনতার মূল ধারণা হল, কিছু মূল্য এবং অধিকার পৃথিবীর সব মানুষের জন্য এক ও অভিন্ন, এবং এসব অধিকার কোনো দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় বা ঐতিহ্য দ্বারা প্রভাবিত হওয়া উচিত নয়। যেমন, মানবাধিকার কমিশন বা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মনে করেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন যেমন নারী নির্যাতন, শিশু শ্রম, বা দাসত্ব কখনোই বৈধ হতে পারে না, যদিও এটি কোনো একটি নির্দিষ্ট সমাজের ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য হতে পারে।

সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা এবং বিশ্বজনীনতার মধ্যে দ্বন্দ্ব

সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা এবং বিশ্বজনীনতার মধ্যে একটি বড় পার্থক্য হলো, প্রথমটি সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে স্বীকার করে এবং দ্বিতীয়টি এক ধরনের সর্বজনীন নৈতিকতার কথা বলে। এই দুই ধারণার মধ্যে দ্বন্দ্ব তখনই স্পষ্ট হয়, যখন একটি সমাজের সাংস্কৃতিক রীতিনীতি মানবাধিকারের মৌলিক নীতির সঙ্গে সংঘর্ষে চলে আসে।

একটি উদাহরণ হিসেবে ধরুন, আফ্রিকার কিছু দেশে নারীকে পুরুষের অধীনস্ত হিসেবে দেখা হয় এবং সেখানে নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অধিকারের থেকে বঞ্চিত করা হয়। সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা এই ধরনের আচরণকে ঐ সমাজের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে দেখতে পারে এবং এটিকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে মানতে পারে। অন্যদিকে, বিশ্বজনীনতা মানবাধিকার চেতনার ভিত্তিতে এই আচরণকে ভুল এবং অমানবিক হিসেবে বিচার করবে, কারণ এটি নারীর মৌলিক অধিকার, যেমন স্বাধীনতা এবং সম্মানের অধিকার, লঙ্ঘন করে।

একটি আরেকটি উদাহরণ হতে পারে, ভারতীয় উপমহাদেশের কিছু অঞ্চলে শিশুশ্রম প্রচলিত। সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি ওই সমাজের ঐতিহ্য হতে পারে, তবে বিশ্বজনীনতার দৃষ্টিকোণ থেকে এটি মানবাধিকার লঙ্ঘন, কারণ এটি শিশুদের মৌলিক অধিকার এবং উন্নতির সুযোগকে হুমকির মুখে ফেলে।

একটি ক্যাস স্টাডি: আফগানিস্তানে নারীদের অধিকার

আফগানিস্তানের উদাহরণটি সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা এবং বিশ্বজনীনতার দ্বন্দ্বের স্পষ্ট প্রদর্শন। তালেবান শাসনামলে আফগানিস্তানে নারীদের শিক্ষা, কাজ এবং সামাজিক জীবন নিয়ে এক কঠোর নীতি প্রবর্তন করা হয়েছিল। তালেবানরা নারীদের জন্য চাকরি করা এবং স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ করে দেয় এবং তাদেরকে ঘরের চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ করে রাখে। তালেবানদের মতে, এটি তাদের ইসলামী সংস্কৃতির অংশ এবং একটি সঠিক আচরণ।

এদিকে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষত মানবাধিকার সংস্থা এবং পশ্চিমা দেশগুলো, এই আচরণকে বিশ্বজনীন মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে দেখে এবং তারা নারীদের মৌলিক অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য আফগান সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এখানেই সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা এবং বিশ্বজনীনতার মধ্যে সংঘর্ষ দেখা যায়। কিছু স্থানীয় নাগরিক এবং তালেবানরা এটি তাদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে মনে করে, যেখানে নারীদেরকে ঘরের কাজ করতে উৎসাহিত করা হয়, কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এটিকে নারীদের মৌলিক অধিকার হরণ হিসেবে দেখে।

উপসংহার

সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা এবং বিশ্বজনীনতা—এই দুটি ধারণা মানবাধিকার এবং নৃবিজ্ঞানের আলোচনা এবং চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেখানে সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা সংস্কৃতির বৈচিত্র্য এবং ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দেয়, সেখানে বিশ্বজনীনতা মানবাধিকারের মৌলিক নীতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। এই দুইয়ের মধ্যে সংঘর্ষ মানবাধিকার সম্পর্কিত নানা জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, যেখানে কোন একটি সমাজের ঐতিহ্য অন্যের মৌলিক অধিকারকে অবহেলা করতে পারে। তাই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এমন একটি অবস্থান গ্রহণ করা, যা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সম্মান করার পাশাপাশি মানবাধিকার রক্ষায় সমভাবে সচেষ্ট থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *