ভূমিকা:
সামাজিক আচরণ বা কলেকটিভ বিহেভিয়ার (Collective Behavior) তত্ত্ব সামাজিক বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে আলোচিত একটি বিষয়। এটি সেই ধরনের আচরণকে বোঝায়, যা একটি বা একাধিক গোষ্ঠী বা বৃহৎ জনগণের সমষ্টিগত প্রভাবে উদ্ভূত হয়। জনসাধারণের আচরণ বা সামাজিক আন্দোলন সমাজের বিভিন্ন দিকের মধ্যে পরিবর্তন আনার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বিশেষ করে, জনসাধারণের বিপুল অংশ যখন একটি সামাজিক উদ্দেশ্য বা দাবির প্রতি একত্রিত হয়, তখন তা একটি আন্দোলনে পরিণত হতে পারে, যা পুরো সমাজের কাঠামো এবং মূল্যবোধে পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। এই ধরনের আচরণকে বোঝানোর জন্য বহু তত্ত্ব প্রস্তাবিত হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো জনতার আচরণ (Crowd Behavior), গোষ্ঠী মনোবিজ্ঞান (Group Psychology), এবং সামাজিক আন্দোলনের তত্ত্ব।
এই লেখায়, আমরা সামাজিক আচরণের তত্ত্বের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং তাদের সমাজে ভূমিকা বিশ্লেষণ করব, যেমন—জনসাধারণের আচরণ, গোষ্ঠী মনোবিজ্ঞান, এবং সামাজিক আন্দোলনের গঠন।
জনসাধারণ এবং গোষ্ঠী আচরণের তত্ত্ব:
১. জনতার আচরণ (Crowd Behavior): জনসাধারণের আচরণ হলো সেই প্রক্রিয়া, যেখানে একটি বৃহৎ জনগণের দল একত্রিত হয়ে, কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে, একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বা প্রতিক্রিয়া হিসেবে একটি সংগ্রাম বা ঘটনা তৈরি করে। জনসাধারণের আচরণে বিশেষ করে গণজমায়েত, বিক্ষোভ, বা উত্তেজিত মঞ্চসমূহ লক্ষ্য করা যায়, যেখানে মানুষের প্রচণ্ড আবেগ বা মানসিক অবস্থার প্রভাব দেখা যায়। সমাজবিজ্ঞানী গাব্রিয়েল টার্ডি (Gabriel Tarde) এর মতে, জনসাধারণের মধ্যে একটি “প্যাসিভ মাইন্ড” থাকে, যা সংঘবদ্ধ হবার সময় সুনির্দিষ্ট নৈতিকতা বা মানসিকতা গ্রহণ করে এবং একটি শ্রোতার মতে কাজ করে। টার্ডি জনসাধারণের এই আচরণকে “ফলোয়ার মেন্টালিটি” বলে উল্লেখ করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ, রাজনৈতিক বিক্ষোভ বা গণঅনশনগুলো একটি বৃহৎ জনগণের জনসাধারণের আচরণের প্রকাশ হতে পারে, যেখানে একে অপরের আচরণ থেকে প্রভাবিত হয়ে অনেক মানুষ একযোগে একটি সাধারণ উদ্দেশ্য বা দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। তবে এই ধরনের আচরণ অনেক সময় অস্থিরতা বা সহিংসতা সৃষ্টি করতে পারে, কারণ জনসাধারণের সমষ্টিগত মনোভাব ব্যক্তিগতভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় না এবং মাঝে মাঝে আবেগীয় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
২. গোষ্ঠী মনোবিজ্ঞান (Group Psychology): জনসাধারণের মধ্যে এমনকি গোষ্ঠী স্তরের আচরণও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গোষ্ঠী মনোবিজ্ঞান তত্ত্ব অনুযায়ী, গোষ্ঠীর সদস্যরা একে অপরের উপর মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রভাবিত হন এবং একে অপরের আচরণের সমন্বয়ে একটি যৌথ মনোভাব সৃষ্টি হয়। উল্লিখিত পদ্ধতি অনুসারে, সামাজিক অবস্থান, ক্ষমতা, এবং গোষ্ঠী সামাজিকীকরণের প্রভাব একত্রিত হয়ে একটি শক্তিশালী মানসিক অভ্যন্তরীণ মানদণ্ড তৈরি করে।
উদাহরণস্বরূপ, স্কুল বা কর্মক্ষেত্রে একটি ছোট গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব বা শক্তিশালী সম্পর্কের মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র লক্ষ্য স্থির করতে পারে। যখন এই গোষ্ঠীটি বড় আন্দোলনে পরিণত হয়, তখন সেই আন্দোলন বড় পর্যায়ে সমাজে প্রভাব ফেলতে পারে।
সামাজিক আন্দোলন এবং তার তত্ত্ব:
১. সামাজিক আন্দোলন: সামাজিক আন্দোলন হলো এমন একটি সমষ্টিগত প্রচেষ্টা, যা সমাজের মধ্যে বিশেষ ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনার জন্য পরিচালিত হয়। এটি সমাজের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে, এবং দীর্ঘকাল ধরে তার পরিবর্তনের উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে। সামাজিক আন্দোলন সাধারণত জনগণের মধ্যে এক ধরনের সচেতনতা তৈরি করতে এবং একটি যৌথ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংগঠিত হয়।
সামাজিক আন্দোলনের উদাহরণ হিসেবে, ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম, নাগরিক অধিকার আন্দোলন, নারী অধিকার আন্দোলন এবং পরিবেশ আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। এই আন্দোলনগুলি সমাজের মধ্যে গভীর পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। এগুলি প্রথমে কিছু সংখ্যক মানুষের মধ্যে শুরু হলেও, পরে বৃহত্তর জনগণের মধ্যে একাত্মতা তৈরি করে এবং শেষ পর্যন্ত বৃহৎ সামাজিক পরিবর্তন আনতে সফল হয়েছে।
২. সামাজিক আন্দোলনের তত্ত্ব:
- স্ট্রাকচারাল ফাংশনালিজম: স্ট্রাকচারাল ফাংশনালিজম তত্ত্ব অনুযায়ী, সামাজিক আন্দোলনসমূহ সমাজের ভেতর এক ধরণের অস্থিরতা সৃষ্টি করে, যা সামগ্রিক সামাজিক কাঠামোকে শক্তিশালী বা স্থিতিশীল করতে সাহায্য করে। এই তত্ত্বের মতে, সামাজিক আন্দোলন এক ধরনের ব্যবস্থা পুনর্গঠন বা সংহতির লক্ষ্যে সংগঠিত হয়।
- কনফ্লিক্ট থিওরি: কনফ্লিক্ট তত্ত্বের মতে, সামাজিক আন্দোলন ঐতিহাসিকভাবে শ্রেণী সংগ্রাম এবং সামাজিক অসাম্যকে চ্যালেঞ্জ করে। মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে, শ্রেণী বৈষম্য এবং শোষণ সামাজিক আন্দোলনের প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে। এই তত্ত্বের মতে, সমাজের শোষিত গোষ্ঠী নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন শুরু করে।
- ফ্রেমিং তত্ত্ব: সামাজিক আন্দোলন তৈরির প্রক্রিয়া এবং আন্দোলনের কাঠামো ফ্রেমিং তত্ত্বের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়। ফ্রেমিং তত্ত্ব অনুসারে, সামাজিক আন্দোলনের নেতা বা সংগঠকরা একটি কৌশলগত কৌশল অবলম্বন করে, যার মাধ্যমে তারা জনগণকে বিশেষভাবে প্রভাবিত এবং তাদের সমর্থন অর্জন করে।
উপসংহার:
সামাজিক আচরণের তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে, জনসাধারণের বা বৃহৎ জনগণের আচরণ কেবলমাত্র একক ঘটনা নয়, বরং এটি সমাজের কাঠামো, ঐতিহ্য, রাজনৈতিক অবস্থা এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটের মধ্যে বিদ্যমান শক্তিশালী সম্পর্কের ফলস্বরূপ। সামাজিক আন্দোলনগুলো শুধু একটি নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থের জন্য নয়, বরং সমাজের বৃহত্তর সংস্কৃতি ও নীতি পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করে। জনসাধারণের আচরণ, গোষ্ঠী মনোবিজ্ঞান এবং সামাজিক আন্দোলনের তত্ত্বগুলো সমাজের বিশ্লেষণে একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং তারা একটি বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপটে কাঠামোগত পরিবর্তন আনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।