ভূমিকা
সমাজের পরিবর্তন একটি অপ্রতিরোধ্য প্রক্রিয়া যা প্রতিটি সভ্যতা এবং সংস্কৃতিতে সময়ের সাথে সঙ্গে ঘটে থাকে। তবে, সামাজিক পরিবর্তনের ধরন এবং কারণ সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ এবং তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। এর মধ্যে দুটি প্রধান শ্রেণি হলো বিবর্তনবাদী মডেল এবং চক্রাকার মডেল। এই দুটি মডেল সামাজিক পরিবর্তনের প্রকৃতি এবং সময়কালের গতিশীলতা ব্যাখ্যা করার জন্য ব্যবহৃত হয়। সামাজিক পরিবর্তনের তত্ত্বগুলো সমাজের কাঠামো, মানসিকতা, সংস্কৃতি, এবং অর্থনীতির বিকাশের বিভিন্ন প্যাটার্ন এবং দিক বিশ্লেষণ করে।
এই লেখায় আমরা বিবর্তনবাদী মডেল এবং চক্রাকার মডেলসহ সামাজিক পরিবর্তনের অন্যান্য তত্ত্ব এবং তাদের প্রয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করব।
বিবর্তনবাদী মডেল (Evolutionary Models)
বিবর্তনবাদী তত্ত্ব অনুযায়ী, সমাজের পরিবর্তন একটি ধীর ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যা সময়ের সঙ্গে সমাজের কাঠামো ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়। এই তত্ত্বে সমাজের অগ্রগতির ধারণা রয়েছে, যেখানে একটি নির্দিষ্ট ধাপ থেকে পরবর্তী ধাপে স্থানান্তর ঘটে এবং এটি একটি সোজা, একমুখী প্রক্রিয়া।
বিবর্তনবাদী মডেল অনুসারে, সামাজিক পরিবর্তন প্রাকৃতিক নিয়মের মতো একটি ধারাবাহিক এবং নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করে। সমাজের বিভিন্ন দিক যেমন অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, এবং সংস্কৃতি ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়, এবং একটি সমাজের মধ্যে পরিবর্তন ঘটতে থাকে।
উদাহরণ:
ক্যারল মার্কসের দৃষ্টিতে সমাজের বিকাশের একটি বিবর্তনীয় প্রক্রিয়া ছিল, যেখানে তিনি সমাজের পরিবর্তনকে শোষণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, তার মতে, ফিউডাল সমাজ (feudal society) থেকে পুঁজিবাদী সমাজ (capitalist society) পর্যন্ত পরিবর্তন একটি ধীর এবং ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। পুঁজিবাদী সমাজের পরবর্তী স্তর হবে সাম্যবাদী সমাজ (socialist society), যেখানে উৎপাদন ব্যবস্থা ও শ্রেণী বিভাজন বিলীন হয়ে যাবে।
এছাড়া এমিল দারকেইম (Emile Durkheim) সামাজিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে বিবর্তনবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছিলেন। তার মতে, সমাজের পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যেখানে সমাজ ধীরে ধীরে মেকানিক্যাল সলিডারিটি (mechanical solidarity) থেকে অর্গানিক সলিডারিটি (organic solidarity) তে চলে যায়, অর্থাৎ, ছোট এবং একক সমাজ থেকে বৃহত্তর এবং জটিল সমাজে রূপান্তর ঘটে।
চক্রাকার মডেল (Cyclical Models)
চক্রাকার মডেল সামাজিক পরিবর্তনকে একটি পুনরাবৃত্তির প্রক্রিয়া হিসেবে দেখায়। এই মডেল অনুযায়ী, সমাজে পরিবর্তন একদিকে চলে না, বরং সমাজ বারবার একটি চক্র বা ঘূর্ণন অনুসরণ করে, যেখানে একই ধরনের পরিবর্তন আবার ফিরে আসে। এই মডেলটি সামাজিক পরিবর্তনের ধারাকে গতির পরিবর্তনের সাথে তুলনা করে, যেমন ঋতুর পরিবর্তন বা গ্রীষ্ম, শীত, বসন্ত ইত্যাদি চক্র।
এই মডেলের মূল ধারণা হলো, সমাজের ইতিহাসে পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং একটি সমাজের পরিবর্তন কিছু সময় পর আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। সমাজের শাসন, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং রাজনীতি এক পর্যায়ে উন্নত হয়, কিন্তু একদিন সেগুলি আবার পতিত হয় এবং নতুন এক পরিবর্তন চক্র শুরু হয়।
উদাহরণ:
বিশ্ব ইতিহাসে প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো এবং আরিস্টটল সামাজিক পরিবর্তনকে চক্রাকার প্রক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। প্লেটো তার “রাষ্ট্র” (The Republic) গ্রন্থে উল্লেখ করেছিলেন যে, সমাজের শাসন ব্যবস্থা একটি চক্রের মধ্যে ঘোরে, যেখানে আদর্শ রাজতন্ত্র থেকে শুরু করে গণতন্ত্র, তারপর টায়ানির সাপেক্ষে পতন ঘটে, এবং পরবর্তীতে আবার সেই সমাজে রাজতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়।
অস্টিন কельли (Augustus Comte) তাঁর সোসিওলজি এবং পজিটিভিজম তত্ত্বে চক্রাকার পরিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি সমাজের ইতিহাসকে তিনটি প্রধান ধাপে ভাগ করেছিলেন: থিওলজিক্যাল স্টেজ (Theological Stage), মেটাফিজিক্যাল স্টেজ (Metaphysical Stage), এবং পজিটিভ স্টেজ (Positive Stage)। এই পর্যায়গুলি একে অপরকে অতিক্রম করার পর আবার পূর্ববর্তী স্তরের দিকে ফিরে আসে।
অন্য একটি উদাহরণ:
ওয়েস্টার্ন সিভিলাইজেশন (Western Civilization)-এর ইতিহাসও চক্রাকার মডেলের একটি উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। ইউরোপীয় সভ্যতা একাধিক সময়ের মধ্যে পুঞ্জীভূত শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে এবং আবার পুনর্নবীকরণের সময় ফিরে এসেছে। রেনেসাঁস, শিল্পবিপ্লব, আধুনিকতা এবং তার পরবর্তী পরিবর্তনগুলিও একটি চক্রাকারের মতো দেখানো যেতে পারে।
বিবর্তনবাদী ও চক্রাকার মডেলের তুলনা
বিবর্তনবাদী মডেল সামাজিক পরিবর্তনকে একটি সোজা, একমুখী প্রক্রিয়া হিসেবে দেখায়, যেখানে পরিবর্তন একটি সুসংহত, ধারাবাহিক এবং উন্নতির দিকে পরিচালিত হয়। এই মডেল সমাজের অগ্রগতির উপর জোর দেয় এবং ধারাবাহিক বিকাশের ধারণাকে সমর্থন করে।
অন্যদিকে, চক্রাকার মডেল সামাজিক পরিবর্তনকে একটি পুনরাবৃত্তিমূলক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখায়, যেখানে পরিবর্তন একটি চক্রে আবর্তিত হয় এবং প্রায়শই একই ধরনের ঘটনা বারবার ঘটে। চক্রাকার মডেল সমাজের পতন এবং পুনরুজ্জীবনের প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে। এখানে সমালোচনা করা হয়েছে যে, সমাজ সর্বদা একই পর্যায়ে ফিরে আসে এবং কোনো একটি সুনির্দিষ্ট উন্নতির দিকে এগিয়ে যায় না।
উপসংহার
সামাজিক পরিবর্তন একটি জটিল প্রক্রিয়া যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। বিবর্তনবাদী মডেল সমাজের দীর্ঘমেয়াদি ও ধারাবাহিক উন্নতির দিকে ইঙ্গিত করে, যেখানে চক্রাকার মডেল সমাজের পুনরাবৃত্তি এবং স্থায়ীত্বের ধারণাকে সমর্থন করে। তবে, এই দুটি মডেল একে অপরের পরিপূরক হতে পারে, কারণ সমাজের পরিবর্তন কখনও সোজা নয়, কখনও তা চক্রাকারে ফিরে আসে। সুতরাং, সামাজিক পরিবর্তনের প্রকৃতি সম্পূর্ণরূপে একটি নির্দিষ্ট মডেলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বিভিন্ন তত্ত্বের সমন্বয়ে একটি সজীব প্রক্রিয়া যা ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং সমাজের পরিবর্তনশীল প্রকৃতিকে প্রতিফলিত করে।