ভালোবাসার এই দৃপ্ত বলয়ে আবৃত দুটি হৃদয়ের মাঝে থাকে হাসিকান্না, সুখ-দুঃখের সুবিশাল অধ্যায়। যা হতে পারে পরিবারকেন্দ্রিক, ধর্মকেন্দ্রিক, আত্মীয়কেন্দ্রিক, বন্ধুকেন্দ্রিক নিষ্কাম ভালোবাসা।
মোঃ সিরাজুল ইসলাম সোহাগ
‘কতবারও ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া,
তোমারও চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের এই পংক্তির মধ্য দিয়ে প্রেমের প্রতি কবির এক গভীর আকুতির বহিঃপ্রকাশ খুঁজে পাই। রবিঠাকুর প্রেম নিবেদনের অতি উচ্চ ব্যগ্রতা, আকুলতা প্রকাশ করতে এরূপ বহু গান ও কবিতা রচনা করেছেন। প্রেমের প্রতি কবিগুরুর আসক্তির বহিঃপ্রকাশ শুধু রচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর বাস্তব জীবনের ক্রিয়াকর্মেও। নারীর প্রতি অনুরাগ যেন কবি-সাহিত্যিকদের রচনায় নতুনরুপে, ভিন্ন ভিন্ন অভিধায় চিত্রিত হয়ে বারবার ফিরে আসে পাঠককুলের তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধিত মন ও মননে। ‘প্রেম নিবেদন, প্রেমের প্রতি আকুলতা’- কবি-সাহিত্যিকদের মর্মস্পর্শী রচনা যেন মানুষের হৃদয়ে নতুন প্রকম্পন সৃষ্টি করে। নিয়ে আসে প্রাণের উল্লাস, সজীব-তরুন-প্রাণবন্ত অনুরাগ। আবার ভিন্ন এক ভাবধারার লেখক নজরুল ইসলাম বাবু লিখেছেন – ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে একটি কথাই জেনেছি,পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’! কি বিচিত্র সাংঘর্ষিক প্রেমানুভুতি!! আসলেই প্রেমের অনুভুতি গুলো এরূপ ব্যক্তি বিশেষে মনো আঙ্গিকের ভিন্নতা হেতু স্বতন্ত্র হয়।
আধুনিক যুগে প্রেম পাগল মানুষের জগতে যে অভিধাটি বহুল আলোচিত ও সমালোচিত তা হল -ভালোবাসা। শৈশব-কৈশোর-যৌবন-বৃদ্ধা এইরুপ চক্রাকার জীবন প্রক্রিয়ার এক পরিণত অধ্যায়ে মানুষ ভালোবাসা তথা সম্পর্কের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। যা তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি। সে চায় তাঁর একজন সঙ্গী। যাকে জীবনের নিগুঢ় গুপ্ত কথাগুলো শেয়ার করে সে প্রশান্তি পাবে, যে তাঁকে বুঝবে, উপলব্ধি করতে পারবে এবং সর্বোপরি দিতে পারবে জীবন চলার অমৃত। কেউ পেয়েও যায়, আবার কেউ পায় না। আবার অনেকে পেলেও তাঁর গুরুত্ব বুঝে উঠতে পারে না। ভালোবাসা দুটি হৃদয়কে এক করে দেয়ার এক অন্যন্য অদৃশ্য অনুঘটক। আর ভালোবাসার শক্তি এখানেই। অনুরাগ মানে আমৃত্যু একই বন্ধনে থাকার প্রত্যয়। যেখানে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ও প্রত্যাশার হিসাব করা নেহাত বোকামির সামিল। শুধু বোকামি বললে হয়তো ভুল বলা হবে। তা স্বার্থপরতার সামিল।
ভালোবাসার এই দৃপ্ত বলয়ে আবৃত দুটি হৃদয়ের মাঝে থাকে হাসিকান্না, সুখ-দুঃখের সুবিশাল অধ্যায়। যা হতে পারে পরিবারকেন্দ্রিক, ধর্মকেন্দ্রিক, আত্মীয়কেন্দ্রিক, বন্ধুকেন্দ্রিক নিষ্কাম ভালোবাসা।
আসলে ভালোবাসার অতিদীর্ঘ বিস্তার, ব্যাপকতা ও ব্যাপ্তির জন্য সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা একটু কঠিনই বটে। তবে মনে রাখা শ্রেয় ভালোবাসা শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলের মধ্যেই আবদ্ধ নয়। তা হতে পারে পোষা প্রাণী, বৃক্ষ-প্ললব, নদী-নালা, শিশির বিন্দু, মেঘ,বৃষ্টি, আহত কোকিল, ঘাসফড়িং, সুশৃঙ্খল পিঁপড়ের ঝাঁক, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মঠ, তথা সমুদয় সৌন্দর্যের সঙ্গে। এককথায় ভালোবাসা হলো স্নেহের বলদৃপ্ত বহিঃপ্রকাশ।
আশেপাশের মানুষজনের সম্পর্ক, প্রেম ও ভালোবাসার রূপরেখা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় কিসের ভিত্তিতে চলছে জীবনের গতি? প্রেম নাকি গুরুত্ব? সহসা দেখা যায় একজন আর একজন না জেনেই, না শুনেই, শুধুমাত্র আবেগের বশবর্তী হয়ে প্রেম বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তখন ভর করে বসে অবিশ্বাস ও সন্দেহের পাহাড়। যা সম্পর্ককে ভঙ্গুর করার অন্যতম নিয়ামক। আমাদের সমাজে একটি ডগমা আছে- ভালোবাসায় সন্দেহ থাকা অনেকখানি ভালো এতে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায়। এই কথাটি একেবারেই ভিত্তিহীন। কারণ মূল কথা হলো যেখানে সন্দেহ আসে সেখানে ভালোবাসা থাকতে পারে না। একজন সন্দেহপ্রবন ব্যক্তি কোনোভাবেই মন থেকে ভালোবাসার ক্ষমতা রাখেন না। সন্দেহ প্রবণতা একটি সুখী সম্পর্কে ভাঙন ধরিয়ে দিতে পারে খুব সহজে। নারী-পুরুষের মাঝে প্রেম-ভালোবাসার এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে স্থায়ী ও মধুময় করার ক্ষেত্রে যে নিয়ামকটি অমৃত হিসাবে কাজ করতে পারে তা হলো-গুরুত্ব। কারণ প্রেম-ভালোবাসা একটি আপেক্ষিক বিষয়। যা পরিমাপের কোন সুনির্দিষ্ট একক নেই। এক-‘গুরুত্ব’ ছাড়া। আপনি যখন কোন বিষয়কে অনেকবেশি গুরুত্ব দিবেন তখন দেখবেন সেই জিনিসটার প্রতি আপনার একরকম অনুরাগ জন্মেছে। যা পরোক্ষভাবে গুরুত্বেরই নামান্তর। গুরুত্ব দেয়ার প্রক্রিয়াটি চলমান থাকলে তার প্রতি আপনার আসক্তি জন্মে যাবে। তখন অনেক চেষ্টা করেও এই অদৃশ্য অনুরাগের গন্ডি থেকে বের হওয়া যায় না। কিন্তু আপনি যদি কোনক্রমে ঐ বিষয়টির প্রতি আপনার পূর্বের দেয়া গুরুত্বের মাত্রা, তীব্রতা ও ব্যাপ্তি কমিয়ে নিয়ে আসতে পারেন। তাহলে দেখবেন সেটা ক্রমেই আপনার কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। এই বিষয়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যে বিষয়টিকে আপনি বহু মাত্রায় গুরুত্ব দিচ্ছেন সেটি আপনার জীবনে কতটা ইতিবাচক বা কতটা নেতিবাচক সেটার নিখুঁত বিশ্লেষণ প্রয়োজন। অন্যথায় ইতিবাচকতার চেয়ে নেতিবাচকতার মাত্রা-গভীরতা বেশি হলে জীবনকে বিপদাপন্ন করবে। ঠেলে দিবে অশান্তির কণ্টকাকীর্ণ পথে।
যেমন ধরুন, আপনি স্বেচ্ছাসেবী কর্মকাণ্ডের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন; গান শুনতে, ছবি আঁকতে বা বই পড়তে, লিখতে ভালোবাসেন; অথবা কাউকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বিবেচনা করে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন বা দিয়ে ফেলেছেন। গতিশীল জীবনের গতিময়তায় আচ্ছন্ন থেকে জীবন চলার পথে এইরুপ নানা বিষয়ে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ি, যাকে প্রেম, আসক্তি বা অভ্যাস বলতে পারি।
এখন বিবেচনা করে দেখতে হবে এসব আসক্তি বা অভ্যাস আপনার জীবনে কতটা ইতিবাচক গতি দিচ্ছে বা ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যদি ইতিবাচক হয়-তেমন আসক্তি বা অভ্যাস থাকতে পারে। তবে যদি তা আপনার সামাজিক পরিস্থিতি বা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তাহলে তাকে গুরুত্ব দেওয়া ছেড়ে দিতে হবে। অন্য কিছুতে মনোযোগ বাড়াতে হবে। এতে মনঃসংযোগ কনভার্ট হতে বাধ্য। আর মনঃসংযোগ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পারলেই আসক্তির বিনাশ। এখানে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। শৈশবে গোধূলি বেলায় পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে যাওয়ার অমলিন স্মৃতি। মায়ের শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও সারা দিন-রাত ধরে প্রস্তুতি চলত বিকালে খেলব বলে। তখন খেলাটাই ছিল একটা বিশেষ অভ্যাস, আবার আসক্তিও বলা যেতে পারে। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বোধহয় উদয়ের পরিক্রমায় যখন একটা সময় মনে হলো, পরীক্ষা আসন্ন, এখন খেলার চেয়ে পড়ালেখা করা বেশি জরুরি। পরীক্ষায় ভালো ফল করা জরুরি। আস্তে আস্তে পড়ার প্রতি মনোযোগ চলে আসে। খেলার নেশা কেটে যায়।
এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট। বিষয়টি হলো-গুরুত্ব। একটা সময় মনে হচ্ছিল খেলাটাই জীবনের সবকিছু। তখন অন্যকিছুর চেয়ে খেলাধুলাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল। কিন্তু ক্রমেই পড়াশোনার গুরুত্ব বেড়ে চলল। এখন আর বিকেলের ধুলোমাখা খেলাধূলা করতে যাওয়া হয় না। কারণ একটাই- তাঁর গুরুত্ব এখন নেহাত কম।
তেমনি সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্ব না থাকলে তা ভেস্তে যেতে ন্যানোসেকেন্ড ও সময় লাগে না।
তবে একটা গবেষণায় প্রমানিত যে-পৃথিবীতে যত রকমের সম্পর্ক আছে তন্মধ্যে পারিবারিক সম্পর্ক বা পরিবারকেন্দ্রিক সম্পর্ক ই বেশি স্থায়ী ও সুখের।
নৃবিজ্ঞানের পরিভাষায় ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এটা বোধগম্য হয় যে আবহমান কাল থেকে আমাদের দেশে এক অতুলনীয় পারিবারিক, সামাজিক, নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন ছিল; কিন্তু বিশ্বায়নের কড়া থাবায় সুদীর্ঘ কাল থেকে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার মূল্যবোধ মুহ্যমান হয়ে পড়ছে। এই মূল্যবোধ হারানোর হেতু বিচার-বিশ্লেষণ করলে বেরিয়ে আসে পাশ্চাত্য আভিজাত্য তথা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ, অনুসরণ ও আনুগত্য।
আমাদের তথাকথিত এক শিক্ষিত শ্রেনীর মধ্যেই এই ভয় সর্বদা কাজ করে যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুকরণ, অনুসরণ ব্যতীত আমরা আলোকিত তথা সভ্য জাতি হতে পারবো না! যা গোঁড়ামি ও অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই নয়। এইরুপ গোঁড়ামি চিন্তাভাবনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সমাজের এক বিশাল অংশ নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়ে পরিণত হচ্ছে অন্তঃসারশূন্য, অনুকরণপ্রিয় ও পাশ্চাত্য ভাবধারায় উজ্জীবিত ভোগবাদী জনগোষ্ঠী ও তস্কর শ্রেণিতে। সমান্তরালে অজ্ঞতার কারণে পারিবারিক সম্পর্ক ক্রমেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সভ্যসমাজে অনুপ্রবেশ ঘটছে অন্ধত্বের, আকাশ সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতির। পরিণাম, সমাজ এগিয়ে চলছে অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে।
একটি বিষয় খেয়াল করলেই সম্পর্কের হিসাব-নিকাশ একটু স্পষ্ট হয়ে উঠে-পৃথিবীতে ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে তিনটি শব্দের উৎপত্তি —Boyfriend, Girlfriend, Family। একটু অবচেতন মনে খেয়াল করলে দেখবেন- Boyfriend ও Girlfriend এই শব্দ দুটির শেষের অংশ হলো end। তাই এই সম্পর্কগুলো ভঙ্গুর হয়, একদিন শেষ হয়ে যায়। আর তৃতীয় শব্দটি হলো Family, যার প্রথম তিনটি অক্ষর Fam-কে বিস্তৃত করলে আমরা পাই Father and Mother এবং শেষের তিনটি অক্ষর ily-কে বিস্তৃত করলে পাই I love you, যার শুরু মা-বাবাকে নিয়ে এবং শেষ তাঁদের ভালোবেসে। এই বিশ্লেষণটিতে প্রতীয়মান পারিবারিক জীবন পৃথিবীর যেকোনো আপদ-বিপদ থেকে মানুষকে নিরাপদ ও মানসিকভাবে সবল রাখে। যোগায় জীবন চলার জীয়নকাঠি।জীবনের কোনো বাধা অতিক্রম করতে যে মানসিক শক্তির প্রয়োজন, তা আসে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা থেকে। মা-বাবার সন্তুষ্টির জন্য অনেক সন্তানই হাসিমুখে নিরন্তর পরিশ্রম করে যেতে পারে। তদ্রূপ মা-বাবাও তাঁর সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে যেকোনো কষ্ট হাসিমুখে সয়ে যান। সুতরাং পার্থিব ও পারলৌকিক যেকোনো কাজে সফলতা অর্জনের জন্য প্রেরণা ও উদ্দীপনা মানুষ পায় তার সুস্থ পারিবারিক জীবন থেকে। প্রতীয়মান -পারিবারিক সম্পর্কই আসল সম্পর্ক।
তবে পারিবারিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করার সময় একটি মানুষকে অনেক বাধা-বিপত্তির, সুখ-দুঃখের স্বাদ নিতে হয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখা শ্রেয় পৃথিবীতে সুখহীন দুঃখ আর দুঃখহীন সুখ কোনো সম্পর্কের মধ্যেই নিহিত নেই। প্রকৃতির চিরচেনা রুপ যেমন প্রাকৃতিক নিয়মেই সহসা বদলায় ঠিক তেমনি মানুষের জীবন ও একরকম থাকে না। যে সকালে আকাশ ঝকঝকে পরিস্কার,ঝকঝকে রোদে পরিপূর্ণ; তার আগের বা পরের রাতে সেই আকাশ ঝড় বয়ে আনবে না তার কি নিশ্চিয়তা আদৌ আছে? অর্থ্যাৎ ব্যক্তিজীবনে কোনো সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা নেই যা চিরস্থায়ী। সবকিছু ই ক্রমপরিবর্তনশীল। পরিবারকেন্দ্রিক সম্পর্কও তাঁর ব্যতিক্রম নয়।
লেখকঃ
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
যোগাযোগঃ shirazulislam1997@gmail.com
Writing is not a view of the School of Thought, it is entirely the opinion of the Author.
If you want to share your thought, you can mail us at- editor.sot@gmail.com