আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল দিক হচ্ছে সমষ্টিগত নিরাপত্তা (Collective Security), যা রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে একটি সংহত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৈশ্বিক শান্তি এবং নিরাপত্তা বজায় রাখার চেষ্টা করে। এটি এমন একটি তত্ত্ব এবং কাঠামো যা বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতা এবং পারস্পরিক প্রতিশ্রুতি ভিত্তিক একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে, যাতে এক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হামলা করলে তা সমস্ত সদস্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হামলা হিসেবে গণ্য হয় এবং ঐ হামলার বিরুদ্ধে একত্রিতভাবে প্রতিরোধ করা হয়। এই তত্ত্বের মূল উদ্দেশ্য হলো একটি বৈশ্বিক নিরাপত্তা পরিবেশ সৃষ্টি করা, যেখানে শক্তির ভারসাম্য বজায় রেখে যেকোনো ধরনের আগ্রাসন এবং সহিংসতা প্রতিরোধ করা হবে। তবে, সমষ্টিগত নিরাপত্তা তত্ত্বের বাস্তবায়ন নিয়ে অনেক বিতর্ক এবং জটিলতা রয়েছে, বিশেষত যখন রাষ্ট্রগুলো তাদের জাতীয় স্বার্থ এবং বৈশ্বিক শান্তির মধ্যে ভারসাম্য রাখতে চায়।
সমষ্টিগত নিরাপত্তা তত্ত্বের ভিত্তি
সমষ্টিগত নিরাপত্তার তত্ত্বটি প্রথম দিকে আধুনিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ২০শ শতকের প্রথম দিকে, বিশেষ করে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর। জাতিসংঘের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে শান্তি এবং নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং আন্তর্জাতিক আইন এবং সহযোগিতার মাধ্যমে যুদ্ধ প্রতিরোধ করা। এই তত্ত্বের কেন্দ্রীয় ধারণা হলো যে, একক রাষ্ট্রের শক্তি এবং নিরাপত্তা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ, কোন একটি দেশ যদি আক্রমণের শিকার হয়, তবে তা সব সদস্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে এবং তাই প্রত্যেকটি রাষ্ট্র একে অপরকে সাহায্য করতে বাধ্য থাকবে।
এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হচ্ছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ (United Nations Security Council) যেখানে ১৫টি সদস্য রাষ্ট্র রয়েছে এবং যাদের মধ্যে ৫টি স্থায়ী সদস্য (চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র) এবং ১০টি অস্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র থাকে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বিভিন্ন সংঘাত এবং সংকটের ক্ষেত্রে সমষ্টিগত নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলো একত্রে কাজ করার মাধ্যমে কোনও আক্রমণ বা সহিংসতা মোকাবেলা করার চেষ্টা করে।
জাতীয় স্বার্থ বনাম বৈশ্বিক শান্তি
যতটা গুরুত্বপূর্ণ সমষ্টিগত নিরাপত্তা তত্ত্ব, ঠিক ততটাই জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং তা বাস্তবায়ন করা। মূল সমস্যা আসে যখন রাষ্ট্রগুলো তাদের জাতীয় স্বার্থ এবং বৈশ্বিক শান্তির মধ্যে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করে। প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজস্ব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক স্বার্থ থাকে, যা কখনো কখনো বৈশ্বিক শান্তির লক্ষ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কখনো কখনো একটি রাষ্ট্র তার নিজেদের অর্থনৈতিক বা সামরিক স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে বৈশ্বিক শান্তি এবং নিরাপত্তাকে উপেক্ষা করতে পারে। এর ফলে সমষ্টিগত নিরাপত্তা কাঠামোর প্রতি আস্থাহীনতা সৃষ্টি হতে পারে এবং সঠিকভাবে তা কার্যকর করা কঠিন হয়ে পড়ে।
একটি প্রধান উদাহরণ হতে পারে ইরাক যুদ্ধ (২০০৩)। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা দাবি করেছিল যে, ইরাক তার ভূখণ্ডে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে এবং তা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য একটি হুমকি। তবে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেক দেশ এই যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, কারণ তারা মনে করেছিল যে এটি কেবল যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য ছিল এবং এটি বৈশ্বিক শান্তির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এই পরিস্থিতি সমষ্টিগত নিরাপত্তার ধারণার বিরুদ্ধে একটি বড় প্রশ্ন তৈরি করেছিল, কারণ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্ররা সমষ্টিগতভাবে একমত হতে পারেনি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়েছিল।
সমষ্টিগত নিরাপত্তার কার্যকারিতা
সমষ্টিগত নিরাপত্তা তত্ত্ব সাধারণত কাজ করে যখন বিভিন্ন রাষ্ট্র তাদের স্বার্থ একত্রে মিলিয়ে আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য কাজ করতে সম্মত হয়। কিন্তু, যখন রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, তখন এই তত্ত্ব কার্যকর হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে, শীতল যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে (১৯৪৭-১৯৯১), সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সমষ্টিগত নিরাপত্তার প্রয়োগ অনেকাংশে ব্যাহত হয়েছিল, কারণ তারা একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল এবং তাদের নিজ নিজ স্বার্থের পক্ষে কাজ করছিল। বিশেষ করে, সিরিয়া যুদ্ধ এবং ইয়েমেন যুদ্ধ এর মতো যুদ্ধগুলোতে দেখা গেছে যে, যখন আন্তর্জাতিক শক্তিগুলি তাদের নিজস্ব স্বার্থ এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষা করতে চেয়েছে, তখন সমষ্টিগত নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এর মধ্যে এক বিশেষ ঘটনা ছিল ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডা গণহত্যা, যেখানে জাতিসংঘ বাহিনী অত্যন্ত সীমিত উপায়ে হস্তক্ষেপ করেছিল। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি রুয়ান্ডার পরিস্থিতি রোধ করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছিল, কারণ তখন সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলির স্বার্থ এবং কার্যকর সহযোগিতার অভাব ছিল। এই ধরনের উদাহরণগুলি সমষ্টিগত নিরাপত্তার দুর্বলতা এবং জাতীয় স্বার্থের শীর্ষে থাকার ফলে বৈশ্বিক শান্তি রক্ষা করার অসুবিধা তৈরি করে।
কেস স্টাডি: লিবিয়া ২০১১
২০১১ সালে লিবিয়ার গাদ্দাফির শাসন পতনের সময় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সমষ্টিগত নিরাপত্তার মাধ্যমে হস্তক্ষেপ করেছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ লিবিয়ায় গাদ্দাফির বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের সহায়তার জন্য সামরিক হস্তক্ষেপের অনুমতি দিয়েছিল। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা যেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সমষ্টিগত নিরাপত্তার লক্ষ্যে একত্রিত হয়ে একটি শাসককে উৎখাত করার জন্য সামরিক ব্যবস্থা নিয়েছিল। তবে, এই অভিযানটি অনেক দেশ এবং বিশ্লেষকদের মধ্যে বিতর্কের জন্ম দেয়, কারণ তারা মনে করেছিল যে, এটি লিবিয়ার অভ্যন্তরীণ সমস্যা ছিল এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজনীয় ছিল না।
এটি আবারও প্রমাণ করে যে, সমষ্টিগত নিরাপত্তা তত্ত্ব সফল হতে পারে যদি রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে মিলিত উদ্দেশ্য এবং ঐক্যমত্য থাকে, কিন্তু যখন একে অপরের স্বার্থ বিবেচনা করা হয়, তখন কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যা হতে পারে।
উপসংহার
সমষ্টিগত নিরাপত্তা তত্ত্ব আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা বৈশ্বিক শান্তি এবং নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য রাখে। তবে, রাষ্ট্রসমূহ যখন তাদের নিজস্ব স্বার্থকে প্রাধান্য দেয় এবং বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একত্রিত হওয়ার আগ্রহ হারায়, তখন এই তত্ত্বের কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই ধরনের জটিল বাস্তবতায়, সমষ্টিগত নিরাপত্তার প্রয়োগে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং মতবিনিময়ের প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়ে যায়।