সত্যের ধাঁধা

কিন্তু কেউ যেন চিৎকার করে বলে ওঠে সত্যের পতাকা বলে কিছু নেই।

নাজিফা আঞ্জুম

আজ বহুদিন পর কিছু একটা লিখতে বসলাম। কী লিখবো জানিনা তবে সত্যিটা লিখা যাবেনা। সত্য আমি ভয় পাই, প্রচন্ড ভয় পাই। সত্যের প্রখরতা ভয় পাই, ভয় পাই সত্যের অসহনীয় দয়ার দৃষ্টি। সত্যের কঠোরতা ভয় পাই, ভয় পাই আমি সত্যের অদ্ভুত বিলাসিতার সৃষ্টি। 

মোটামুটি বড় হয়েই শিখেছি সবসময় সত্যি বলতে নেই। 

শিখেছিলাম সেই গুরুর কাছে যাকে দেখে ইচ্ছে জেগেছিলো স্বাক্ষর দেবো আমি বাংলায়। দেশ বিদেশের ভারী ভিড়ের মাঝে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করে বেড়াবো। সেই গুরুর কাছেই প্রথম আমার মিথ্যের হাতেখড়ি। না না, তিনি আমায় মিথ্যা শেখাননি, তিনি তো সত্যের প্রতিমা। ভুলের স্রোতে এক একলা সত্যের পাথর হতে শেখান তিনি। ক্ষমতার সম্মুখে হাঁটু না কাঁপিয়ে মাথা উঁচু করে ভুলকে দাপিয়ে বেড়ানো শেখান তিনি। তাঁকে কখনো বলা হয়ে ওঠেনি আমার জীবনে তাঁর অবস্থান, কখনো বলা হয়ে ওঠেনি আমার শিরদাঁড়া প্রাপ্তিতে তাঁর অসীম অবদান।

সত্য এমন এক পর্বতের চূড়া যেখানে দাঁড়িয়ে যেমন সবকিছুই দৃশ্যমান ঠিক তেমনি ভুল স্থানে পা ফেললে খাড়া ঢালবিশিষ্ট তিক্ততার শিকার হয়ে গভীর খাঁদে নিক্ষিপ্ত হওয়াও অনিবার্য।

মিথ্যা বলে বিপদ কাটানোর সৈনিক যখন প্রথমবারের মতো মেরুদন্ড পেয়ে সত্যের পতাকা তলে জড়ো হতে যায় ঠিক তখনই যেন দমকা হাওয়া হন্য হয়ে জম্পেশ আড্ডায় মেতে ওঠে। সেই সৈনিক তখন এই নির্মম বাস্তবতাকে কেবলই ভাগ্যের পরিহাস ভেবে আবারো উঠে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু কেউ যেন চিৎকার করে বলে ওঠে সত্যের পতাকা বলে কিছু নেই।

মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ যদি সত্য মিথ্যা হয়, মুদ্রার এপিঠে আমি সৃজনকণ্ঠ ওপিঠে তোমার হৈ চৈ। আমি যদি বলি মানি না যৌতুক তুমি বলবে কই; উপহারের নামেও যে প্রতিনিয়ত এই জঘন্য কুপ্রথাকে বাঁচিয়ে রাখছো তা বললেই আমি অসামাজিক আমি বেয়াদব। বিদায়বেলার ঐ শুভ সমাপ্তিটার পেছনের বিদঘুটে গল্পটা কি আসলেই সবাই-ই ভুলে যায়! আমার যৌতুক মুদ্রার হেড আর তোমার উপহার নাহয় টেইল।

এবার বলো আমি অসামাজিক বেয়াদব না তুমি সমাজের সত্য?

 লক্ষ লক্ষ টাকার বিয়ে সাজিয়ে বড় অঙ্কের দেনমোহর চাওয়াটা তুমি তোমার অধিকার ভাবো। বিয়েটা সহজ, বরং সামাজিক বুদ্ধিজীবীরাই কঠিন বললেই আমি অসামাজিক বেয়াদব হয়ে যাই। তুমি আমায় প্রেমের মাধুর্যতা গুনিয়ে গুনিয়ে শিক্ষিত করতে চাও। আচ্ছা, তোমার প্রিয় অবুঝ কেউ যখন জিজ্ঞাসু মনে উত্তর না পায় কোথায় যায় খবর রাখো তো? তার কৌতূহল অবশেষে কোন পরিণতি পায় সে খবর রাখো তো তুমি? এ দায় আমার অসামাজিক বেয়াদবির না তোমার সামাজিক সত্যের? দিনশেষে কে জিতলো বলো তো? মুদ্রার এপিঠ? না ওপিঠ?

শুনেছি আমরা সবাই ই নাকি কারো না কারো গল্পের খলনায়ক।

 জানো, আমি পতিতালয় ঘৃণা করি আর তারা আমাকে কারণ একবার ভুল পথে হাঁটা দিয়ে ফেলায় সেই একমুখী পথ থেকে আর ফেরার সুযোগ না দেওয়ায় সেই পতিতালয়ই তাদের মাথা গোঁজার একমাত্র ঠাঁই। কখনো তো তাদের মানবতার চোখেও দেখিনি, ফিরিয়ে এনে সুস্থ সুন্দর জীবন দেয়া তো নিছক স্বপ্ন মাত্র। সত্যটা তবে কার? আমার? না তাদের? তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের চাঁদাবাজি আর দুর্ব্যবহারে সবাই অতিষ্ট। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ; মানুষ হিসেবে দেখেছি কখনো? 

মানুষ হিসেবে ন্যূনতম সম্মানটাই তো দিতে পারলাম না, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য কাজ কী করে দেবো।

স্কুলের সমাবেশে দাঁড়িয়ে সদা সত্য কথা বলিব বলে শপথ নেওয়াটা যতটা সহজ ও সুন্দর, বাস্তবের সত্যটা ততটাই কঠিন এবং কুৎসিত। সত্য সর্বদা সুন্দর হয়না, আর না সর্বদা স্বচ্ছ হয়। সত্যের এই ধাঁধাটাই শিখতে অনেকটা বছর লেগে গেছে। ধাঁধার উত্তরটা কোথায় পাবো তা জানতে না জানি কত বছর লেগে যায়।

লেখক

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 

যোগাযোগঃ nazifaanjum3939@gmail.com

The writing is not a view of the School of Thought, it is entirely the opinion of the Author. 

If you want to share your thought, you can mail us at- thoughtinitiatewrite@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *