সংঘাততত্ত্বএবংসামাজিকঅসমতারমোকাবিলায়এরপ্রাসঙ্গিকতা

সমাজবিজ্ঞানে সংঘাত তত্ত্ব একটি মৌলিক তত্ত্ব যা সমাজে বিদ্যমান শক্তি, সম্পদ এবং ক্ষমতার বৈষম্যকে কেন্দ্র করে আলোচনা করে। সংঘাত তত্ত্বের মূল ভিত্তি হলো যে সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও শ্রেণী একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘাত এবং বিরোধের মধ্যে থাকে। এই তত্ত্বের মাধ্যমে সামাজিক শ্রেণীর মধ্যে সমতা এবং বৈষম্য বুঝতে সাহায্য হয়, যা বিশেষ করে সামাজিক অসমতার বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ লেখা সংঘাত তত্ত্বের মূল ধারণা, এর সামাজিক অসমতার মোকাবিলায় প্রাসঙ্গিকতা এবং আধুনিক সমাজে এর প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করবে।

সংঘাত তত্ত্বের সংজ্ঞা এবং মৌলিক ধারণা

সংঘাত তত্ত্বের মূল উৎপত্তি কা্র্ল মার্ক্স (Karl Marx) এর কাজ থেকে। মার্ক্সের মতে, সমাজে দুটি প্রধান শ্রেণী বিদ্যমান—পুঁজিপতি শ্রেণী (bourgeoisie) এবং শ্রমিক শ্রেণী (proletariat)। এই দুই শ্রেণীর মধ্যে শক্তির এবং সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘাত বিদ্যমান থাকে। পুঁজিপতি শ্রেণী শ্রমিকদের উপর শোষণ চালায়, ফলে সমাজে বৈষম্য এবং অসমতা সৃষ্টি হয়।

এছাড়া, ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber) এবং আরও পরে অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানীরা সংঘাত তত্ত্বের বিকাশ ঘটান। ওয়েবার দাবি করেন যে, শুধুমাত্র অর্থনৈতিক শ্রেণী নয়, বরং সামাজিক মর্যাদা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতারও এই সংঘাতের মধ্যে ভূমিকা থাকে। অর্থাৎ, সংঘাত তত্ত্ব কেবল শ্রেণীসংঘাত নয়, বরং ক্ষমতার সম্পর্কেরও একটি তত্ত্ব হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

সামাজিক অসমতার মোকাবিলায় সংঘাত তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা

১. শ্রেণীসংঘাত এবং সামাজিক বৈষম্য

সংঘাত তত্ত্বের ভিত্তি হলো শ্রেণীসংঘাত। সমাজে শ্রেণী ভিত্তিক বিভাজন এবং ক্ষমতার অসম বন্টন একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিকোণ। শ্রমিক শ্রেণী, যারা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জড়িত, তাদের অধিকার এবং অবস্থান সাধারণত পুঁজিপতি শ্রেণীর তুলনায় কম থাকে। এই অসমতা কাজের সুযোগ, উপার্জন, জীবনযাত্রার মান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলে।

উদাহরণস্বরূপ, আধুনিক সমাজে শ্রমিক শ্রেণী, বিশেষত নিম্নআয়ের শ্রমিকরা, তাদের কাজের পরিমাণের তুলনায় খুব কম পারিশ্রমিক পান। এই অসাম্য সমাজে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অসমতা সৃষ্টি করে, যা সংঘাত তত্ত্বের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা সম্ভব।

২. অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং ক্ষমতার অসম বন্টন

ফাংশনালিস্ট তত্ত্বের বিপরীতে, সংঘাত তত্ত্ব মনে করে যে, সমাজের বৈষম্য স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক নয়, বরং এটি অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোর ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয়। পুঁজিপতি শ্রেণী তাদের ক্ষমতা এবং সম্পদকে নিয়ন্ত্রণ করে, যা শ্রমিক শ্রেণীর উপর শোষণের প্রেক্ষাপট তৈরি করে। এই শোষণ শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান কমিয়ে দেয় এবং তাদের সুরক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে বাধ্য করে।

উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে, যেখানে লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, পুঁজিপতি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের শ্রমের জন্য অত্যন্ত কম মজুরি প্রদান করে। তাদের কর্মঘণ্টা দীর্ঘ হলেও, তাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা এবং জীবনের অন্যান্য মৌলিক চাহিদা উপেক্ষিত থাকে। এই অবস্থা সমাজে সংঘাত সৃষ্টি করে এবং সামাজিক অস্থিরতা তৈরির জন্য একটি প্রেক্ষাপট তৈরি করে।

৩. বর্ণবাদ, লিঙ্গ বৈষম্য এবং অন্যান্য সামাজিক অসাম্য

সংঘাত তত্ত্ব কেবল অর্থনৈতিক বৈষম্য নয়, সামাজিক মর্যাদা, জাতীয়তা, ধর্ম এবং লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যও বিশ্লেষণ করে। সমাজে যে ধরনের সামাজিক শ্রেণী এবং গোষ্ঠী রয়েছে, তাদের মধ্যে ক্ষমতার এক ধরনের অসম বন্টন থাকে। সুতরাং, সংঘাত তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা দেখতে পারি কীভাবে বর্ণবাদ, লিঙ্গ বৈষম্য, এবং জাতিগত বৈষম্য সমাজে এক ধরনের সংঘাত এবং বৈষম্য সৃষ্টি করে।

উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাপারথেইড নীতি ছিল একটি একান্ত বর্ণবাদী সমাজ ব্যবস্থা যেখানে সাদা জাতি ও অন্যান্য জাতির মধ্যে অত্যন্ত বৈষম্য ছিল। এখানকার সাদা জাতি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে শীর্ষে অবস্থান করত, যেখানে অন্য জাতিগুলি শোষিত হত। এই বৈষম্য ছিল এক ধরনের সংঘাতের ফলস্বরূপ এবং সংঘাত তত্ত্বের মাধ্যমে এটি বিশ্লেষণ করা সম্ভব।

৪. শোষণ এবং প্রতিবাদ আন্দোলন

সংঘাত তত্ত্ব সামাজিক শোষণের ধারণাকে শক্তিশালীভাবে প্রাধান্য দেয়। শ্রমিক শ্রেণী বা নিপীড়িত গোষ্ঠী তাদের শোষণ, বৈষম্য এবং অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে থাকে। এসব আন্দোলন সমাজে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে। উদাহরণস্বরূপ, শ্রমিক আন্দোলন, নারীর অধিকার আন্দোলন এবং কৃষক আন্দোলন এই ধরনের শোষণ ও সংঘাতের প্রতিক্রিয়া হিসেবে উঠে আসে।

বর্তমানকালের ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার (Black Lives Matter) আন্দোলন একেবারে সংঘাত তত্ত্বের প্রতিফলন। এই আন্দোলনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের দ্বারা কালো মানুষদের শোষণ এবং হত্যার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ আন্দোলন হিসেবে গড়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে দেখা যায় যে, সমাজের শোষিত শ্রেণী তাদের অধিকার আদায়ের জন্য ক্রমাগত সংঘাত সৃষ্টি করছে।

৫. রাজনৈতিক ক্ষমতার সংঘাত

রাজনৈতিক ক্ষমতাও সংঘাত তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রাজনৈতিক শ্রেণী এবং শক্তির মধ্যে বিভাজন সমাজের অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে। রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্র, সরকার, এবং কর্পোরেট শক্তি একে অপরের বিরুদ্ধে থাকলেও, এটি সামাজিক অসমতা এবং সংঘাতের ভিত্তি গড়ে তোলে।

সমালোচনা এবং সীমাবদ্ধতা

যদিও সংঘাত তত্ত্ব সামাজিক বৈষম্য এবং সংঘাতের সঠিক বিশ্লেষণ দেয়, এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রথমত, এটি সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যকার সহযোগিতা এবং সমন্বয়কে উপেক্ষা করে। সংঘাত তত্ত্ব সবসময় সামাজিক ঐক্য এবং সমঝোতার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো চিহ্নিত করতে পারে না।

দ্বিতীয়ত, সংঘাত তত্ত্ব প্রায়শই সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন বা উন্নতি কীভাবে ঘটবে তা ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। এটি প্রায়শই সংঘাতের নেতিবাচক দিকের উপরেই জোর দেয় এবং সমাজের সামগ্রিক অগ্রগতি বা পুনর্গঠনের জন্য কোন সুপারিশ করে না।

উপসংহার

সংঘাত তত্ত্ব সমাজের বৈষম্য, শোষণ এবং ক্ষমতার অসম বন্টন বিশ্লেষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন গোষ্ঠী ও শ্রেণীর মধ্যে সংঘাত এবং তাদের প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারি। এটি সামাজিক পরিবর্তন এবং উন্নতির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে এবং সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে সাহায্য করে। যদিও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবে এর মাধ্যমে আমরা সামাজিক অসাম্য এবং সংঘাতের প্রকৃতি আরো ভালোভাবে বুঝতে পারি, যা সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *