মিডিয়া, বিশেষ করে সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও এবং সোশ্যাল মিডিয়া, সবসময়ই সমাজের বৃহত্তম তথ্য সরবরাহকারী মাধ্যম হিসেবে পরিচিত। তবে সংকটকালীন মুহূর্তে মিডিয়ার ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সংকট, যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মানবিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা সশস্ত্র সংঘর্ষ, সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রভাব ফেলে। এই ধরনের মুহূর্তে সঠিক, দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রাপ্তি মানুষের জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মিডিয়া এই সময়ে জনগণের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছে দিতে সহায়ক হয়ে ওঠে এবং সংকট মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে সংকট যোগাযোগে মিডিয়ার দায়িত্ব শুধু তথ্য প্রদান করা নয়, বরং তা সঠিকভাবে এবং দায়িত্বশীলভাবে উপস্থাপন করা যাতে সাধারণ জনগণ বিভ্রান্ত না হয় বা অতিরিক্ত আতঙ্কিত না হয়।
এটি একটি অস্বাভাবিক মুহূর্ত যেখানে ভুল তথ্য বা অপর্যাপ্ত তথ্যের কারণে ভয়, আতঙ্ক এবং বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। যেমন ২০১০ সালের হাইতি ভূমিকম্পের পর, মিডিয়া যদি সঠিক এবং দ্রুত যোগাযোগ না করত, তবে প্রাথমিক উদ্ধার কার্যক্রমেও বিলম্ব ঘটত এবং বিপর্যয়ের পরিমাণ আরও ভয়াবহ হয়ে উঠত। হাইতির ভূমিকম্পের পর বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি তুলে ধরেন এবং আন্তর্জাতিক সাহায্যের আহ্বান জানান। এই ভূমিকা পুরো পৃথিবীকে একত্রিত করেছিল, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার জন্য। এর ফলে বিপর্যয়ের পর উদ্ধার তৎপরতা দ্রুত শুরু হয় এবং অনেক জীবন রক্ষা পায়।
অন্যদিকে, যখন মিডিয়া সংকট পরিস্থিতি সঠিকভাবে রিপোর্ট করতে ব্যর্থ হয়, তখন এর খারাপ পরিণতি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলা, যেখানে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তৎকালীন প্রতিবেদনে তথ্যের ভুল বা অসম্পূর্ণতা ছিল। অনেক সময় সংবাদমাধ্যমে বেসামরিক ও সেনা বাহিনীর কার্যক্রমের ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছিল, যা জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল। এমনকি, হামলার সময় সংবাদ সম্প্রচার করা হয়েছিল, যা হামলাকারীদের আরও বিপর্যয় ঘটানোর জন্য সাহায্য করতে পারতো। এখানে, মিডিয়া অত্যন্ত সতর্কতার সাথে খবর প্রচার করতে ব্যর্থ হয়েছিল, যা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল।
সংকট সময়ের মিডিয়ার ভূমিকা শুধুমাত্র তথ্যের প্রচারেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি জনগণের মনোবল বাড়াতে এবং সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বিপর্যয়কালীন সময়ে, মানুষের মধ্যে উদ্বেগ এবং আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, এমন অবস্থায় মিডিয়া তাদের দায়িত্ব পালন করে। যখন ২০১৯ সালের কেরালা বন্যা হয়, তখন টেলিভিশন, রেডিও, এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো দ্রুত উদ্ধার ও সাহায্য কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করে। সংবাদমাধ্যমের এই ভূমিকা বিপর্যয়ের পর দ্রুত পুনর্নিমাণ কাজ শুরু করতে সহায়ক হয়ে ওঠে। স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্যের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল এবং জনগণ দ্রুত সেই সাহায্য পেতে সক্ষম হয়েছিল।
তবে, সংকটকালীন সময়ে মিডিয়া যেমন জনগণকে তথ্য সরবরাহ করে, তেমনি ভুল তথ্য বা ভুয়া খবরের প্রচারও একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৪ সালের ইবোলা প্রাদুর্ভাবের সময় বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ভুয়া খবর ছড়িয়ে পড়ে, যেমন ইবোলা এক ব্যক্তির মাধ্যমে আরেক ব্যক্তির মধ্যে দ্রুত ছড়ায় বা এটি নিরাময়ের জন্য কোনো বিশেষ ওষুধ নেই। এই ধরনের ভুয়া খবরের কারণে জনগণ বিভ্রান্তি ও আতঙ্কে পড়েছিল, যা প্রাথমিক চিকিৎসা কর্মসূচীকে ব্যাহত করে। এই কারণে, মিডিয়াকে তাদের রিপোর্টিংয়ের সময় সত্য, নির্ভরযোগ্য এবং যাচাই করা তথ্য প্রদান করতে হবে, যাতে ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য সামাজিক নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে না ফেলে।
সঙ্কটকালীন সময়ে মিডিয়ার সর্বোচ্চ দায়িত্ব হল তথ্যের সঠিকতা নিশ্চিত করা এবং জনসাধারণের প্রতি দায়বদ্ধতা বজায় রাখা। বিশেষ করে, প্রকৃত সংকটের সময় সাংবাদিকরা সাধারণ মানুষের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছে দিতে দ্রুততর হতে পারেন, এবং তারা খবরগুলো এইভাবে প্রচার করতে পারেন যেন সাধারণ জনগণও সঠিকভাবে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যেমন ২০০১ সালের ৯/১১-এর হামলার পর, মিডিয়া দ্রুত আক্রান্ত এলাকায় পরিস্থিতি জানিয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছিল। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায়, সংবাদ মাধ্যম ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের পাশে দাঁড়িয়ে উদ্ধার কার্যক্রমের তথ্য দ্রুত পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিল। এই সময়ে মিডিয়ার কার্যক্রম সমাজে শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
মিডিয়া শুধু তথ্য সরবরাহ করেই শেষ হয়ে যায় না; এটি সংকট মোকাবেলায় রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের ভূমিকা পালনও করে। যেমন ২০০৪ সালের সুনামি, যেখানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং সাহায্য সংগঠনগুলি একত্রিত হয়ে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল, মিডিয়া তাদের কাজের প্রচার এবং বিশ্বজুড়ে সাহায্য আহ্বান করে। এই ধরনের ভূমিকা বিশ্বব্যাপী সহযোগিতার সূচনা করেছে, যেখানে সংকটকালীন সময়ে একে অপরের সাহায্যে সহযোগিতার হাত বাড়ানো হয়।
এছাড়া, মিডিয়ার ক্ষমতা তখন আরও বড় হয়ে ওঠে যখন সেটি নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করে। ২০১১ সালের আরব বসন্তে মিডিয়া, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যম, বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলির মূল চরিত্র হয়ে উঠেছিল। সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে আন্দোলনকারীরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং লক্ষ্য পৌঁছানোর সুযোগ পেয়েছিল। এতে, জনগণের মধ্যে সমবায় এবং গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার আহ্বান শক্তিশালী হয়েছিল।
সর্বশেষে বলা যায়, সংকট যোগাযোগে মিডিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংকটের সময়, মিডিয়া জনগণের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছানো, জনগণের মনোবল বৃদ্ধি করা, এবং সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করা ছাড়াও সামাজিক শান্তি এবং সহযোগিতার জন্য অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। তবে, এর জন্য মিডিয়াকে সঠিক, নির্ভরযোগ্য এবং দায়বদ্ধভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে, যাতে সংকট মোকাবেলায় কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় এবং জনগণের মধ্যে আতঙ্কের পরিবর্তে সচেতনতা ও সহানুভূতি সৃষ্টি হয়।