জন্মের পর থেকেই আমাদের মানসিকতা এই চিন্তা ভাবনার মধ্যেই বেড়ে উঠে যে সমাজের মধ্যে দুটি ‘স্বাভাবিক’ লিঙ্গীয় বিভাজন আছে, যার একটি হচ্ছে ‘পুরুষ’ এবং অপরটি ‘নারী’।

আফিয়া বিনতে লতিফ শান্তা
পরিবারের ছোট কোন সদস্যের আগমনের খবর শুনলেই আমরা উৎসুক হয়ে উঠি। কত জল্পনা কল্পনা আমাদের সেই ছোট্ট সদস্যকে ঘিরে! রীতিমত তাঁর জন্যে এটা সেটা খেলনা সামগ্রী, জামাকাপড় কেনা শুরু হয়ে যায়। বড়দের দেখি কত কিছু নিয়ে ভাবতে ‘ছেলে’ সন্তান হলে তাঁর জন্যে অমুক করবে কিংবা ‘মেয়ে’ সন্তান হলে অন্য কোন কিছু করবে। কিন্তু যদি ভিন্ন কিছু হয়? ভয় লাগলো? আঁতকে উঠলেন? তার মানে আপনি অদৃশ্য বেড়াজালে বন্দি, যেই বেড়াজালটা তৈরি করে দিয়েছে আমাদের সমাজ। এই ভয়ংকর বা বিপদজনক বেড়াজালে আটকে আছি আমি, আপনি আমরা প্রায় সকলেই।
জন্মের পর থেকেই আমাদের মানসিকতা এই চিন্তা ভাবনার মধ্যেই বেড়ে উঠে যে সমাজের মধ্যে দুটি ‘স্বাভাবিক’ লিঙ্গীয় বিভাজন আছে, যার একটি হচ্ছে ‘পুরুষ’ এবং অপরটি ‘নারী’।
এই নারী-পুরুষের বাইনারীর বাইরে কোনো কিছুকে আমরা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারি না বা নিতে চাই না বলেই তাদেরকে ‘অস্বাভাবিক’ ক্যাটাগরিতে ফেলে দেই। সমাজ দ্বারা নির্ধারিত এই অস্বাভাবিক ক্যাটাগরির মধ্যে আছে ‘তৃতীয়’ লিঙ্গের মানুষ বা সহজ ভাষায় যাদের আমরা ‘হিজড়া’ বলেই অধিক চিনে থাকি।
‘হিজড়া’ শব্দটি বলতেই আমাদের অবচেতন মনে যে চিত্রটি ভেসে উঠে সেটি উঠে আসে আমাদের চলমান সমাজ ব্যবস্থার প্রেক্ষিতেই, সেটি হচ্ছে- ‘মেয়েলি’ পোশাকে (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই) বিশেষ ভঙ্গিমায় আচরণ করা অনেকটা ‘পুরুষের’ মতো দেখতে এক বিশেষ গোষ্ঠী। কিন্তু এর পাশাপাশি আরো একটি বিষয় যেটি আমরা যুক্ত করতে চাই না সেটি হচ্ছে সমাজে প্রচন্ডভাবে অবহেলিত এবং মানসিক বা কখনো কখনো শারীরিকভাবেও নির্যাতিত একটি সম্প্রদায় হচ্ছে ‘হিজড়া’। জন্মের পর থেকেই কোন এক বিশেষ অঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে চিহ্নিত করা হয় ‘ছেলে’ বা ‘মেয়ে’ শিশুটিকে। আর এই বিশেষ অঙ্গের ‘অভাবজনিত’ কারণে কোন সন্তান জন্ম নিলে তাকে ধরা হয় ‘প্রতিবন্ধি’ হিসেবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে সমাজ তবুও অন্যান্য অঙ্গহানী বা মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিকেও মেনে নেয় কিন্তু সেই বিশেষ অঙ্গহীন ব্যক্তি যিনি কিনা ‘হিজড়া’ হিসেবে জন্মের পর থেকেই বেড়ে উঠছে তাকে তো মেনে নেয়ার প্রশ্নই আসে না বরং বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় তাদের জন্মের বিষয়টিই গোপন করে যায় পরিবারের সদস্যরা।
এমনকি প্রায় সকল ধর্মেই যেখানে মাতৃত্বকে পুণ্যের সাথে তুলনা করা হয়, সেখানে ‘অস্বাভাবিক’ সন্তান জন্ম দেয়ার জন্যে সেই মাতৃত্বই কটুক্তির মুখে পরে।
এরকম অবহেলায় বঞ্চনায় বেড়ে উঠে একজন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি। বেশিরভাগ সময়ই পরিবারের সান্ন্যিধ্য পায় না তাঁরা। জন্মের পর পরই তাদের হস্তান্তর করা হয় ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়ের কাছে আবার যদিওবা কখনো পরিবারে তাদের আশ্রয় হয়, সমাজের মানুষ প্রতিনিয়ত তাদের জীবন অবহেলা-অনাদরে জর্জরিত করে তোলে। বেড়ে উঠা থেকেই তাদের যেহেতু নির্ধারিত ‘নারী’ বা ‘পুরুষের’ আচরণের সাথে মিল থাকে না ফলে খেলাধুলার বয়সে তাঁরা খেলাধুলা করতে পারে না, খেলার সাথীরা কটুক্তি করে, বাড়িতে পরিবারের লোকজন তাদের আচরণে ‘সমস্যা’ দেখতে পায়, পাড়া-প্রতিবেশিরা হাসি-ঠাট্টায় জীবন বিষিয়ে তোলে। এর উপর যদি উক্ত ব্যক্তির কোনো ‘স্বাভাবিক’ ভাই বা বোন থাকে তাদের ভবিষ্যৎ সমাজের ভাষ্য মতে ‘অন্ধকার’ হয়ে যায় ঐ ‘অস্বাভাবিক’ সন্তানটির জন্য। কেননা তাদের তো বিয়ে-শাদির ব্যাপার আছে, আর এমন সন্ত্বান যেই ঘরে আছে সেখানে ‘ভালো’ বিয়ের প্রশ্নই আসে না, তাদের বন্ধুমহলেও এমন এক সহোদর থাকার জন্যে পড়তে হয় লজ্জায়, লোকে নানান কথা শোনায় তাদের, না জানি কোন ‘পাপের ফসল’ এই সন্তান এমন হাজারো সমস্যা ঐ একজন মাত্র ব্যক্তিক কেন্দ্র করে পরিবারকে প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হতে হয়। এমনকি আমাদের সমাজে উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির মালিকানার ক্ষেত্রেও তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হয় না। এই ধরণের আচরণে যখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত একজন তৃতীয় লিঙ্গীয় পরিচয়ধারী বেড়ে উঠে সেই বাধ্য হয়ে সরে যায় পরিবার থেকে, এরপর তাঁর ঠাই হয় তাঁরই সমগোত্রীয় অপরাপর ‘হিজড়া’ দের সাথে। এই যে তাদের অনিশ্চিত বেড়ে উঠা এর দায়ভার যেমন সমাজ নেয় না রাষ্ট্রে বিভিন্ন আইনের কথা উল্লেখ থাকলেও সেগুলো কার্যকরী হতে খুব বেশি দেখা যায় না। ফলে জীবন-ধারণের জন্যে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে পয়সা তোলার সাথেই তাঁদের অধিকাংশ যুক্ত থাকে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে যদিও কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যায়। সেরিনা নন্দার ভারতীয় ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়ের উপর রচিত এথনোগ্রাফিক বই ‘Neither Man Nor Women’ (1990) তে বলেন সেখানে হিজরাদের মূল পেশা হচ্ছে ‘বাধাই’ এর অনুষ্ঠানে নাচ গান করে সদ্য জন্ম নেয়া ‘ছেলে’ শিশুকে আশির্বাদ করা। এছাড়া সদ্য বিবাহিত যুগলদের অনুষ্ঠানে আশির্বাদ করে আসার মাধ্যমেও অর্থ পায় তাঁরা। যেহেতু হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়কে ‘বধুছাড়া মাতা’ দেবীর আশির্বাদ প্রাপ্তবলে মনে করা হয় ফলে সেখানে তাদেরকে কিছুটা সম্মানের স্থান দেয়া হলেও বাংলাদেশকে মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং এদেশের অধিকাংশই মুসলিম ধর্মাবলম্বী, ফলে ‘বাধাই’ এর অনুষ্ঠানের মতো রীতিনীতি গুলো সাংস্কৃতিক ভিন্নতার জন্য ঢালাওভাবে এখানে অনুষ্ঠিত হয় না যার দরুণ কোনো একটা সুনির্দিষ্ট পেশাকে তাঁরা তাদের পেশা বলে আখ্যায়িত করতে পারে না। পেশাগত দিক থেকে প্রচণ্ড ধরণের বৈষম্যের শিকার হওয়া এই সম্প্রদায় বেঁচে থাকার তাগিদেই পথচারী, বাসযাত্রী, অন্যান্য লোকজনের কাছে হাত পেতে অর্থ সংগ্রহ করে। এতে একে তো তাদের জীবনের অনিশ্চয়তা আরো প্রকোট হচ্ছে অন্যদিকে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ নির্ভরশীলতার উপর রয়ে গিয়েছে। বর্তমানে যদিও নানা আইনের প্রয়োগ দেখা দিয়েছে তাদের বিশেষভাবে নানাকাজে যুক্ত করার কথা ভাবা হচ্ছে, অনেকে আবার নিজ উদ্যোগে ঘুরেও দাঁড়িয়েছে। কেউ পার্লারে কাজ করছে, কোথাও বা সেবিকা (নার্স) হিসেবে যুক্ত হয়ে নিজ সম্প্রদায়ের অন্যান্যদের উৎসাহ প্রদান করছে কিন্তু কর্মক্ষেত্রে সম্মানের জায়গায়, নিজ পরিবারে তাদের অবস্থার যে খুব বেশি পরিবর্তন হয় নি সেটি ভালো খেয়াল করা যায় সোশাল মিডিয়ায় তাদেরকে নিয়ে করা উস্কানিমূলক মন্তব্যগুলোতে।
হিজড়া’ মানেই যে হাস্যকর কিছু এই ধরণের ডিসকোর্স আমাদের চিন্তনে এতো প্রবলভাবে গেথে দেয়া হয়েছে যে আজকাল গালি হিসেবে বা কাউকে ছোট করতেও এই শব্দটির অপব্যবহার করা হয়।
অনেকে এমনকি সোশাল মিডিয়াগুলোতে ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়ের অনেককে দেখা যায় ‘হিজড়া’ শব্দের পরিবর্তে তাই ‘বৃহন্নলা’ শব্দটির ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে। যদিও কেবল কোন শব্দের ব্যবহার দ্বারা কোন সমস্যার সমাধান হয় বলে মনে হয় না তবুও বিষয়টিকে পছন্দ হিসেবে দেখলে তাদের সম্মানের উদ্দ্যেশ্যে শব্দটির ব্যবহার করতে সমস্যা হওয়ার কথা না। শুধুমাত্র সহানুভূতি বা সহমর্মিতা না দেখিয়ে সমাজে সম্মান এবং সর্বোচ্চ অধিকার পাক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরাও। সমাজে তাদের স্বীকৃতি দেয়া হোক একজন রক্তে মাংসে গড়া ‘মানুষ’ হিসেবে। পরিবারে তাদের আশ্রয় হোক মা-বাবার সাধারণ সন্তান হিসেবে। আসুন দৃষ্টিভঙ্গি বদলাই, তাদের জন্যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

লেখক,
শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
যোগাযোগ: afiashanta12@gmail.com
Writing is not a view of the School of Thought, it is entirely the opinion of the Author.
If you want to share your thought, you can mail us at- edior.sot@gmail.com