শাস্তি অপরাধকে প্রশমিত করে এবং অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করে৷ তবে অপরাধ এবং শাস্তি দুটি বিষয়ই আপেক্ষিক।

এম.জি.আজম
মানবজাতির ইতিহাসে শাস্তির প্রচলন ঠিক কবে থেকে তার সঠিক সময় নিরুপন করা যায় নি। তবে ধারণা করা হয় সমাজ ব্যবস্থা যখন শুরু হয়েছে শাস্তির প্রচলনও ঠিক তখন থেকেই। দলবদ্ধভাবে থাকার বা সমাজ সৃষ্টির যে ধারণা তার উৎপত্তি মানুষের নিজের বেঁচে থাকার তাগিদেই। আর এই সমাজ টিকিয়ে রাখতে মানুষ প্রচলন ঘটিয়েছে বিভিন্ন নিয়মের বেড়াজাল। এসব বিধি-নিষেধ, নিয়মনীতিতে যেন কোন ছেদ না পড়ে, সমাজ সিস্টেম যেন ভেঙ্গে না পড়ে তাই নানারকম শাস্তির প্রচলন শুরু হয়।
অধ্যাপক ম্যাকেঞ্জির মতে- শাস্তির মৌলিক উদ্দেশ্য হল অপরাধীর কৃতকর্মের বোঝা তারই মাথায় চাপিয়ে দিয়ে তাকে বুঝতে দেওয়া যে তার কৃতকর্মের জন্য শুধু অন্যেরই অকল্যাণ হয়নি, বরং নিজেরও অকল্যাণ হয়েছে। শাস্তির লক্ষ্য মূলত অপরাধের প্রতিরোধ এবং অপরাধীর সংশোধন।
শাস্তি অপরাধকে প্রশমিত করে এবং অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করে৷ তবে অপরাধ এবং শাস্তি দুটি বিষয়ই আপেক্ষিক। কিসের মানদন্ডে অপরাধ নির্ণয় হবে, শাস্তির মাত্রা কেমন হবে, শাস্তি প্রদান কারা করবে এই বিষয়গুলো অনেক সময়ই যথাযথ মূল্যায়িত হয় না৷ লঘুপাপে গুরুদন্ড কিংবা গুরু পাপে লঘুদন্ড দেওয়ার মত ঘটনা অহরহই দেখা হয়।
রাষ্ট্র, ব্যক্তি কিংবা দল নিজেদের প্রয়োজনমতো শাস্তির নিয়ম তৈরি করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় যুগ যুগ ধরে সমাজের ক্ষমতাধর বা উচ্চশ্রেণির মানুষ নিজেদের অবস্থান পোক্ত করার জন্য তথা নিজের মধ্যে শাসকের গুণাগুণ অক্ষুণ্ণ রাখার উদ্দেশ্যে শাস্তিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।
সে সব ভিন্ন প্রসঙ্গ৷ এখানে মূলত শাস্তির বিভিন্ন তত্ত্ব এবং বর্তমান সময়ের আলোকে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
শাস্তির তত্ত্বসমূহকে নিন্মোক্ত ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমটি হল-
প্রতিকারমূলক মতবাদ(Retributive Theory):
এই মতবাদকে সর্বাধিক প্রাচীন বলে মনে করা হয়। এই তত্ত্ব অনুসারে একজন ব্যক্তি অন্যের বা সমাজের যতটুকু ক্ষতিসাধন করে ঠিক ততখানি ক্ষতি তার উপর আরোপ করা হলেই প্রকৃত শাস্তিদান করা হয়৷ প্রাচীনকালে শাস্তির এই নীতিটি ‘চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত‘ নামে প্রচলিত ছিল। প্রতিকারাত্মক মতবাদ মনে করে তারা অপরাধীর উপর শাস্তি আরোপ করে না বরং অপরাধই শাস্তিকে ডেকে নিয়ে আসে। শাস্তিদাতার ভূমিকা এখানে গৌণ। শাস্তিকে এখানে অপরাধীর অধিকার বলে গণ্য করা হয়৷
এই মতবাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল শাস্তিকে এখানে অপরাধের সমানুপাতিক বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ শাস্তির মাত্রা যেন অপরাধের মাত্রার থেকে কম বা বেশী না হয়।
আধুনিক কালে শাস্তির এই তত্ত্বটি ক্রমাগত তার গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে।
প্রতিরোধমূলক মতবাদ( Deterrent/Preventive Theory):
বড় ধরণের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পূর্বে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে এই তত্ত্ব কাজ করে। প্রাচীনকালে অপরাধীকে দীর্ঘমেয়াদী বা স্থায়ীভাবে শারীরিকভাবে অক্ষম করে অপরাধ কর্মে জড়িত হতে বাধা দেওয়া হত। উদাহরণস্বরূপ, চুরির শাস্তিস্বরুপ অপরাধীর হাত কেটে দেওয়া হত।(ইসলামী শরীয়াহ অনুসারে এই আইন এখনো কিছু সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত)৷
আধুনিককালে সম্পতি বাজেয়াপ্তকরণ, কর্মক্ষেত্র থেকে সাসপেন্স, লাইসেন্স বাতিলসহ মতো আরও বিভিন্নরকম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা প্রয়োগ করা হয়।
সংশোধনাত্মক মতবাদ(Reformative Theory): এই তত্ত্বানুসারে শাস্তির উদ্দেশ্য অপরাধীকে সংশোধন করা। শাস্তির এই প্রক্রিয়া মানুষকে কল্যাণের দিকে নিয়ে যেতে পারে৷ সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতা, সুশিক্ষার অভাব, অর্থনৈতিক দৈন্যতা মানুষকে নৈতিক পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে, অপরাধকর্মে ইন্ধন যোগাতে পারে। এই মতবাদ মনে করে যথাযথ শিক্ষা এবং মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা অপরাধীকে তার বিচ্যুতি থেকে সরিয়ে আনে এবং সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে। চিরাচরিত শাস্তির ধারণায় এই মতবাদ বিশ্বাসী নয়। আধুনিককালের বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী এবং দার্শনিক এই মতবাদকে সমর্থন করেছেন এবং এর পক্ষে জোড়ালো যুক্তি পেশ করেছেন।
মূলত সমাজে নানা রকম অপরাধ সংঘটিত হয়। এইসব অপরাধের বিচার কোন একটি মাত্র শাস্তিতত্ত্বের অনুসরণে না করাই বাঞ্জনীয়। বরং অপরাধের প্রকৃতি বা স্বরুপ বিচার করে শাস্তিপ্রদান করা উচিৎ।
শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের গ্রহণযোগ্যতাঃ মৃত্যুদন্ড সমর্থনযোগ্য কি না বিষয়টি অতি বিতর্কিত। বর্তমানে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডকে উঠিয়ে দিয়েছে। তবুও শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড ব্যাপক জনপ্রিয়। আমেরিকার মতো উন্নত দেশে সারাবছর যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার অর্ধেক হয় মৃত্যুদণ্ডে। চীনে কত মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়, সঠিক জানা না গেলেও সংখ্যাটি নেহাত কম নয় বলেই ধারণা করা হয়। অন্যদিকে, সুদান বা সৌদি আরবে এখনও ক্রুশে বিদ্ধ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশে ক্রমশ বিচারের আওতায় এবং বিচার-বহির্ভূতভাবে মৃত্যুদণ্ড জনপ্রিয় শাস্তিতে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার মৃত্যুদণ্ডকে অত্যন্ত সহজলভ্য শাস্তি-সংস্কৃতিতে পরিণত করেছে। ফলে যে কোনো অপরাধে এখন মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি কামনা করাটা হয়ে উঠেছে সামাজিক রীতি।
মৃত্যুদন্ডের ভয়ে অনেকে অপরাধ করে না, এটা অনেকটা ডেটারেন্স হিসেবে কাজ করে বলে প্রচলিত ধারণা৷ কিন্তু কোন পরিসংখ্যান এটিকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে না৷ বরং উল্টো চিত্র দেখা যায়৷ ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট এবং হোমিসাইডের সমস্ত ডাটা কালেক্ট করে দেখা গেছে যেসব রাজ্যে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট আছে সেখানে খুন, ভায়োলেন্স হয়েছে বেশী। তবে এই পরিসংখ্যান থেকে এটাও প্রমাণিত হয়না যে মৃত্যুদন্ড তুলে দিলে অপরাধ কমে যাবে৷ কিন্তু এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে মৃত্যুদন্ড এবং অপরাধ প্রবণতার মধ্যে সরাসরি কোন সম্পর্ক নাই। চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত এটি এক ধরণের প্রতিহিংসার খেলা। এবং এই খেলার সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতার দিক হল এটি কখনো এক-একে থেমে থাকে না। এই শিক্ষা আমরা মহাভারতে পাই।
গান্ধিজী বলেছিলেন- চোখের বদলে চোখ নিলে পুরো পৃথিবী অন্ধ হয়ে যাবে৷
যাদের কাছের মানুষ খুন হচ্ছে, নিগৃহীত হচ্ছে তাদের প্রতি রাষ্ট্রের অবশ্যই সহানুভূতি থাকবে ৷ ভিক্টিমের আবেগকে অবশ্যই সম্মান করতে হবে। তবে তার মানে এই না যে তাদের হয়ে প্রতিশোধ নিতে রাষ্ট্র নেমে পড়বে। রাষ্ট্রের কাজ তা নয়৷ রাষ্ট্রের কাজ একটি শ্রেয় নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করা৷ একটা মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার হল তার সবচেয়ে বড় অধিকার, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার। কোন ইস্যুতে কোন অজুহাতে রাষ্ট্রের উচিৎ না এই অধিকার খর্ব করা। প্রশ্ন উঠতে পারে ক্রিমিনাল তো সেই অধিকারকে সম্মান করে না তারা তো অহরহই আরেকজনের সুখ শান্তি এমনকি জীবন বিনষ্ট করে চলছে। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নাই। কিন্তু একইসাথে মনে রাখতে হবে বেঁচে থাকার অধিকারকে সম্মান দিতে পারে না বলেই তারা ক্রিমিনাল। রাষ্ট্রের উচিৎ নয় কখনো একজন ক্রিমিনালকে অনুসরণ করা৷ রাষ্ট্রের উচিৎ নয় তার শ্রেয় নৈতিকতার অবস্থান থেকে সরে এসে একজন ক্রিমিনালকে শায়েস্তা করতে ওই ক্রিমিনালেরই দেখানো পথ অনুসরণ করা।
একজন মানুষ যখন অপর একজন মানুষকে খুন করে তা জঘন্য৷ কিন্তু রাষ্ট্র যখন একজন মানুষকে খুন করে তা জঘন্যতর। কারণ রাষ্ট্র কর্তৃক মৃত্যুদন্ড প্রদান আকস্মিকভাবে দেওয়া হয় না। রাষ্ট্র অপরাধীকে মৃত্যুর সময় বেঁধে দেয়। অপরাধী প্রচন্ড আতংক নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকে। এর থেকে ভয়াবহ মানসিক টর্চার আর কিছু হতে পারে না। একটা মানুষের সংশোধিত হবার সুযোগকে উপেক্ষা করে তাকে দড়িতে ঝুলিয়ে দেওয়া কখনো ন্যায়বিচার হতে পারে না৷
আমাদের নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ন্যায়-অন্যায় সব কিছুই পরিমাপ হয় প্রচলিত সমাজ কাঠামো, কালচার এবং বেঁচে থাকার প্যারামিটারে৷ আশেপাশে আমরা অহরহই মৃত্যু দেখি কিন্তু মৃত্যুর অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধির সুযোগ বেঁচে থাকতে কখনোই সম্ভব না। যে মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের বা রাষ্ট্রের কোন প্রত্যেক্ষ ধারণা নেই, যা আমাদের জ্ঞানের বাইরে, আমাদের চেতনার বাইরে, ইহজাগতিক কোনকিছুর সাথে তুলনার বাইরে, সেই মৃত্যুকে শাস্তি হিসেবে ব্যবহার করা আমাদের এখতিয়ারেরও বাইরে।
অপরাধীকে অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে। তবে সেটা খুনের বদলে খুন হওয়া উচিৎ না৷ এমনটা হলে রাষ্ট্রও খুনির স্তরে নেমে যায়।
মানুষ মাত্রই চরিত্র সংশোধনের সম্ভাবনা এবং সামর্থ্য থাকে। গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিও এই সম্ভাবনার বাইরে নয়।
শাস্তির ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়- ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ১৬০ প্রকার অপরাধকে মৃত্যুদন্ডযোগ্য গুরুতর অপরাধরুপে গণ্য করা হয়েছিল। ১৭৭০ সালে ওই সংখ্যা হ্রাস পেয়ে ৩৭ হয়েছে। পরবর্তীকালে এই সংখ্যা আবার ক্রমশ হ্রাস পেয়ে কেবল দুই প্রকার অপরাধকে মৃত্যুদন্ডযোগ্য অপরাধরুপে গণ্য করা হয়েছে। এই দুই প্রকার অপরাধ হল – এক, রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং দুই, অপরকে বেঁচে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। কাজেই দেখা যায় সময়ের সাথে মৃত্যুদন্ডের নৈতিক ভিত্তি ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে এবং এর বিরুদ্ধে জনমত বাড়ছে।
সর্বোপরি বলা যায়-শাস্তি ও তার প্রয়োগের তারতম্য সমাজে ক্ষমতা এবং ক্ষমতার শ্রেণিবিস্তারের ধাপগুলো দেখার ক্ষেত্রে একটি দর্পনের ন্যায় কাজ করে।
সমাজের সকল স্তরে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে শাস্তি প্রয়োজন। একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই৷ তবে এটাও মনে রাখতে হবে – ভুল শাস্তি অনেক সময় অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে তার পুনরাবৃত্তিকে উৎসাহিত করে। মানুষ যেহেতু আবেগে পরিচালিত জীব, তাই প্রাতিষ্ঠানিক শাস্তি তার মারাত্মক মানসিক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। এর ফলে তার ঔদ্ধত্য বাড়তে পারে বা আক্রমণাত্মক স্বভাব তীব্র হয়ে উঠতে পারে। শাস্তির ভুল ব্যবহার প্রায় সময়ই অপরাধীর সংশোধনের সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে দেয়৷
সুতরাং অপরাধ প্রশমনে এবং সমাজের সকল স্তরে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে শাস্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরী৷ একইসাথে জরুরী-শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের বিকল্প কিছুর চর্চা করা।

লেখক,
শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
যোগাযোগঃ azamsrju46@gmail.com
Writing is not a view of the School of Thought, it is entirely the opinion of the Author.
If you want to share your thought, you can mail us at- editor.sot@gmail.com