আজকের বিশ্বে মিডিয়া জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া, সিনেমা, ভিডিও গেম—এই সবই বর্তমান সময়ে যুব সমাজ এবং কিশোর-কিশোরীদের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। যেহেতু যুবকরা এবং কিশোর-কিশোরীরা এখনও মানসিক এবং শারীরিকভাবে বিকাশের প্রক্রিয়ায় থাকে, তাই মিডিয়া তাদের উপর এক ধরনের গভীর প্রভাব ফেলে। এটি ইতিবাচক বা নেতিবাচক—যেমন প্রতি বিষয়েরই দুটি দিক থাকে, তেমনই মিডিয়ার প্রভাবও দুই দিক থেকে বেরিয়ে আসে।
মিডিয়া যুব সমাজকে নতুন ধারণা, তথ্য এবং বিনোদন প্রদান করে। তবে অনেক সময় এই একই মিডিয়া তাদের আচরণ, মনোবিজ্ঞান এবং মানসিক অবস্থা পরিবর্তন করতে পারে। আমাদের সমাজে যে পরিমাণ মিডিয়া প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে, তার ফলে কিশোর-কিশোরীরা নানা ধরনের প্রচলিত চিন্তা, মনোভাব, জীবনযাত্রা এবং স্টাইলের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, যা তাদের স্বাভাবিক উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রবন্ধে আমরা মিডিয়ার যুব সমাজের উপর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো এবং উদাহরণ ও কেস স্টাডির মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরবো।
মিডিয়া এবং কিশোর-কিশোরীদের মানসিক বিকাশ
কিশোর বয়সে যখন একজন ব্যক্তি শারীরিক এবং মানসিকভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে, তখন তার জীবনাচরণে কিছু মূল্যবোধ, চিন্তা-ভাবনা এবং আচরণের স্থিতি স্থাপন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়েই, মিডিয়া তার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। টেলিভিশন, সিনেমা, সোশ্যাল মিডিয়া—সবকিছুই তাদের জন্য এক ধরনের আদর্শিক দিকনির্দেশনা হয়ে দাঁড়ায়। যদি সে কোনও নেতিবাচক অথবা অস্বাভাবিক বিষয় দেখতে বা শিখতে থাকে, তবে তার মানসিক অবস্থায় এবং তার ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
একটি জনপ্রিয় উদাহরণ হতে পারে টিনএজ সিনেমাগুলির মাধ্যমে যৌনতা, মাদক ব্যবহার, অশালীন ভাষা, অথবা অতি আক্রমণাত্মক আচরণ সম্পর্কে যে ধারণা দেওয়া হয়, তা কিশোরদের মনোবিজ্ঞানকে প্রভাবিত করে। এই ধরনের বিষয়গুলি তাদের মনে ভুল ধারণা সৃষ্টি করে, ফলে তারা বাস্তব জীবনে এমন আচরণ প্রদর্শন করতে পারে যা সমাজে অগ্রহণযোগ্য।
সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব
বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া কিশোর-কিশোরীদের জীবনের বড় একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, ইউটিউব—এসব প্ল্যাটফর্ম তাদের মাঝে খুব জনপ্রিয়। সোশ্যাল মিডিয়াতে তাদের একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করা, ছবি বা ভিডিও শেয়ার করা, নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করা—সবকিছুই রয়েছে। কিন্তু এই ধরনের প্রচলিত প্ল্যাটফর্মগুলো তাদের জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে বিভিন্নভাবে।
সোশ্যাল মিডিয়া যেমন তাদের একটি গ্ল্যামারাস এবং আকর্ষণীয় জীবনধারা প্রদর্শন করে, তেমনি অনেক সময় তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং অপরাধমূলক মনোভাবও তৈরি করতে পারে। একটি কেস স্টাডি হিসেবে ধরা যাক ইনস্টাগ্রাম এবং ফেসবুক-এর মাধ্যমে যেসব কিশোর-কিশোরী নিজেদের ছবির মাধ্যমে প্রচারের চেষ্টা করে, তারা প্রায়শই সমাজের এক আদর্শিক রূপে নিজেকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে। এর ফলে তারা নিজেকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে না পারলে মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং দুঃখ, হতাশা বা বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়। এমনকি অনেক সময় সোশ্যাল মিডিয়া নির্দিষ্ট শরীরী বা জীবনধারার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে, যা অস্বাভাবিক এবং বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। এর ফলস্বরূপ, তারা নিজেকে তুলনা করতে শুরু করে এবং আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি অনুভব করে।
মিডিয়া এবং সামাজিক আচরণ
মিডিয়া যুব সমাজের সামাজিক আচরণকেও প্রভাবিত করে। আমরা যদি টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বা সিনেমা দেখে দেখি, যেখানে প্রচুর যুদ্ধ, অপরাধ, অশালীন ভাষা বা গালাগালি রয়েছে, তবে কিশোর-কিশোরীরা এসব থেকে প্রভাবিত হতে পারে। বিশেষত যেসব কিশোর-কিশোরীরা পরিবার থেকে সঠিক শিক্ষা এবং দিকনির্দেশনা পায় না, তারা মিথ্যা আদর্শ ও মূল্যবোধ গ্রহণ করতে পারে।
মিডিয়া বিশেষত যেসব প্রকৃত ঘটনা বা সমাজের বেদনাদায়ক দিকগুলো আড়াল করে, তা কিশোরদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক সিনেমায় অপরাধী চরিত্রগুলি এক ধরনের রোমাঞ্চকর জীবনের চিত্র ফুটিয়ে তোলে, যা কিশোর-কিশোরীদের ভুল বার্তা দিতে পারে এবং তাদের অপরাধমূলক কাজে জড়িত হতে প্ররোচিত করতে পারে।
মিডিয়া এবং শিক্ষামূলক বিষয়াবলী
অন্যদিকে, মিডিয়ার পজিটিভ প্রভাবও রয়েছে। তথ্যভিত্তিক অনুষ্ঠান, শিক্ষামূলক ভিডিও, ওয়ার্ল্ড নিউজ, ডকুমেন্টারি—এসব কিশোর-কিশোরীদের শেখানোর জন্য উপকারী হতে পারে। বর্তমানে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে সহজেই নানা ধরনের শিক্ষামূলক টিউটোরিয়াল, ভাষার কোর্স এবং বিজ্ঞান বিষয়ক ভিডিও পাওয়া যায়, যা কিশোরদের শিখতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
তবে, এক্ষেত্রে parental guidance বা অভিভাবকরা যদি শিশুদের মিডিয়া কনটেন্টের সাথে সমন্বয় রেখে তাদের শেখানো বিষয়গুলি নির্বাচন করতে পারেন, তবে তা তাদের বিকাশের জন্য এক বড় উপকারিতা হয়ে দাঁড়াবে।
উপসংহার
মিডিয়ার প্রভাব যুব সমাজ ও কিশোর-কিশোরীদের উপর যে গভীর, ব্যাপক এবং বহুমুখী, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই প্রভাব ভালো কিংবা খারাপ—এটি অনেকটাই নির্ভর করে মিডিয়া কন্টেন্টের ধরণ এবং কিশোরদের পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজে দেওয়া শিক্ষার উপর। তাই অভিভাবক, শিক্ষকদের এবং সমাজের দায়িত্ব হলো, তাদের বুঝিয়ে দেওয়া যে মিডিয়াকে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে এবং কীভাবে এটি তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। তবেই, একটি সুস্থ, পরিপূর্ণ এবং সচেতন প্রজন্ম তৈরি করা সম্ভব হবে।