যুদ্ধ এবং গণমাধ্যম: যুদ্ধের ন্যারেটিভ এবং জনমত গঠন

গণমাধ্যমের ভূমিকা যুদ্ধের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি মানুষের মনোভাব এবং দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে সরাসরি প্রভাব ফেলে। যুদ্ধ কখনোই শুধু সামরিক সংঘর্ষের বিষয় নয়; এটি একটি সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক ঘটনা, যা গণমাধ্যমের মাধ্যমে জনগণের কাছে উপস্থাপিত হয়। যুদ্ধের ন্যারেটিভ নির্মাণের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের প্রভাব বিশাল, কারণ গণমাধ্যমই সাধারণ জনগণের কাছে যুদ্ধের সত্য, পরিণতি এবং কৌশল সম্পর্কে ধারণা পৌঁছানোর প্রধান মাধ্যম। যুদ্ধের গল্প বা ন্যারেটিভ কিভাবে গণমাধ্যম দ্বারা তৈরি হয় এবং তা জনমতকে কীভাবে প্রভাবিত করে, তা বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

গণমাধ্যম এবং যুদ্ধের ন্যারেটিভ নির্মাণ

যুদ্ধের সময় গণমাধ্যম যেভাবে ঘটনাগুলো পরিবেশন করে, তা যুদ্ধের মূল স্বরূপের থেকে অনেক দূরে বা কখনো কখনো বিকৃতভাবে তুলে ধরতে পারে। মূলত, গণমাধ্যম যুদ্ধের বাস্তবতাগুলোকে এক ধরনের ‘প্যাকেজ’ আকারে উপস্থাপন করে, যার মধ্যে থাকে সেনা বাহিনীর অভিযান, সিভিলিয়ানদের ক্ষতি, রাজনৈতিক মন্তব্য এবং কূটনৈতিক চুক্তির আলোচনা। গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়, যা যুদ্ধের কৌশলগত লক্ষ্য, পক্ষের সাফল্য এবং ব্যর্থতা, জনবহুল অঞ্চলে চলমান মানবিক বিপর্যয়, এবং একে অপরের প্রতি প্রতিশোধের ধারণা গঠন করে।

যুদ্ধের ন্যারেটিভ গঠনে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যেমন, বিবিসি, সিএনএন, এবং এল জাজিরা অত্যন্ত প্রভাবশালী। এসব মিডিয়া কখনো কখনো যুদ্ধের উপস্থাপনায় পক্ষপাতিত্ব করতে পারে, যেমন তারা নির্দিষ্ট দেশের সেনা বাহিনীর বিজয়ী অভিযান বা বিপরীত পক্ষের প্রতিরোধকে অত্যন্ত নির্দিষ্টভাবে তুলে ধরে। উদাহরণস্বরূপ, ইরাক যুদ্ধ (২০০৩) এবং আফগান যুদ্ধ (২০০১) গণমাধ্যমে বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। পশ্চিমী মিডিয়া যেমন সিএনএন ইরাক যুদ্ধের সময় একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিজয়ী অভিযান এবং বিপরীত পক্ষের পরাজয়ের গল্প তুলে ধরেছিল, যেখানে অন্যদিকে আরব মিডিয়াগুলি ইরাকের জনগণের সংগ্রাম এবং যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণের ভয়াবহতা দেখিয়েছিল।

নিউজ ফ্রেমিং: কিভাবে সংবাদ উপস্থাপন করা হয়

গণমাধ্যমের মাধ্যমে যুদ্ধের ন্যারেটিভ গঠন একটি প্রক্রিয়া, যা সাধারণত ‘নিউজ ফ্রেমিং’ নামে পরিচিত। নিউজ ফ্রেমিং হলো, কোনো ঘটনার বা বিষয়ের একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করা, যা জনমত তৈরি করে। যুদ্ধের ক্ষেত্রে, মিডিয়া খবরগুলোকে একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে ফ্রেম করে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। যেমন, কোনো একটি যুদ্ধের সংবাদ “দেশের রক্ষা” বা “গণতন্ত্র রক্ষার” গল্পের মাধ্যমে ফ্রেম করা হতে পারে, যা জনগণকে সেই যুদ্ধকে ন্যায্য বা প্রয়োজনীয় মনে করিয়ে দেয়।

ইরাক যুদ্ধের সংবাদ উপস্থাপনা একটি চমৎকার উদাহরণ। ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে গণমাধ্যম “ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদী হামলা প্রতিরোধ” হিসেবে উপস্থাপন করেছিল। এর ফলে, সাধারণ জনগণের মধ্যে যুদ্ধের প্রতি সহানুভূতি এবং সমর্থন বৃদ্ধি পায়, কারণ তারা যুদ্ধের ফলে সন্ত্রাসবাদ কমবে এবং বিশ্বের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে বলে বিশ্বাস করেছিল। তবে, পরে যখন যুদ্ধের প্রকৃত ফলাফল এবং মানবিক বিপর্যয়ের খবর উঠে আসে, তখন গণমাধ্যমের মাধ্যমে তা আংশিকভাবে সংশোধিত হয়, তবে প্রথমে যে ন্যারেটিভ গঠন হয়েছিল তা জনগণের মনোভাব প্রভাবিত করেছিল।

কেস স্টাডি: বাগদাদ ড্রপ (Baghdad Drop) – ইরাক যুদ্ধ

ইরাক যুদ্ধের সময় ২০০৩ সালে, বাগদাদ শহরের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার দৃশ্যটি টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল। গণমাধ্যমের মাধ্যমে বাগদাদে আক্রমণের এই ছবিগুলো পশ্চিমী দেশগুলোতে ইরাক যুদ্ধকে কার্যকর ও সফলভাবে চালানোর গল্প তৈরি করেছিল। যখন যুদ্ধের প্রথম দিকে বাগদাদে “সুনির্দিষ্ট আক্রমণ” চালানো হয়েছিল, তখন বিশ্ব গণমাধ্যমের মাধ্যমে এটি এভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী নির্দোষ জনগণকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে, এবং ইরাকের সরকার উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তবে, এই যুদ্ধের পরিণতি যখন মানবিক বিপর্যয়ের দিকে চলে যায়, এবং বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যু ও অপূর্ণতা দৃশ্যমান হয়, তখন গণমাধ্যম এটি আক্রমণকারী বাহিনীর অপরাধ হিসেবে উপস্থাপন করতে শুরু করে।

গণমাধ্যম এবং জনমত: যুদ্ধের পক্ষে বা বিপক্ষে?

গণমাধ্যমের মাধ্যমে গঠিত যুদ্ধের ন্যারেটিভ শুধু যুদ্ধের অংশীদারদের পক্ষের মতামতকেই প্রভাবিত করে না, বরং সাধারণ জনগণের মনোভাবও গঠন করে। যুদ্ধের শুরুতে, মিডিয়া কখনো কখনো সরকারের প্রচারণা ও বক্তব্যকে প্রচার করে, যা জনমতকে সমর্থন দেয়। উদাহরণস্বরূপ, অফগানিস্তান যুদ্ধ এবং ইরাক যুদ্ধ দুটি ক্ষেত্রে পশ্চিমী গণমাধ্যম তাদের সরকারগুলোর বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। গণমাধ্যমের দৃষ্টিকোণ থেকে, যুদ্ধ ছিল এক ধরনের নৈতিক দায়িত্ব, যেখানে জনগণ নিরাপত্তা এবং স্বস্তি লাভের আশা করেছিল।

তবে, যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন এদের আসল পরিণতি এবং মানবিক বিপর্যয় প্রকাশিত হয়, তখন গণমাধ্যম নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গঠন শুরু করে। এক্ষেত্রে, গণমাধ্যম সাধারণত তাদের সংবাদ ফ্রেমিং পরিবর্তন করে এবং তারা যুদ্ধের সত্যিকার কুপ্রভাব, অর্থনৈতিক ক্ষতি, এবং সিভিলিয়ানদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি তুলে ধরে।

গণমাধ্যমের পক্ষে যুদ্ধ এবং তার নৈতিকতা

যুদ্ধের ন্যারেটিভ গঠনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের পক্ষে কাজ করা এবং তাদের রিপোর্টিংয়ের ধরন নৈতিক প্রশ্ন তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯০-৯১ সালে পারস্য উপসাগর যুদ্ধ (গালফ ওয়ার) সময়ে পশ্চিমী গণমাধ্যম বেশিরভাগ সময় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর জয় এবং সাফল্যকে তুলে ধরেছিল। কিন্তু, এই যুদ্ধের সময় যে বিশাল সংখ্যক অগণিত সিভিলিয়ান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সে ব্যাপারে গণমাধ্যমের রিপোর্টিং অনেকাংশে সংক্ষেপিত ছিল। যুদ্ধের ন্যারেটিভ তৈরি করার জন্য গণমাধ্যমে সঠিক এবং স্বচ্ছ তথ্য না দেওয়াও জনগণের ভুল ধারণা তৈরি করতে পারে।

আজকের যুগে গণমাধ্যমের ভূমিকা

বর্তমানে, সোশ্যাল মিডিয়ার উত্থান এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশন যুদ্ধের কভারেজে পরিবর্তন এনেছে। এখন যুদ্ধের খবর দ্রুত প্রচারিত হয় এবং জনগণ নিজেদের মতামত প্রকাশ করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে পারে। যেমন, সিরিয়া যুদ্ধ এবং ইউক্রেন যুদ্ধ গণমাধ্যমের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে, যেখানে সশস্ত্র সংঘর্ষের সেলফি, ভিডিও এবং ছবি প্রকাশিত হয়েছে। এসব দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়াতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে, যা জনমত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

উপসংহার

যুদ্ধ এবং গণমাধ্যমের সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল এবং গভীর। গণমাধ্যমের মাধ্যমে গঠিত যুদ্ধের ন্যারেটিভ জনমতের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে, যা কখনো যুদ্ধের সমর্থনে এবং কখনো বা বিরোধিতায় পরিবর্তিত হতে পারে। যুদ্ধের সময় গণমাধ্যম যদি পক্ষপাতিত্বপূর্ণ হয়, তবে তা সাধারণ জনগণের কাছে বিভ্রান্তিকর বার্তা পৌঁছে দিতে পারে। এজন্য গণমাধ্যমের নৈতিক দায়িত্ব হলো যুদ্ধের প্রকৃত পরিণতি এবং সঠিক তথ্য জনগণের কাছে তুলে ধরা, যাতে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *