যুদ্ধে প্রোপাগান্ডার ভূমিকা: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ডিজিটাল যুগ পর্যন্ত

প্রোপাগান্ডা শব্দটির মূল ধারণা হলো তথ্য বা বার্তা প্রচারের মাধ্যমে মানুষের মনোভাব, বিশ্বাস ও আচরণ পরিবর্তন করা। যুদ্ধের ইতিহাসে প্রোপাগান্ডার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই প্রভাব যুদ্ধের কৌশল, রাষ্ট্রের সামরিক ক্ষমতা এবং জনগণের মনোভাব গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। প্রোপাগান্ডা কেবল শত্রু বাহিনীকে দুর্বল করার জন্য ব্যবহৃত হয়নি, বরং এটি একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সমর্থন এবং তার জনগণের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে আধুনিক ডিজিটাল যুগ পর্যন্ত, প্রোপাগান্ডার ভূমিকা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হলেও এর উদ্দেশ্য অপরিবর্তিত ছিল—যুদ্ধের মধ্যে রাষ্ট্রের জয় নিশ্চিত করা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) ছিল প্রোপাগান্ডার ব্যবহারের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই যুদ্ধে, বিশেষ করে ইউরোপীয় শক্তিগুলির মধ্যে প্রোপাগান্ডার ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। যুদ্ধের প্রকৃতি ছিল ব্যাপক এবং দীর্ঘস্থায়ী, এবং সরকারগুলো জনগণের মনোভাব এবং সমর্থন আকর্ষণের জন্য প্রোপাগান্ডাকে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। ইউরোপীয় দেশগুলো যেমন ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি প্রোপাগান্ডার মাধ্যম হিসেবে পোস্টার, সংবাদপত্র, রেডিও এবং চলচ্চিত্র ব্যবহার করেছিল। এগুলো ছিল মানুষের মনোভাব এবং যুদ্ধের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের প্রধান উপায়।

বিশেষত, ব্রিটেন এবং জার্মানি প্রোপাগান্ডার ব্যাপক ব্যবহার করেছিল। ব্রিটেন সরকার তাদের জনগণের মনোভাব প্রভাবিত করতে ‘Ministry of Information’ প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে তারা যুদ্ধের উদ্দেশ্য এবং শত্রুদের সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দিতে শুরু করে। ব্রিটেনের প্রোপাগান্ডা মূলত যুদ্ধের গুরুত্ব বোঝানোর পাশাপাশি জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদ এবং যুদ্ধের প্রতি সমর্থন সৃষ্টি করতে সহায়তা করেছিল। একইভাবে, জার্মানি তাদের যুদ্ধ প্রচারণায় শত্রুদের অমানবিকতার চিত্র তুলে ধরেছিল এবং তাদের জনগণকে একত্রিত করতে ‘Total War’ ধারণা প্রচার করেছিল। যুদ্ধের ভয়াবহতা, মানবিকতা, শত্রুদের অমানবিক আচরণ এসব প্রোপাগান্ডার মূল বিষয় ছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রোপাগান্ডার ব্যবহার আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই যুদ্ধে, হিটলারের নাৎসি সরকার এবং তার সহায়ক শক্তিগুলো প্রোপাগান্ডাকে একটি আদর্শ রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। নাৎসি প্রোপাগান্ডা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং এটি হিটলারের রাজনৈতিক আদর্শকে প্রচার করার পাশাপাশি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। নাৎসি সরকার চলচ্চিত্র, রেডিও এবং পোস্টারের মাধ্যমে যুদ্ধের প্রতি জনগণের সমর্থন ও বিশ্বাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। তারা প্রতিপক্ষের অমানবিকতার চিত্র তুলে ধরেছিল এবং নিজেদের সামরিক শক্তির আধিক্যকে প্রাধান্য দিয়েছিল। এর মাধ্যমে তারা জনগণকে মনে করিয়ে দিয়েছিল যে, যুদ্ধ শুধুমাত্র একটি রাষ্ট্রের সুরক্ষা এবং জাতির মর্যাদা রক্ষার জন্য অপরিহার্য।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা এবং ব্রিটেনও প্রোপাগান্ডার মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র, রেডিও এবং পোস্টার ব্যবহার করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকা তাদের “Uncle Sam” পোস্টারের মাধ্যমে তরুণদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছিল। ব্রিটেনও তাদের জনগণকে যুদ্ধের প্রতি সমর্থন জানাতে এবং জাতীয় ঐক্য বজায় রাখতে পোস্টার ও রেডিওর মাধ্যমে বার্তা প্রচার করেছিল। প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে মানুষকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করার পাশাপাশি শত্রু সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করা হয়েছিল, যা যুদ্ধের সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

১৯৪৫ সালের পর, বিশেষ করে ১৯৬০-৭০-এর দশকে, প্রোপাগান্ডা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখতে পায়। প্রযুক্তি এবং গণমাধ্যমের বিকাশের ফলে প্রোপাগান্ডা আরও আধুনিক এবং সূক্ষ্মভাবে মানুষের মনোভাবকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান ঠাণ্ডা যুদ্ধকালীন সময়ে প্রোপাগান্ডা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই তাদের রাজনৈতিক এবং সামরিক আদর্শ প্রচারের জন্য গণমাধ্যম, রেডিও, সিনেমা এবং পোস্টারের মাধ্যমে প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে সোভিয়েত রাষ্ট্র তাদের জনগণের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে এক ধরনের তিক্ততা সৃষ্টি করতে প্রোপাগান্ডা ব্যবহার করেছিল, যেখানে তাদের ‘কমিউনিস্ট’ আদর্শকে উত্তম হিসেবে তুলে ধরা হত।

বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল বিপ্লবের সঙ্গে প্রোপাগান্ডার ব্যবহার আরও একটি নতুন দৃষ্টিকোণ পেয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে, ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর উত্থান প্রোপাগান্ডাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। এখন আর শুধুমাত্র রেডিও বা সিনেমা নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ইত্যাদি মাধ্যমে দ্রুতগতিতে বার্তা প্রচার করা সম্ভব। এই মাধ্যমে সরকারের পক্ষ থেকে বা অন্যান্য রাজনৈতিক বা সামাজিক গোষ্ঠী থেকেও প্রোপাগান্ডা প্রচারের কাজ করা হচ্ছে। বিশেষভাবে, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ এবং অন্যান্য সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে প্রোপাগান্ডার ব্যবহার অনেক বেশি লক্ষ্যণীয়।

একটি উদাহরণ হিসেবে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় বিভিন্ন পক্ষ নিজেদের সমর্থন আদায়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রোপাগান্ডা ব্যবহার করেছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পক্ষ থেকে সরকারী বাহিনীর পক্ষে একধরনের পজিটিভ প্রোপাগান্ডা প্রচার করা হচ্ছিল, যেখানে তাদের সাফল্য এবং জনগণের কাছে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরা হয়েছিল। অপরদিকে, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকেও একাধিক সামাজিক মিডিয়া ক্যাম্পেইন পরিচালিত হচ্ছিল, যাতে সরকারী বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি প্রচার করা হত এবং তাদের আন্দোলনকে বৈধতা দেয়া হত।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় রাশিয়ার প্রোপাগান্ডা প্রচার। এতে দেখা গেছে, সামাজিক মাধ্যম এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে তথ্যকে আংশিকভাবে বিকৃত করে, বিশেষভাবে বিভাজনমূলক বার্তা প্রচার করা হয়েছে। ফেসবুক, টুইটার এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণা এবং রাজনৈতিক মতামত প্রচারের ক্ষেত্রে প্রোপাগান্ডা এক নতুন বিপদ হিসেবে উত্থিত হয়েছে। এই ধরনের প্রোপাগান্ডা কার্যক্রম শুধু একটি দেশের নির্বাচনী ফলাফলকেই প্রভাবিত করে না, বরং সার্বিকভাবে গণতন্ত্র এবং জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও চ্যালেঞ্জ করে।

উপসংহার

যুদ্ধের ইতিহাসে প্রোপাগান্ডার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা কেবল শত্রু বাহিনীকে দুর্বল করার জন্য নয়, বরং জনগণের মনোভাবকে যুদ্ধের প্রতি সমর্থন জানানো এবং রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কৌশল বাস্তবায়ন করার জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে ডিজিটাল যুগ পর্যন্ত প্রোপাগান্ডার ব্যবহার প্রতিনিয়তই নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে এবং প্রতিটি যুগে এর উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধের ফলাফল অনুকূল করা। তবে আধুনিক যুগে প্রোপাগান্ডার পদ্ধতি আরও সূক্ষ্ম এবং প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে উঠেছে, যার মাধ্যমে দ্রুত সময়ে বৃহৎ জনগণের মনোভাব পরিবর্তন করা সম্ভব হচ্ছে। এমনকি যুদ্ধের পরবর্তী সময়েও প্রোপাগান্ডা বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিস্থিতি প্রভাবিত করে থাকে, যা সামরিক কৌশল এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *