যুদ্ধ মানব ইতিহাসের একটি অপরিহার্য অংশ এবং বহু ধর্ম, দর্শন, ও সমাজব্যবস্থায় এই সম্পর্কিত নৈতিক ও ন্যায় সংক্রান্ত নানা ধরনের মতামত ও তত্ত্ব দেখা যায়। যুদ্ধের ন্যায় তত্ত্ব (Just War Theory) সেই দর্শনীয় তত্ত্বের মধ্যে একটি যা যুদ্ধের নৈতিক ভিত্তি ও যুক্তি প্রদান করে। এই তত্ত্বে মূলত এটি আলোচনা করা হয় যে কোন পরিস্থিতিতে যুদ্ধ ন্যায়সঙ্গত হতে পারে এবং কিভাবে যুদ্ধের সময় নৈতিকতা রক্ষা করা যায়। যুদ্ধের ন্যায় তত্ত্বের আলোচনার শুরুটা প্রাচীন দার্শনিকদের থেকেই, তবে আধুনিক যুগে এর নৈতিক ও দার্শনিক বিশ্লেষণ আরও ব্যাপক ও গভীর হয়েছে।
যুদ্ধের ন্যায় তত্ত্বের সূচনা
যুদ্ধের ন্যায় তত্ত্বের মূল ভিত্তি রোমান দার্শনিক সেন্ট অগাস্টিন এবং পরে থমাস অ্যাকুইনাসের কাজের মধ্যে নিহিত। সেন্ট অগাস্টিন (354-430 খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন একজন খ্রিস্টান দার্শনিক যিনি যুদ্ধের নৈতিকতা নিয়ে প্রথম বিস্তৃত আলোচনা করেন। তিনি যুদ্ধকে একমাত্র তখনই ন্যায়সঙ্গত বলে গণ্য করেন যখন তা ধর্ম ও সমাজের সুরক্ষা এবং শান্তির জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। তাঁর মতে, যুদ্ধের উদ্দেশ্য যদি শাস্তি দেওয়া বা কোনো অনুপ্রবেশকারীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা হয়, তবে তা ন্যায়সঙ্গত হতে পারে। তবে, তিনি যুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষের প্রতি অত্যাচার বা অবিচার মেনে নিতে অস্বীকার করেন।
পরে, থমাস অ্যাকুইনাস (1225-1274) আরও একটি কাঠামো তৈরি করেন যা যুদ্ধের ন্যায় তত্ত্বকে আরও স্পষ্ট ও সুসংহত করে। তিনি “যুদ্ধের জন্য সঠিক কারণ”, “যুদ্ধের সময় ন্যায়”, এবং “যুদ্ধের পরবর্তী বিচার” এসব বিষয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেন। থমাস অ্যাকুইনাসের মতে, কোনো যুদ্ধ তখনই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে যখন তা সঠিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা ঘোষণা করা হয়, এর উদ্দেশ্য বৈধ এবং যুদ্ধের সময় অযাচিত অত্যাচার এড়ানো হয়।
যুদ্ধের ন্যায় তত্ত্বের নৈতিক মূলনীতি
যুদ্ধের ন্যায় তত্ত্বে মূলত দুটি প্রধান অংশ রয়েছে: ১) জাস্ট কজ (Just Cause), ২) জাস্ট কন্ডাক্ট (Just Conduct)।
১. জাস্ট কজ (Just Cause): যুদ্ধের জন্য ন্যায়সঙ্গত কারণ থাকতে হবে। এটি এমন কোনো কারণ হতে হবে যা অনিবার্য, যেমন আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ, অথবা অন্যের অধিকার রক্ষা করা। যেমন, কোনো জাতি যদি অন্য জাতির উপর আক্রমণ করে এবং তা কোনো বৈধ কারণ ছাড়া হয়ে থাকে, তাহলে সেই যুদ্ধ ন্যায়সঙ্গত বলে গণ্য হবে না। উদাহরণস্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, নাৎসি জার্মানি পোল্যান্ডে আক্রমণ করেছিল, যা যুদ্ধের সঠিক কারণ ছিল এবং এটি ন্যায়সঙ্গত ছিল।
২. জাস্ট কন্ডাক্ট (Just Conduct): যুদ্ধের সময় যুদ্ধবিধি বা যুদ্ধের নিয়ম মেনে চলতে হবে। যুদ্ধের মধ্যেও মানুষকে হত্যা করা, নিরীহ মানুষকে আক্রমণ করা বা সাধারণ জনগণের ওপর অত্যাচার করা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। যুদ্ধের সময় উদ্দেশ্য থাকা উচিত শুধুমাত্র শত্রু শক্তি পরাজিত করা, এবং যুদ্ধবন্দীদের প্রতি সদয় আচরণ করা উচিত। ১৯৯০ এর দশকে রুয়ান্ডার গণহত্যার সময়, হুতু সম্প্রদায় নিরীহ তুতসি জনগণের বিরুদ্ধে নির্দয় আক্রমণ চালায়, যা যুদ্ধের ন্যায় তত্ত্বের সরাসরি লঙ্ঘন।
যুদ্ধের ন্যায় তত্ত্বের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি
আধুনিক যুগে, যুদ্ধের ন্যায় তত্ত্বের আলোচনায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। আজকের পৃথিবীতে, যুদ্ধের জন্য আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘের সুরক্ষা পরিষদ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের উপস্থিতি যুদ্ধের ন্যায় তত্ত্বকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। “Responsibility to Protect” (R2P) ধারণাটি এই প্রেক্ষাপটে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে, যেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কোনো দেশের জনগণের ওপর গণহত্যা বা অন্য কোনো ধরনের গণহত্যার মতো অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে বাধ্য করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১১ সালে লিবিয়া যুদ্ধ ছিল R2P তত্ত্বের ভিত্তিতে সংঘটিত, যেখানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ লিবিয়ায় গাদ্দাফির শাসনকে হটাতে এবং নিরীহ মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সেনা ব্যবহারের অনুমোদন দেয়।
একইভাবে, আধুনিক যুগে “প্রতিবিধান যুদ্ধ” বা Preemptive War, যেমন ইরাক যুদ্ধ (২০০৩), ন্যায় তত্ত্বের চ্যালেঞ্জিং বিষয় হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা দাবি করেছিল যে, ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন নিষিদ্ধ অস্ত্র গড়ে তুলছে এবং এটি সুরক্ষার জন্য একটি পূর্ব প্রতিরোধমূলক আক্রমণ হওয়া উচিত, যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই যুক্তি মেনে নেয়নি। এর ফলে, যুদ্ধের ন্যায় তত্ত্বের প্রতিষ্ঠিত নীতিগুলোর প্রতি প্রশ্ন উঠেছিল, বিশেষ করে যুদ্ধের জন্য যথেষ্ট বৈধতা ছিল কিনা তা নিয়ে।
কেস স্টাডি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ এবং নৃশংস যুদ্ধ ছিল। এটি যুদ্ধের ন্যায় তত্ত্বের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে, যেখানে যুদ্ধের শুরু ও শেষে সঠিক কারণ এবং ন্যায়সংগত আচরণের বিবেচনা করা হয়েছে। যুদ্ধের শুরুতে, নাৎসি জার্মানি পোল্যান্ডে আক্রমণ করে, যা ছিল আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। এর ফলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স যুদ্ধ ঘোষণা করে। যুদ্ধের সময়, নাৎসি বাহিনীর অসংখ্য নিষ্ঠুরতা যেমন শত্রুদের নির্বিচারে হত্যা, নিরীহ জনগণের উপর অত্যাচার এবং গণহত্যার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনা যুদ্ধের ন্যায় তত্ত্বের পক্ষে একটি বিরোধী উদাহরণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে, যেখানে যুদ্ধের প্রাথমিক কারণ সঠিক হলেও, যুদ্ধকালীন আচরণ ছিল পুরোপুরি নৈতিকভাবে ভুল।
অন্যদিকে, জোট বাহিনী যখন নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছিল, তাদের উদ্দেশ্য ছিল মানবাধিকার এবং স্বাধীনতার পুনঃপ্রতিষ্ঠান, যা যুদ্ধের ন্যায় তত্ত্বের সঠিক কারণ ছিল। ফলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে একটি ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, যদিও এর সময়কালে সংঘটিত কিছু অমানবিক ঘটনা যুদ্ধের ন্যায় তত্ত্বের নৈতিক সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে।
উপসংহার
যুদ্ধের ন্যায় তত্ত্ব আমাদের দেখায় যে, যুদ্ধের জন্য একটি নৈতিক ভিত্তি এবং সঠিক আচরণ থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির মোকাবেলা, বিশেষ করে নিরীহ মানুষের উপর অযাচিত অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য, যুদ্ধের সময় যথাযথ নৈতিক নীতির অনুসরণ করা আবশ্যক। তাছাড়া, আধুনিক পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ও মানবাধিকারের প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত, যাতে কোনো যুদ্ধের প্রয়োজন হলে তা ন্যায়সঙ্গতভাবে সংঘটিত হয়। তবে, এর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচারধারা সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয় এবং এটি আমাদের সামগ্রিক নৈতিক ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।