
জান্নাতুল ফিরদাউস
মিডিয়া রিপ্রেজেন্টেশন হলো মিডিয়া যেভাবে তার বার্তার মাধ্যমে সমাজে বিদ্যমান ইস্যুকে অডিয়েন্সের সামনে প্রচার করে। সহজভাবে বলতে গেলে মিডিয়া রিপ্রেজেন্টেশন হলো সমাজে বিদ্যমান ঘটনাগুলোকে পুনরায় উপস্থাপন করা।মিডিয়া যেমন (টেলিভিশন, সোস্যাল মিডিয়া, সংবাদপত্র, ফিল্ম) কীভাবে কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে কোন বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করে সেটিই মিডিয়া রিপ্রেজেন্টেশন।মিডিয়া রিপ্রেজেন্টেশন ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুইভাবেই হয়ে থাকে।
মিডিয়া রিপ্রেজেন্টেশন কীভাবে হয় তা বোঝানোর জন্য আমরা ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট ও বাংলাদেশ’ সত্য ইস্যুটিকে বিশ্লেষণ করব।
মিয়ানমারে ধারাবাহিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়ে ১৯৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসা শুরু করে। ২৫ আগষ্ট ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে শুরু হয় ‘অপারেশন ক্লিয়ারেন্স’ নামের বর্বর ও নিষ্ঠুরতম এক সেনা অভিযান। এ অভিযানে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের কুখ্যাত যুদ্ধ কৌশল Three All Policy অনুসরণ করে। ঐ কৌশলের মূল কথা ছিল সবাইকে হত্যা করো, সবকিছু পুড়িয়ে দাও, সবকিছু লুট করো। এরপর থেকেই ঢলের মতো রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে থাকে। গ্রামের পর গ্রাম এমন ভাবে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে সেখানে মানববসতির চিহ্নই না থাকে। নির্বিচারে হত্যা, শিরশ্ছেদ, ঘরে বন্দি করে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা ও ধর্ষণের মতো বর্বরতম ঘটনা ঘটায় তারা।
এই ঘটনাটি বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের মিডিয়াগুলো মিডিয়া রিপ্রেজেন্টেশনের reflective এপ্রোচের মাধ্যমে তুলে ধরে।
Reflective এপ্রোচটি হলো সমাজে যা হয় তাকেই সবার সামনে উঠিয়ে আনা। মিডিয়া এখানে সমাজের প্রকৃত সত্য জিনিসগুলোকে হুবহু প্রচার করে। এটা অনেকটা পল হডকিনসনের media as a mirror এর মতো।অর্থাৎ গণমাধ্যম হলো সমাজের আয়না।
এখন আসি কীভাবে মিডিয়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে reflective এপ্রোচে কাজ করেছে- মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যে জাতিগত নিধন চালিয়েছে তা পুরো বিশ্বকে জানিয়েছে মিডিয়া তার সংবাদের মাধ্যমে। বাংলাদেশে আসা শরণার্থীদের সবার মুখে নির্যাতনের ভয়াবহ সত্য গল্পগুলোকে তুলে ধরেছে। রোহিঙ্গারা তাদের নিজের আবাসভূমিতে কতটা বর্বরতার শিকার হয়েছে সেটি ফুটে উঠেছিল মিডিয়ার মাধ্যমে। মিডিয়ার এই উপস্থাপনের জন্য আন্তর্জাতিক মহলগুলো মানবতা লঙ্ঘনের বিষয়টি জানতে পেরেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সংকট সমাধানের জন্য চাপ অনুভব করছে। রোহিঙ্গাদের উপর এই দীর্ঘসময় ধরে চলা অত্যাচারের কথা প্রকাশিত হয়েছে সারাবিশ্বের সামনে। এটিকে আমরা মিডিয়ার ইতিবাচক বা ভালো উপস্থাপন বলতে পারি।
এখানে একটি জিনিস জেনে রাখা জরুরি যে, মিডিয়া অনেক সময় যেকোনো ইস্যুকে খারাপ ভাবে উপস্থাপন করে। উদ্দেশ্যপ্রণেদিত ভাবে তারা ইস্যু নির্ধারণ করে থাকে। আমরা দেখতে পাই, কীভাবে মার্কিন গণমাধ্যমগুলো যুদ্ধের পক্ষে জনগণের মতামতকে নিয়ে যেতে কাজ করেছে।যেমন: ইরাকে আগ্রাসন চালানোর সময় যুদ্ধকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ইরাকে নিউক্লিয়ার অস্ত্র আছে, এ প্রচারণা চালায় মার্কিন প্রশাসন। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো সরকারের এই প্রচারণার বিস্তার ঘটাতে ও ইরাক যুদ্ধকে নায্য করতে সহযোগিতা করতে থাকে। উপসাগরীয় যুদ্ধের মতো এবারও মার্কিন গণমাধ্যম ক্ষমতাসীনদেরই পক্ষ নিয়েছিল। যুদ্ধ শুরুর আগেই গণমাধ্যমগুলো যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিয়েছিল তাদের সংবাদের মাধ্যমে। একই সময়ে নিউইয়র্ক টাইমস ও সিবিএস পত্রিকার জরিপে দেখা যায় শতকরা ৮৫ ভাগ মার্কিন নাগরিক বিশ্বাস করতে থাকে ইরাকে মানব বিধ্বংসী মরণাস্ত্র আছে। মিডিয়া এখানে অডিয়েন্সকে তাদের স্বার্থ অনুযায়ী পরিচালনা করতে সফল হয়েছে। সিরিয়া সংকট নিয়েও পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো অডিয়েন্সকে ধোঁয়াচ্ছন্ন করে রেখেছে।
টুইন টাওয়ার আক্রমণের পর মুসলমানদের সন্ত্রাসী হিসেবেই চিহ্নিত করা হয় গণমাধ্যমে।ইসলামকে একটি সহিংস ধর্ম হিসেবেই প্রচার করে তারা। মিডিয়ার এই নেতিবাচক উপস্থাপনের জন্যই পশ্চিমাবিশ্ব মুসলমানদের প্রতি আগ্রাসী হয়ে ওঠে। পরিকল্পিতভাবেই এই গণমাধ্যমগুলো ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারণা চালায়। পশ্চিমা মিডিয়া মুসলমানদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু ছাঁচীকরণ বা স্টেরিওটাইপ ধারণা প্রয়োগ করে,যার মধ্যে ছিল মুসলিম সন্ত্রাসী বা আরব সন্ত্রাসী। যা মিডিয়ার এই খারাপ উপস্থাপনের ফলেই তৈরি হয়েছে।
সমপ্রতি কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার মেন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে যেভাবে পরিবেশনা করা হয়েছে তা সত্যি বাংলাদেশের জন্য অপমানজনক। প্রতিবেদনে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যেমন তারা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছে। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকে তারা স্বাভাবিক ঘটনার মত করে উপস্থাপন করেছে। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে দোষারোপ করেছে। এটি তারা করতে পারে তবে তা গঠনমূলক হলে ভালো হতো।তাদের তথ্য সত্য হতে পারে কিন্তু সেটা প্রকাশের যে ভাষাগত প্রয়োগ তা আমাদের পীড়া দেয়।
একটি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য যে উপস্থাপনা তা কতটুকু যুক্তিসম্মত?
ভারতীয় একটি মুভি Raazi তে দেখি কীভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ভুল ভাবে তুলে ধরে। এছাড়াও ‘পদ্মাবত’ মুভিতেও দেখেছি খারাপ মানুষের চরিত্রে থাকে ইসলাম ধর্মের মানুষজন। কেন এই নেতিবাচক উপস্থাপন মিডিয়া করে থাকে? শুধু নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য।
রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মিডিয়ার ন্যায়সঙ্গত উপস্থাপনের প্রেক্ষিতে অডিয়েন্স নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। কিছু সংখ্যক মানুষ মনে করেছিল রোহিঙ্গারা মুসলমান বলেই তাদের উপর এই অমানবিক আচরণ। একধরনের সাম্প্রদায়িক মনোভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল। আবার একদল অডিয়েন্স শুধু মানবতার খাতিরে তাদের আশ্রয় দেওয়াটা ঠিক, এমন মনোভাব পোষণ করে।বিপদাপন্ন, বিপন্ন মানুষগুলোর পাশে থাকতে চেয়েছে। আর কিছু মানুষ দেশের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে। নিজেদের স্বকীয়তা ঝুঁকিতে পরতে পারে সেটিও ভেবেছে।
আমরা প্রথমেই বলেছিলাম রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট নিয়ে মিডিয়ার ভূমিকা ছিল বিশুদ্ধ। এই ঘটনা বা যেকোনো ঘটনার ক্ষেত্রে মিডিয়ার উপস্থাপনে কিছু বিষয় প্রভাব রাখে।
প্রথমত, গণমাধ্যমের উপর অডিয়েন্সের আস্থা বা ভরসা-অডিয়েন্স গণমাধ্যমকে তাদের অধিকার আদায়ের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করতে দেখতে চায়।সেই গণমাধ্যম যখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে ন্যায়সঙ্গত অবস্থানে ছিল তখন জনগণের আস্থার জায়গাটি আরো জোরদার হয়েছে। গণমাধ্যমও চায় সাধারণ নাগরিকদের বিশ্বাস অর্জন করতে। মানবিক দিক বিবেচনায়, গণমাধ্যমের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পরে এধরনের পরিস্থিতিতে ভুমিকা রাখা।
দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দিক-ক্ষমতাসীন সরকার কতটা মানবিক সেটা তুলে ধরা। কেননা গণতান্ত্রিক দেশে সরকারের ভালো কাজের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা গণমাধ্যমের কাজ। এজন্য তারা রোহিঙ্গা ইস্যুকে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছে।
যদি ইরাক আগ্রাসন ও টুইন টাওয়ার হামলার ক্ষেত্রে দেখি তাহলে বলতে হবে সরকারের মদদপুষ্ট হয়ে কাজ করেছে মিডিয়া যাতে সরকারের সাহায্য নিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে পারে।
তৃতীয়ত, সেল্ফ সেন্সরশিপ- মূলধারার গণমাধ্যমে রয়েছে সেল্ফ সেন্সরশিপ।
একটা গণমাধ্যম চালাতে যে পরিমাণ টাকা লাগে সেটা সরকার ঘনিষ্ঠ না হলে সম্ভব নয়। এজন্য মিডিয়াগুলো সরকার বা সরকার সংশ্লিষ্ট সংস্থা গুলোর বিরুদ্ধে কিছু প্রকাশ করতে চায় না। এজন্যই গণমাধ্যমগুলোতে সেল্ফ সেন্সরশিপ হয়।
যেমন তনু হত্যাকান্ডের সাথে সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতা থাকায়, উর্ধ্বতনমহল থেকে কোনো বাঁধা না আসলেও গণমাধ্যমগুলো এক ধরনের সেল্ফ সেন্সরশিপে ভুগেছে। তারা প্রথমে তা প্রচার করতে চায় নি।
চতুর্থত, বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস-আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলিম। তাদের পাশেই একটি দেশে মুসলিমদের উপর নির্যাতনে তারা কষ্ট পাবে। এটাও ভূমিকা রেখেছে গণমাধ্যমে এটি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে।
মালিকানা-মালিকপক্ষের স্বার্থসংবলিত বিষয়গুলো সর্বপ্রথম মাথায় রাখতে হয় মিডিয়া হাউজগুলোকে। মালিকপক্ষের ইচ্ছে অনুযায়ী উপস্থাপন করতে হয়।
মিডিয়াগুলোর উদ্দেশ্য -নির্দিষ্ট মিডিয়ার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে। তারা নিজেদের আইডিওলজিকে সমাজে পুশ করার জন্য প্রচারণা চালায়। যেমন আলজাজিরা আরব বিশ্বে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়াতে চায়।
রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মিডিয়াতে উপস্থাপনের জন্য বেশকিছু শক্তিশালী দিক রয়েছে। এই ইস্যুটি যথাযথভাবে প্রচারের ফলে জাতিসংঘ সহ আরো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এটি সমাধানের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে।দীর্ঘদিনের সংকটের জন্য একটি সমাধান যে দরকার এই বোধটিকে জাগ্রত করতে পেরেছে।
বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিশ্বদরবারে উজ্জ্বল হয়েছে মিডিয়ার রিপ্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে। বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ যে উদারতার পরিচয় দিয়েছে তা আজ পুরো বিশ্ব জানে।
দিনশেষে এই সংকট নিরসনে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় নি।বহিঃর্বিশ্বকে চাপের মুখে ফেলতে ব্যর্থ মিডিয়া।যদিও তারা কিছু করা প্রয়োজন এই বোধ টি জাগ্রত করতে পেরেছে। কিন্তু বোধ জাগ্রত হওয়া আর সংকট নিরসন করতে সফল হওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। যদি বিশ্বের শক্তিশালী মিডিয়াগুলো আরো বেশি কাভারেজ দিত এটা বোঝাতে যে, নিজেদের স্বার্থ থেকে বের হয়ে এসে হলেও এই সংকটের সমাধান করা উচিত। যেটি করতে মিডিয়া ব্যর্থ। যুদ্ধের প্রসঙ্গে যদি তোলপাড় তুলতে পারে সংবাদের মাধ্যমে তাহলে কেন এই প্রাপ্য অধিকার আদায়ের বিষয়ে তারা আরো বেগবান হবে না। মিয়ানমার কেন এখনো রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিচ্ছে না। এদিকে বাংলাদেশের জন্য এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে জায়গা দিতে কতটা হিমশিম খেতে হচ্ছে তা নিয়েও বিশ্বের মিডিয়াগুলোর উপস্থাপনা নেই। যা এই সংকটময় পরিস্থিতিকে আরো জটিল করছে।এছাড়া বাংলাদেশী মিডিয়াগুলোর এই ইস্যু প্রচারের ফলে মিয়ানমার ও মিয়ানমারকে সমর্থন করা দেশগুলোর বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়ন চলে। আলোচনা প্রসঙ্গে এগুলোই মোটাদাগে মিডিয়াতে এই ইস্যুটি উপস্থাপনের দুর্বল দিক বলে মনে হয়।
তথ্যসূত্র:প্রথম আলো পত্রিকা
বণিক বার্তা
যুগান্তর

শিক্ষার্থী,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
যোগাযোগঃ zannatulfirdaus47@gmail.com
Writing is not a view of the School of Thought, it is entirely the opinion of the Author.
If you want to share your thought, you can mail us at- editor.sot@gmail.com