মিডিয়ায় লিঙ্গ প্রতিনিধিত্ব: একটি সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ

মাস মিডিয়া, যেমন সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও এবং সোশ্যাল মিডিয়া, সমাজের বৃহত্তম তথ্য সরবরাহকারী মাধ্যম। তবে এটি শুধু তথ্য প্রদান করেই সীমাবদ্ধ নয়, সমাজের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটায়। এর মাধ্যমে নানান ধারণা এবং প্রথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসে। এক্ষেত্রে, লিঙ্গের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মিডিয়া সমাজের পুরুষ এবং নারী ভূমিকা, তাদের ক্ষমতা, সামাজিক অবস্থান এবং জীবনধারা সম্পর্কে সমাজের ধারণা নির্মাণে বিশাল ভূমিকা রাখে। যদিও নারী ও পুরুষ উভয়ই মিডিয়ার অংশ, তবে বাস্তবতা হলো, মিডিয়ায় নারী ও পুরুষের প্রতিনিধিত্ব একেবারেই সমান নয়। নারীদের ভূমিকা এবং অবস্থান অনেক সময়ই সীমাবদ্ধ থাকে এবং পুরুষদের চেয়ে অনেক কম গুরুত্ব দেয়া হয়। এই অনুপাতের অসমতার ফলে সমাজের মধ্যে লিঙ্গবৈষম্য এবং নানান ধরনের অসাম্য প্রবণতা দেখা দেয়।

মিডিয়ায় নারীদের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই যা উঠে আসে তা হলো, নারীদের যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, তার প্রভাব সমাজের উপর কতটা গভীর। অনেক সময় নারীদের শুধু শারীরিক সৌন্দর্য এবং যৌনতা কেন্দ্রিক চরিত্রে উপস্থাপন করা হয়। বিশেষ করে বিজ্ঞাপন, টেলিভিশন শো, চলচ্চিত্র এবং ম্যাগাজিনে নারীদের বড় একটি অংশ পণ্য হিসেবে দেখানো হয়, যেখানে তাদের চেহারা, পোশাক এবং ব্যক্তিগত জীবন বেশি গুরুত্ব পায়। যেমন, একটি বিখ্যাত ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনে নারীকে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়, যেখানে তার শরীরের সৌন্দর্যই একমাত্র মানদণ্ড। এর ফলে, সমাজের মধ্যে নারীদের প্রতি একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড তৈরি হয়, যা কখনও কখনও তাদের প্রকৃত ব্যক্তিত্ব এবং ক্ষমতা প্রকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এতে নারীরা নিজের ক্ষমতা বা দক্ষতা দিয়ে সমাজে স্থান তৈরি করার বদলে, নিজের শারীরিক বৈশিষ্ট্যকে সামনে এনে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে চেষ্টা করেন।

এদিকে, পুরুষদের মিডিয়ায় প্রতিনিধিত্ব তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সক্রিয় ও শক্তিশালী। পুরুষরা মিডিয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষমতা, নেতৃত্ব এবং সফলতা অর্জনকারী হিসেবে উপস্থাপিত হন। তাদের চরিত্রগুলি সাধারণত ডোমিনেটিং, সাহসী এবং পরিপূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন হিসেবে描写 করা হয়, যা সমাজের মধ্যে পুরুষশক্তির ধারণাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, চলচ্চিত্রে বা টেলিভিশনে পুরুষ চরিত্রগুলো সাধারণত একরকম অ্যাকশন বা সাহসী ভূমিকা পালন করেন, যেখানে নারীরা শুধুমাত্র সহায়কের ভূমিকায় থাকে। এর ফলে, পুরুষদের অনেক ক্ষেত্রে সফলতা এবং ক্ষমতার আদর্শ হিসেবে দেখানো হয়, যা নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না।

মিডিয়ায় লিঙ্গের প্রতিনিধিত্বের এই সমস্যা কিছু নির্দিষ্ট জাতিগত, সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের মধ্যে আরো তীব্র হয়ে ওঠে। গায়ের রঙ, জাতি, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক অবস্থা, এগুলোও মিডিয়ায় নারীদের উপস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুত্ব পায়। মিডিয়া সাধারণত সাদা, উচ্চবর্ণ, এবং প্রথাগত সামাজিক আদর্শে গঠিত নারীদের বেশি গুরুত্ব দেয়, যেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, কৃষ্ণাঙ্গ এবং গরিব নারীদের বেশিরভাগ সময় পিছিয়ে রাখা হয়। যেমন, গত কয়েক দশকে হলিউডে যে পরিমাণ সাদা-চামড়া নারী অভিনেত্রীদের দেখা গেছে, তাদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ বা এশিয়ান নারী অভিনেত্রীদের উপস্থিতি ছিল অনেক কম। এর ফলে, ভিন্ন জাতি বা সংস্কৃতির নারীরা মিডিয়ার মধ্যে নিজেদের স্থান পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করতে থাকে।

সোশ্যাল মিডিয়ার উত্থান বিশ্বব্যাপী এই বৈষম্যের চিত্রের কিছু পরিবর্তন আনলেও, এটি সম্পূর্ণরূপে দূর হয়নি। সোশ্যাল মিডিয়া যেখানে নারীদের নিজেদের মত প্রকাশের সুযোগ দিয়েছে, সেখানে একইসঙ্গে সেখানে এক ধরনের সৌন্দর্য ও আদর্শের চ্যালেঞ্জও তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ইন্সটাগ্রাম এবং ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলিতে নারীদের শারীরিক সৌন্দর্য এবং ব্যক্তিগত জীবনকে অত্যধিক উপস্থাপন করা হয়, যা তাদেরকে কখনও কখনও এক ধরনের ‘কমোডিটি’ হিসেবে দেখায়। একই সাথে, সেলফি সংস্কৃতির প্রসারের ফলে, নারীদের নিজেদের শারীরিক ছবি প্রকাশের মাধ্যমেও তারা আরও বড় ধরনের চাপ অনুভব করেন। এতে তারা নিজেকে প্রচারের মাধ্যমে আরো বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চায়, কিন্তু এর পাশাপাশি তাদের উপর মানসিক চাপও বৃদ্ধি পায়।

এছাড়া, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও নারীদের প্রতিনিধিত্বের বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। বেশিরভাগ সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে পুরুষ সাংবাদিকদের সংখ্যা বেশি, যার ফলে নারীদের খবর এবং দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থাপন কম হয়ে থাকে। এমনকি যেখানে নারীরা সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন, সেখানে তাদের ফিচার রিপোর্ট এবং আলোচনার বিষয়বস্তু অনেক সময় নারীদের জীবন, সম্পর্ক বা সৌন্দর্য নিয়েই থাকে, পুরুষদের কর্মক্ষেত্র বা রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে নয়। এর ফলে, নারীদের কাজের এবং বৈষয়িক গুরুত্ব কমে যায় এবং তারা শুধুমাত্র একটি ‘সাজানো’ বা ‘সৌন্দর্যপূর্ণ’ অবস্থানে ঠেলে দেয়া হয়।

এই প্রসঙ্গে, ২০১৭ সালের ‘MeToo’ আন্দোলন একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এটি পুরো বিশ্বব্যাপী নারীদের প্রতি যৌন হেনস্তা এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উত্তেজনা সৃষ্টি করে, এবং মিডিয়া তথা সংবাদমাধ্যমে নারীদের প্রতিক্রিয়া এবং আন্দোলনের গুরুত্ব প্রদর্শন করতে সহায়ক ছিল। “MeToo” আন্দোলন মানবাধিকার এবং নারীদের অধিকারের প্রতি বিশ্বজুড়ে একটি নতুন মনোভাব সৃষ্টি করেছে, যেখানে নারীদের নির্যাতন ও তাদের বিরুদ্ধে অবিচারকে সাহসিকতার সাথে তুলে ধরা হয়েছে। এটি মিডিয়াতে নারীদের সাহসিকতা এবং শক্তির নতুন এক চিত্র তুলে ধরেছে।

মোটের উপর, মিডিয়ায় লিঙ্গ প্রতিনিধিত্বের সমস্যা এখনও একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ। মিডিয়া তার মাধ্যমিক ভূমিকা পালন করার সময় যদি নারী-পুরুষের বৈষম্য হ্রাস করার চেষ্টা না করে, তবে সমাজে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাবে। তবে, মিডিয়ায় নারীদের সমান অধিকার এবং প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা গেলে এটি সমাজের উন্নতি, সুষমতা এবং ন্যায়বিচারের পথ প্রশস্ত করতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *