ভাববাদী শিক্ষা দর্শনের পরিচিতি
‘ভাববাদ’ (Idealism) শব্দটি প্রথম দিকে প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর চিন্তাধারার সাথে সম্পর্কিত ছিল, তবে আধুনিক দার্শনিক চিন্তায় এটি একটি বিশেষ দার্শনিক প্রবণতা বা মতবাদ হিসেবে পরিচিত। ভাববাদী শিক্ষা দর্শন মূলত মানবসত্তার আত্মিক ও আধ্যাত্মিক দিককেই সর্বোচ্চ সত্য বলে মনে করে এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, পৃথিবীর জগৎ বা বস্তুগত বাস্তবতা একেবারে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করে। ভাববাদীদের মতে, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃত রূপ ও উদ্দেশ্য হলো মানসিক বা ভাবগত স্তরের মধ্যেই নিহিত। পৃথিবীজগতের সবকিছুই আমাদের চিন্তা ও মননের প্রতিফলন। এই মতবাদ অনুযায়ী, জ্ঞান ও শিক্ষা মানব চেতনার বিকাশের মাধ্যমে অর্জিত হয়।
ভাববাদী শিক্ষা দর্শন কেবলমাত্র প্লেটোর মতবাদ থেকে উদ্ভূত নয়, বরং এর পরবর্তী আধুনিক দার্শনিকরা যেমন হেগেল, কান্ত, ও হিউম এসব চিন্তাধারার বিভিন্ন দিকগুলোতে আরও বিশ্লেষণ করেন এবং শিক্ষা ও সমাজের প্রতি এর প্রভাবের ওপর আলোচনা করেন। এই দার্শনিকরা শিক্ষা ও মননশীলতার ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেন, এবং তাদের মতে, চিন্তাশক্তি বা ভাবনা পৃথিবীজগতের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি, যা বাস্তবতার ধারনা ও মানব জীবনের ভিত্তি স্থাপন করে।
ভাববাদী শিক্ষা দর্শনের মূলনীতি
ভাববাদী শিক্ষা দর্শনের মূলতত্ত্বগুলোকে নিম্নরূপে আলোচনা করা যেতে পারে:
1. আত্মবিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতা: ভাববাদীরা বিশ্বাস করেন যে, বিশ্বজগতের মূল ভিত্তি হলো আত্মা বা চিন্তা, যা বাস্তবতা তৈরি করে। এটি মানসিক বা আধ্যাত্মিক স্তরে বিদ্যমান। তাই, শিক্ষার লক্ষ্যও হলো মানুষের আত্মার উন্নতি, আধ্যাত্মিক বিকাশ এবং চিন্তার স্বাধীনতা।
2. জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া: ভাববাদীদের মতে, প্রকৃত জ্ঞান বাহ্যিক জগৎ থেকে আসেনা, বরং এটি মানুষের চিন্তা, উপলব্ধি ও অভ্যন্তরীণ সচেতনতা থেকে উদ্ভূত। শিক্ষার লক্ষ্য হলো, শিক্ষার্থীর অন্তর্গত চিন্তা ও আত্মবিশ্বাসের বিকাশ ঘটানো। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, শিক্ষার্থীর মানসিক ক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
3. শিক্ষার উদ্দেশ্য: ভাববাদী শিক্ষা দর্শনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটানো, তাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন করা এবং আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। এখানে শিক্ষকের ভূমিকা হলো শিক্ষার্থীদের আধ্যাত্মিক ও চিন্তাগতভাবে গড়ে তুলতে সহায়তা করা।
4. অবাধ চিন্তা ও স্বাধীনতা: ভাববাদী শিক্ষা দর্শনে শিক্ষার্থীর চিন্তা ও অনুভূতির স্বাধীনতাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শ বা রীতির প্রতি বাধ্য না করে, তাদের অন্তর্দৃষ্টি ও স্বাধীন চিন্তার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ প্রদান করা হয়।
ভাববাদী শিক্ষা দর্শনের উপকারিতা
ভাববাদী শিক্ষার কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে, যেমন:
1. মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়ন: ভাববাদী শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণাবলী যেমন সৎ, ন্যায়পরায়ণ, সহানুভূতিশীল, ও আধ্যাত্মিক উন্নতির দিকে মনোযোগ দেয়া হয়। এতে মানবিক চরিত্র গঠন হয়।
2. চিন্তার বিকাশ: এই শিক্ষাদর্শনে শিক্ষার্থীদের চিন্তার ক্ষমতা ও সমালোচনামূলক মনোভাবের বিকাশ ঘটে। ফলে, তারা নিজেদের চিন্তা ও ধারণার প্রতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
3. আধ্যাত্মিক মুক্তি: ভাববাদী শিক্ষার লক্ষ্য আধ্যাত্মিক মুক্তি, যা শিক্ষার্থীদের জীবনের গভীর অর্থ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।
ভাববাদী শিক্ষা দর্শনের বিরুদ্ধে মৌলিক আপত্তিসমূহ
তবে, ভাববাদী শিক্ষা দর্শনের বিরুদ্ধে কিছু মৌলিক আপত্তি রয়েছে, যা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজ ও জীবনের বাস্তবতার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। নিচে কিছু মূল আপত্তি আলোচনা করা হল:
১. বাস্তবতার প্রতি অবহেলা:
ভাববাদীরা বিশ্বাস করেন যে, প্রকৃত জ্ঞান বাহ্যিক পৃথিবী থেকে আসেনা, বরং এটি চিন্তা ও আধ্যাত্মিক অবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু, বাস্তব জীবনের প্রতিদিনের সমস্যা, প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষতা এবং সামাজিক বাস্তবতার দিকে ভাববাদী শিক্ষার দৃষ্টি যথেষ্ট সীমিত।
বিরোধী দৃষ্টিকোণ: আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াগুলি বাস্তব জগতের সমস্যা সমাধানের জন্য অপরিহার্য। সমাজের অগ্রগতির জন্য যে ধরনের দক্ষতা, প্রযুক্তি ও জ্ঞানের প্রয়োজন, ভাববাদী শিক্ষা তাতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় না। শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনের দক্ষতা ও সমস্যার সমাধানে পিছিয়ে পড়তে পারে।
২. অতি তত্ত্বগত দৃষ্টিভঙ্গি:
ভাববাদী শিক্ষার পদ্ধতিতে আধিক্য বজায় রাখা হয় তত্ত্বগত আলোচনার প্রতি, যার ফলে শিক্ষার্থীরা অনেক সময় বাস্তব শিক্ষা বা কার্যকরী জ্ঞান থেকে দূরে থাকতে পারে। এটি তাদের জীবনের ব্যবহারিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে হতাশাজনক প্রভাব ফেলতে পারে।
বিরোধী দৃষ্টিকোণ: শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের জন্য প্রস্তুত করা। যদিও ভাববাদী শিক্ষা আধ্যাত্মিক ও চিন্তাশক্তির বিকাশে গুরুত্ব দেয়, তবে তা কার্যকরী দক্ষতা এবং সমাজে প্রাপ্তি অর্জনের জন্য যথেষ্ট নয়। শিক্ষার্থীদের শুধু তত্ত্বের দিকে মনোযোগ দেওয়া, বাস্তব জীবনে প্রয়োগযোগ্য জ্ঞান লাভের পথে বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে।
৩. স্বাধীন চিন্তার বিকাশের প্রতিবন্ধকতা:
ভাববাদী শিক্ষায় শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের চিন্তার গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করেন। শিক্ষককে গুরু বা আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে দেখা হয়, যা শিক্ষার্থীদের স্বাধীন চিন্তা ও মতামতের বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
বিরোধী দৃষ্টিকোণ: আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের স্বাধীন চিন্তা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা যখন নিজের মতামত ও চিন্তাধারা প্রকাশ করতে পারে না, তখন তারা সমাজের উন্নয়নে ও সৃজনশীলতায় পূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। ভাববাদী শিক্ষার এই দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি উদাসীন করে তোলে।
৪. সামাজিক এবং বৈজ্ঞানিক উন্নতির সঙ্গে অসামঞ্জস্য:
ভাববাদী শিক্ষা দর্শন সমাজের বাহ্যিক, বাস্তবিক ও বৈজ্ঞানিক দিককে উপেক্ষা করে আধ্যাত্মিক এবং চিন্তাগত দিককেই গুরুত্ব দেয়। তবে, আধুনিক সমাজে যেখানে বৈজ্ঞানিক উন্নতি, প্রযুক্তির উৎকর্ষ এবং সামাজিক পরিবর্তন অপরিহার্য, সেখানে এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের উন্নতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বিরোধী দৃষ্টিকোণ: আধুনিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজের উন্নতি ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ গঠন। ভাববাদী শিক্ষা সে ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত, কারণ এটি বাস্তব সমস্যা সমাধান, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানের উন্নয়ন তেমনভাবে গুরুত্ব দেয় না।
৫. অতিমূল্যায়ন ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি:
ভাববাদী শিক্ষায় বিশ্বের অন্তর্গত উদ্দেশ্য এবং মানসিকতা খুব বেশি গুরুত্ব পায়, যা কখনো কখনো বাস্তব জীবনের দৃষ্টিতে অতিরিক্ত বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গি কখনো কখনো প্রাকৃতিক বা শারীরিক বিজ্ঞান এবং বিশ্বের নিয়মাবলী সম্পর্কে ভুল ধারণার জন্ম দেয়।
বিরোধী দৃষ্টিকোণ: আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে, মানুষের মন এবং শারীরিক পৃথিবী উভয়ই পরিপূরক। শুধু আধ্যাত্মিক বা ভাবগত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পুরো পৃথিবী বা সমাজের প্রকৃত পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, পৃথিবীজ্ঞান ও বাস্তবতার সমস্যা সমাধান অপরিহার্য, যা ভাববাদ
১২.শিক্ষার মতবাদ হিসাবে ভাববাদ ও প্রকৃতিবাদের পার্থক্য এবং প্রয়োগবাদে তাদের সমন্বয় কর
শিক্ষা শুধু জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া নয়, এটি একটি দার্শনিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ব্যক্তিগত উন্নতির পন্থাও বটে। শিক্ষার বিষয়বস্তু, উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি নিয়ে বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদ রয়েছে। এর মধ্যে দুটি প্রধান মতবাদ হচ্ছে ভাববাদ (Idealism) এবং প্রকৃতিবাদ (Realism)। এই দুই মতবাদ শিক্ষার দর্শনে একে অপরের বিপরীত অবস্থানে থাকলেও প্রয়োগবাদ (Pragmatism) তাদের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন সৃষ্টি করেছে। এই প্রবন্ধে আমরা প্রথমে ভাববাদ ও প্রকৃতিবাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করব এবং তারপর প্রয়োগবাদে তাদের সমন্বয়ের বিষয়টি আলোচনা করব।
১. ভাববাদ (Idealism) ও প্রকৃতিবাদ (Realism) এর পার্থক্য
১.১. ভাববাদ (Idealism)
ভাববাদ শিক্ষার এক দার্শনিক মতবাদ, যা মূলত প্লেটো (Plato) এবং এরিস্টটলের (Aristotle) দর্শন থেকে উদ্ভূত। ভাববাদ অনুযায়ী, প্রকৃতির চেয়ে মন ও চিন্তা অধিক গুরুত্ব বহন করে। এই মতবাদে বিশ্বাস করা হয় যে, মানুষের আত্মার উন্নতি, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলি, এবং মনের উত্তরণই শিক্ষার মূল লক্ষ্য। ভাববাদীরা বিশ্বাস করেন যে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো চিরকালীন ও অপরিবর্তনীয় সৎ আদর্শের অনুসরণ এবং সেই আদর্শ অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন করা।
ভাববাদীরা পৃথিবীকে সাময়িক এবং পরিবর্তনশীল হিসেবে দেখেন, এবং তারা বিশ্বাস করেন যে, স্থায়ী ও সঠিক জ্ঞান কেবলমাত্র ভাবনা, দর্শন এবং মনের মধ্যে নিহিত। শিক্ষার পদ্ধতি হিসেবে তারা বইয়ের পাঠ, বক্তৃতা এবং চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের চিন্তার বিকাশ ঘটাতে চান। তারা বলেন, “জ্ঞান বা সত্য কখনো পরিবর্তনশীল নয়, এটি চিরন্তন।”
১.২. প্রকৃতিবাদ (Realism)
অন্যদিকে, প্রকৃতিবাদ একটি বাস্তববাদী দার্শনিক মতবাদ, যা অর্গানিক প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক ঘটনাবলীকে প্রধান গুরুত্ব দেয়। প্রকৃতিবাদী শিক্ষাবিদদের মতে, প্রকৃতির নিয়ম বা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং শিক্ষার লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে জীবনের বাস্তবতা ও সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করা। প্রকৃতিবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, শিক্ষার্থীরা যা কিছু শেখে তা যেন প্রকৃতির নীতি এবং বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে থাকে।
এমনকি, প্রকৃতিবাদীরা বলেন যে, সত্য বা জ্ঞান কেবলমাত্র সেই বিষয়গুলিতে নিহিত থাকে, যা বাস্তবে অস্তিত্বশীল এবং বাস্তবজগতের মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায়। এই মতবাদে চিন্তার পরিবর্তে প্রকৃতির অবস্থান এবং বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়গুলির মধ্যে থাকা বাস্তবতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। শিক্ষার পদ্ধতি হিসেবে তারা সরাসরি শিক্ষার্থীদের প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত কার্যক্রম, পরিবীক্ষণ ও বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষাকে সমর্থন করেন।
২. ভাববাদ ও প্রকৃতিবাদের মধ্যে পার্থক্য
মূলে পার্থক্য: ভাববাদী শিক্ষাবিদরা মনে করেন, জ্ঞান কেবল মন ও চিন্তার মাধ্যমে অর্জন করা যায়, তা চিরন্তন এবং অমর। প্রকৃতিবাদীরা মনে করেন, জ্ঞান কেবল প্রকৃতির ঘটনা এবং বাস্তবতার মাধ্যমে অর্জন করা যায়, যা পরিবর্তনশীল এবং প্রাকৃতিক।
শিক্ষার উদ্দেশ্য: ভাববাদীদের মতে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক গুণাবলি বিকাশ করা, যাতে তারা সঠিক আদর্শ অনুসরণ করতে পারে। প্রকৃতিবাদীরা মনে করেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের প্রকৃতির সঠিক ধারণা দেওয়া, যাতে তারা জীবনের বাস্তবতায় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
শিক্ষার পদ্ধতি: ভাববাদীরা বইয়ের পাঠ, বক্তৃতা, আলোচনা, সাহিত্য এবং দর্শনকে গুরুত্ব দেন, যেখানে চিন্তা ও মনের ওপর জোর দেওয়া হয়। প্রকৃতিবাদীরা শিক্ষার্থীদের প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত কার্যক্রম, প্রকৃতির নিয়ম অনুসরণ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যবহার করেন।
মানবপ্রকৃতি: ভাববাদীরা বিশ্বাস করেন, মানুষের প্রকৃতি হল আত্মিক, আধ্যাত্মিক ও চিন্তাশীল। প্রকৃতিবাদীরা মানুষের প্রকৃতিকে বাস্তববাদী এবং প্রাকৃতিক বলে মনে করেন।
৩. প্রয়োগবাদ (Pragmatism) এর মাধ্যমে ভাববাদ ও প্রকৃতিবাদের সমন্বয়
প্রয়োগবাদ একটি আধুনিক শিক্ষাদর্শন, যা উইলিয়াম জেমস (William James) এবং জন ডিউই (John Dewey) এর মতবাদ থেকে উদ্ভূত। প্রয়োগবাদী শিক্ষাবিদরা বিশ্বাস করেন যে, শিক্ষা একটি প্রক্রিয়া, যা শুধুমাত্র ধারণা এবং তত্ত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে সহায়ক। তারা মনে করেন, শিক্ষা তার ফলাফল দ্বারা মূল্যায়িত হওয়া উচিত, এবং শিক্ষা প্রক্রিয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের কার্যকরী এবং বাস্তব জীবনে উপযুক্ত দক্ষতা প্রদান করা।
প্রয়োগবাদীরা ভাববাদ এবং প্রকৃতিবাদ উভয় দিকই গ্রহণ করেন। তারা মনে করেন, চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয় সত্যের অনুসন্ধান জরুরি, তবে সেই অনুসন্ধানটি বাস্তব জীবনের সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে হবে। প্রয়োগবাদীরা শিক্ষার্থীদের এমন ভাবে গড়ে তুলতে চান, যাতে তারা চিন্তা করতে পারে, বাস্তব সমস্যাগুলির সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারে এবং তাদের জ্ঞানকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারে।
৩.১. ভাববাদ ও প্রয়োগবাদ
প্রয়োগবাদী শিক্ষাবিদরা ভাববাদী চিন্তাকে প্রশংসা করেন, তবে তারা এটি বিশ্বাস করেন যে, চিন্তা এবং আদর্শ শুধুমাত্র এক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং বাস্তবতায় কার্যকর হতে হবে। তাদের মতে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের আধ্যাত্মিক এবং নৈতিকভাবে উন্নতি করা, তবে এটি এমনভাবে হতে হবে যাতে তারা জীবনের বাস্তব সমস্যা মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়।
৩.২. প্রকৃতিবাদ ও প্রয়োগবাদ
প্রকৃতিবাদীরা যেমন প্রকৃতির নিয়ম এবং বাস্তবতার ওপর গুরুত্ব দেন, প্রয়োগবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, এই নিয়মগুলো একমাত্র তখনই গুরুত্বপূর্ণ, যখন তারা শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধানে কাজে আসে। প্রয়োগবাদীরা প্রকৃতির বিজ্ঞান ও নিয়মগুলোকে কার্যকরীভাবে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অংশ হিসেবে গ্রহণ করেন, তবে তারা এটিও বিশ্বাস করেন যে, শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু প্রকৃতির নিয়ম জানা নয়, বরং সেই নিয়মগুলোকে জীবনযাত্রায় প্রয়োগ করা।
৪. সমন্বয়ের গুরুত্ব
ভাববাদ এবং প্রকৃতিবাদের মতবাদ শিক্ষার প্রেক্ষাপটে একে অপরের সম্পূরক। প্রয়োগবাদ তাদের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করে, যা শিক্ষার উদ্দেশ্য এবং পদ্ধতিতে একটি ভারসাম্য রক্ষা করে। প্রয়োগবাদ শিক্ষার্থীদের এমনভাবে তৈরি করে, যাতে তারা চিরকালীন সত্য এবং প্রকৃতির নিয়মকে একত্রে গ্রহণ করতে পারে এবং সেগুলির ভিত্তিতে জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে পারে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করলে, শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন করবে না, বরং তারা সেই জ্ঞানকে জীবনের বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার সক্ষমতা অর্জন করবে। এতে শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র বুদ্ধির উন্নতি নয়, বরং সামাজিক, নৈতিক এবং বাস্তব জীবনের দক্ষতা অর্জনও হবে।
উপসংহার
ভাববাদ, প্রকৃতিবাদ এবং প্রয়োগবাদ, এই তিনটি দার্শনিক মতবাদ শিক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে ভাববাদ এবং প্রকৃতিবাদ নিজেদের মধ্যে পার্থক্য রেখে শিক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করে, সেখানে প্রয়োগবাদ তাদের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে শিক্ষার উদ্দেশ্য এবং পদ্ধতিতে ভারসাম্য আনে। প্রয়োগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার্থীদের আধ্যাত্মিক, নৈতিক এবং বাস্তবিক উন্নতির পথপ্রদর্শক, যা শিক্ষাকে শুধু তাত্ত্বিক না, বরং জীবনের প্রত্যক্ষ অংশ বানিয়ে তোলে।