বিশ্ব-সিস্টেম তত্ত্ব, যা ইমমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, একটি গভীর বিশ্লেষণমূলক কাঠামো যা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং বৈশ্বিক শ্রেণীবিভাগ বুঝতে সাহায্য করে। এই তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি কিভাবে রাষ্ট্রসমূহের ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান পৃথিবীর বৃহত্তর অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোর সাথে সম্পর্কিত। বিশ্ব-সিস্টেম তত্ত্বের মূল ধারণাটি হল যে, পৃথিবী একটি একক, আন্তঃসংযোগিত ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে যেখানে রাষ্ট্রগুলো তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত: কোর (Core), সেমি-পেরিফেরি (Semi-Periphery), এবং পেরিফেরি (Periphery)।
বিশ্ব-সিস্টেম তত্ত্বের মাধ্যমে ইমমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন উপনিবেশবাদী ইতিহাস এবং তার পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো বিশ্লেষণ করেছেন। এই তত্ত্বের মতে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে একটি শক্তিশালী আধিপত্যবাদী কাঠামো বিদ্যমান, যেখানে কিছু রাষ্ট্র শীর্ষে অবস্থান করছে (কোর), কিছু রাষ্ট্র মাঝামাঝি অবস্থানে (সেমি-পেরিফেরি), এবং কিছু রাষ্ট্র চরমভাবে নির্ভরশীল এবং শোষিত অবস্থানে (পেরিফেরি) রয়েছে। এই শ্রেণীবিভাগ একটি গতিশীল ও পরিবর্তনশীল কাঠামো তৈরি করে, যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে পারে, তবে সাধারণভাবে কোর, সেমি-পেরিফেরি, এবং পেরিফেরি রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সম্পর্কের ভারসাম্য সেই দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবের উপর নির্ভর করে।
কোর রাষ্ট্র (Core States)
কোর রাষ্ট্রগুলো হলো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শক্তি, যেগুলো আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আধিপত্য বজায় রাখে। এই রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং উন্নত, এবং তারা বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য, শিল্প, এবং তথ্য প্রযুক্তির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করে। কোর রাষ্ট্রগুলো সাধারণত উন্নত শিল্পজাত দেশ, যেমন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, এবং ফ্রান্স। এসব দেশ তাদের শক্তিশালী শিল্প খাত, উচ্চ প্রযুক্তির উদ্ভাবন, এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিশ্বের অর্থনৈতিক কাঠামোতে প্রভাব বিস্তার করে।
কোর রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি সাধারণত সম্পূর্ণ শিল্পকেন্দ্রিক, যেখানে প্রযুক্তি, গবেষণা এবং উন্নয়ন (R&D), এবং নিত্যনতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে তারা বিশ্বব্যাপী শক্তির আধিপত্য বজায় রাখে। এই রাষ্ট্রগুলো সাধারণত গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করে এবং বিশ্বের অধিকাংশ বাণিজ্য ও বিনিয়োগের নিয়ন্ত্রণ করে। উদাহরণস্বরূপ, নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, এবং টোকিও এর মতো শহরগুলো আন্তর্জাতিক ব্যবসা এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল। কোর রাষ্ট্রগুলোর প্রযুক্তি এবং শিক্ষা খাতও পৃথিবীজুড়ে প্রভাব বিস্তার করে, যা তাদের উন্নয়ন এবং আধিপত্যকে আরও শক্তিশালী করে।
সেমি-পেরিফেরি রাষ্ট্র (Semi-Periphery States)
সেমি-পেরিফেরি রাষ্ট্রগুলি কোর এবং পেরিফেরি রাষ্ট্রগুলোর মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছে। এই রাষ্ট্রগুলো প্রথাগতভাবে উন্নয়নশীল হলেও, তাদের অর্থনীতি, শিল্প উৎপাদন, এবং প্রযুক্তিগত ক্ষমতা কিছুটা শক্তিশালী, যা তাদের কোর রাষ্ট্রগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করে। তবে, সেমি-পেরিফেরি রাষ্ট্রগুলোকে কোর রাষ্ট্রগুলোর মতো পূর্ণ ক্ষমতা বা আধিপত্যের অবস্থানে রাখা যায় না। সেমি-পেরিফেরি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রয়েছে যেমন দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ব্রাজিল, ভারত এবং মেক্সিকো।
এই রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা শক্তিশালী হলেও, তাদের ওপর কোর রাষ্ট্রগুলোর প্রভাব দৃশ্যমান। তাদের অর্থনীতি সাধারণত বহুমুখী এবং কিছু ক্ষেত্রে এই দেশগুলোকে বিশ্বের বৃহত্তম উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে দেখা যায়। তবে, তাদের বিপুল জনগণের জন্য শ্রমিক শ্রেণী এবং নিম্ন-আয়ের জনগণের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্যাগুলোর মধ্য দিয়ে, সেমি-পেরিফেরি রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি মাঝে মাঝে অস্থির থাকে। এই রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও রাজনীতিতে কিছুটা স্বাধীনতা ও প্রভাব তৈরি করতে পারে, তবে তাদের মধ্যে কোর রাষ্ট্রগুলোর প্রভাব সারা বিশ্বের নীতি নির্ধারণে কখনও কখনও অতিক্রম করতে পারে না।
পেরিফেরি রাষ্ট্র (Periphery States)
পেরিফেরি রাষ্ট্রগুলি হল বিশ্বের সবচেয়ে অনুন্নত এবং শোষিত দেশসমূহ। এই রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক কাঠামো অত্যন্ত দুর্বল, এবং তারা কোর রাষ্ট্রগুলোর উপর গভীরভাবে নির্ভরশীল। পেরিফেরি রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি সাধারণত প্রাথমিক খাত এবং কৃষি উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল, এবং তারা প্রযুক্তি এবং গবেষণায় পিছিয়ে থাকে। আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া, এবং ল্যাটিন আমেরিকার বেশ কিছু দেশ পেরিফেরি রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত।
এই রাষ্ট্রগুলোতে সাধারণত অত্যন্ত নিম্নমানের জীবনযাপন, অশিক্ষা, এবং স্বাস্থ্য সেবার অভাব লক্ষ্য করা যায়। পেরিফেরি রাষ্ট্রগুলো কোর রাষ্ট্রগুলোর বাণিজ্যিক এবং রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল, এবং তারা তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক শর্তগুলির পরিবর্তনের জন্য অনেক সময় কোর রাষ্ট্রগুলোর দয়ায় নির্ভরশীল থাকে। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকার অনেক দেশ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার জন্য কোর রাষ্ট্রগুলির উপর নির্ভরশীল, যার ফলে তাদের নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো অনেক সময় এসব শক্তির ইচ্ছার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
বিশ্ব-সিস্টেম তত্ত্বের বাস্তব উদাহরণ
বিশ্ব-সিস্টেম তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগে, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারত দুটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারত সেমি-পেরিফেরি রাষ্ট্র হিসেবে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে, যদিও তারা এখনও কোর রাষ্ট্রগুলোর তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে।
অন্যদিকে, আফ্রিকার দেশগুলো যেমন কঙ্গো এবং সুদান, পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র এবং শোষিত রাষ্ট্র হিসেবে পেরিফেরি শ্রেণিতে পড়ে, যেখানে অর্থনৈতিক অনিয়ম এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রভাব ফেলছে। এই দেশগুলো এখনও উন্নত দেশগুলোর দ্বারা শোষিত এবং তাদের অর্থনীতি বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল।
উপসংহার
বিশ্ব-সিস্টেম তত্ত্বের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সম্পর্ক এবং ক্ষমতার বিভাজন ভালোভাবে বোঝা যায়। কোর, সেমি-পেরিফেরি, এবং পেরিফেরি রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক শোষণ এবং আধিপত্যের সম্পর্ক বিদ্যমান, তা বিশ্বব্যাপী বৈশ্বিক শাসন এবং অর্থনৈতিক কাঠামোকে শক্তিশালী করে। এই তত্ত্ব আমাদের এই বোধও তৈরি করতে সাহায্য করে যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করা এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির পরিবর্তনশীল কাঠামোর মধ্যে শক্তি সঞ্চয় করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব-সিস্টেম তত্ত্ব রাষ্ট্রসমূহের বৈশ্বিক কাঠামো এবং তাদের মধ্যে সম্পর্কের গভীর বিশ্লেষণ দিয়ে পৃথিবীকে একটি একক সিস্টেম হিসেবে বুঝতে সহায়তা করে, যেখানে প্রতিটি রাষ্ট্রের ভূমিকা এবং অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।