বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অনেক শিক্ষার্থীই ধূমপানে আসক্ত হয়, মাদকে জড়িয়ে যায়। অনেকে মুক্তির পথ খুঁজতে জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন অন্যায় কর্মকাণ্ডে। সাময়িক আনন্দ কিংবা মুক্তির আশায় নিজের ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলী দেওয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

ফাবিহা বিনতে হক
শিক্ষাজীবনের একেবারে প্রারম্ভ থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে উচ্চশিক্ষা বা পেশা বিষয়ক স্বপ্নের বীজ বপন করে দেওয়া হয়। কেউ ডাক্তার হতে চায়, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বা উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা, ইত্যাদি ইত্যাদি। মেডিকেল, বুয়েটের পর শিক্ষার্থীদের চাহিদার শীর্ষে থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এডমিশন টেস্টের মাধ্যমে যেকোনো পাবলিক ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারা যেন সোনার হরিণের মত। এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই, দীর্ঘশ্বাস কিংবা হতাশার অন্ত নেই। তবে দিনশেষে যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সুযোগ পায় তাদের জীবনটা কেমন হয়? চলুন দেখি একবার…
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ নিঃসন্দেহে শিক্ষার্থীদের আবেগ অনুভূতির অনেকটা জায়গা দখল করে রাখে। ক্যাম্পাসে প্রথম পা রাখার পর সে জায়গার গাছপালা থেকে শুরু করে ইটপাথর পর্যন্ত আপনার মনে হয়। কিন্তু দূর থেকে চাঁদ যতটা সুন্দর, যত স্নিগ্ধ তার আলো, কাছেও কী ঠিক ততোটাই? চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই। চাঁদ সূর্যের আলোতে আলোকিত করে নিজেকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ও ঠিক দূর থেকে চাঁদের মত দ্যুতি ছড়ায় কিন্তু কাছে পৌঁছে গেলে বোঝা যায়, সেই আলো আসলে সূর্যের। সূর্যের আলোতে টিকে থাকতে হলে নিজেকে শক্ত করে বিভিন্ন ধাপ পাড়ি দিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো আলো নেই যদি না সেখানকার সূর্যের মত প্রাণ ছড়ানো মানুষগুলো তাকে জ্বালিয়ে রাখে।
পাবলিক ভার্সিটির প্রধান সংকট হলো এখানে বিভিন্ন শ্রেণী, পেশা, ধর্ম, বর্ণের মানুষ একসাথে পড়তে আসে, থাকতে আসে। এই বিষয়টি যেমন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সবচেয়ে ভালো দিক, অন্যদিকে এটিই একজন ছাত্রের টিকে থাকায় কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। একজন শিক্ষার্থী যখন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হবার সুযোগ পায়, একটি নিশ্চিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে সে ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের আগে কেউ তাকে বলে দেয় না, এখানে আসার পর কী কী সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে সে। বড়জোর সিনিয়রদের র্যাগিং নিয়ে কিছুটা ধারণা আগে থেকে দিয়ে দেওয়া হয়। হুমায়ুন আহমেদের লেখা দ্বারুচিনি দ্বীপ সিনেমার মত একটা চমৎকার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, দারুণ কিছু বন্ধুত্ব আর সুখ স্বপ্নময় প্রতিটা দিনের কল্পনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীনেরা বিভোর হয়ে থাকে। ভাগ্যবান মানুষেরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সুখের জীয়নকাঠি পেয়ে যায় তবে বেশীরভাগই হতাশার কুন্ডলীতে আবদ্ধ হয়ে দিন গুনতে থাকে কবে সার্টিফিকেট নিয়ে পড়াটা শেষ করতে পারবে।
বাংলাদেশের পাবলিক ভার্সিটিগুলোর অন্যতম প্রধান সংকটই হলো সেশন জট।
আর বর্তমানের করোনকালীন সময়ে এই সমস্যার কথা তো বলার আর অপেক্ষাই রাখে না। ইতোমধ্যে কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর হতাশা থেকে আত্মহত্যার খবর আমরা পেয়েছি।
আগেই বলেছি, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থানে অনেক ভিন্নতা থাকে। এটিই পাবলিক ভার্সিটির সৌন্দর্য। কিন্তু এই ভিন্নতা যে ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনে কতটা বৈষম্যের সৃষ্টি করতে পারে তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানে। এখানে যেমন সমাজের উঁচুস্তরে অবস্থান করা শিক্ষার্থীরাও পড়তে আসে বাবার বিলাসবহুল গাড়ি চেপে, তিনবেলা ঠিকমতো খেতে পারতো না এমন পরিবারের সন্তানও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে। পারিবারিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের ভিন্নতার দরুন তাদের জীবনাচরণ, বিশ্বাস, রুচির মাঝেও ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এই সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলো ব্যক্তির মাঝে কতটা প্রভাব ফেলে বা ফেলতে পারে তা আত্মহত্যার সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাকালীন সময়ে গত মার্চ মাস থেকে এখন পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছে মোট ৪০ জন মেডিকেল-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ১২ জন শিক্ষার্থীই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।
বলা হয়ে থাকে, স্কুলজীবনের বন্ধুদের মত কেউ হয় না। বেশ কিছুদিন আগে সোশাল মিডিয়ায় একটি কথা খুব ভালোভাবে ভাইরাল হয়েছিল যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সব বন্ধুই সাপ। এটি অনেকাংশেই ভুল ধারণা, তবে এই ধারণার পেছনে যেসব কারণ বিদ্যমান তা আপনি একেবারে ফেলে দিতে পারবেন না। উচ্চশিক্ষা অর্জনের এই স্তর পার হওয়ার পরই মানুষ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বে প্রতিটা সময় যদি আপনি নিজের পড়াশোনাসহ যাবতীয় কাজে মনোযোগী না হোন তবে পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। সফল ক্যারিয়ারের উচ্চাকাঙ্খা থেকে অনেকেই চরম স্বার্থপরতাকে নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়া বলে ভেবে থাকে। অনেক সময়ই দেখা যায়, সহপাঠী যদি খুব মামুলি একটা সাহায্যও চায়, তাকে সাহায্য করতে কয়েকবার ভেবে নিতে হয়। পড়াশোনার ক্ষেত্রে সিজিপিএ বাড়ানোর আশায় কাউকে সাহায্য করাও সেখানে অন্যায্য হিসেবে ধরা হয়। খুব লজ্জাজনক হলেও সত্য আমাদের বর্তমান সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তির এরূপ মনোভাবকে ‘প্র্যাক্টিক্যাল’, ‘লজিক্যাল’, ‘ইন্টেলিজেন্স’ বলে প্রচার করা হয়। এহেন প্র্যাক্টিক্যাল মানুষগুলোর প্রতি অন্যদের সমর্থনও খুব কম থাকে না।
এবার আসি,শিক্ষার্থীদের শিল্পচিন্তায় (?)
বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকে থাকতে, অন্তত কিছুটা সম্মানের সাথে টিকে থাকতে গেলে আপনাকে পড়াশোনার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়েও সম্মক জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। আপনাকে সাহিত্য পড়তে হবে, আপনাকে আর্ট বুঝতে হবে, দুইটা পাঁচটা ভালো ভালো ক্লাসিকাল সিনেমার নাম জানতে হবে, আপনাকে পিংক ফ্লয়েডের গান শুনতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনার পাশের বন্ধুটি যদি এসব জেনে থাকে, অন্তত জানার ভান করে থাকে, সেই ভানটা আপনারও করতে হবে, নাহয় আপনি আধুনিক হতে পারবেন না, আপনি সমাজের তথাকথিত সভ্যতার সাথে তাল মেলাতে পারবেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকাংশ ছেলেমেয়েই গ্রামাঞ্চল বা মফস্বল থেকে আসে। সেখানে অবস্থান করা এলিট শিক্ষার্থীদের মাঝে তাদের প্রতি অনেক সময়ই এক ধরনের নাক সিটকানো ভাব লক্ষ্য করা যায়। জামা-জুতা থেকে শুরু করে চালচলন কোনকিছুতেই সেসব শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের মিল নেই। কিছুটা সংকুচিত ভাব তখন থেকেই চলে আসে আর এরপর যোগ হয় রুচির তফাৎ, এলিটদের আড্ডায় শামিল হতে না পারা বা হলেও চুপ করে শুনে যাওয়া। তাদের সাথে চিন্তার তফাৎ কিছুটা কমিয়ে আনতে ভান করতে হয়, প্রতিমুহূর্তে নিজের সাথে যুদ্ধ করতে হয়, কেন সে এসব জানে না, কেন সে তাদের মত হলো না। নিজের স্বকীয়তা ধ্বংসের মুখে ফেলে ক্রমাগত নিজেকে সাজাতে হয়। এই সাজসজ্জার মাধ্যমে নিজের শেকড় ভুলতে শুরু করে তারা।
মানুষের স্বকীয়তা ধ্বংস করতে শুধু ক্যাম্পাস লাইফ নয়, সোশাল মিডিয়ার অবদানও অনেক বেশী। নিজেকে জাহির করা, নিজের জ্ঞান জাহির করা, আমার পরিবার থেকে আমি কতটা মদদপুষ্ট আর ক্ষমতাশালী তা প্রমাণ করা আর রাজনীতির মারপ্যাঁচ একজন সাধারণ ছাপোষা পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনকে বিষিয়ে তুলতে পারে। তার মধ্যে আবার মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে থাকে তাদের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতার চর্চা করা কতিপয় শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিদের ইন্ধন বা পক্ষপাতিত্ব।
বর্তমান সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সবই শেখানো হয় কিন্তু কী করে একজন প্রকৃত মানুষ হওয়া যায় সেই শিক্ষা দেওয়া হয় না বা বলা ভালো, দেয়া হলেও শিক্ষার প্রয়োগ শিক্ষার্থীদের মাঝে তেমন দেখা যায় না। যার ফলে কর্মক্ষেত্রে সৎ থাকার প্রবণতার চেয়ে কী করে তড়তড়িয়ে সাফল্য এবং ক্ষমতার শীর্ষে ওঠা যায় সেই নেশায় মত্ত থাকে এদেশের তরুণসমাজ। এই সমস্যার সমাধান কী বা আদৌ তা সম্ভব কিনা আমি জানিনা। তবে এক্ষেত্রে নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্ব সম্পূর্ণই নিজের উপর বর্তায় এটুকু বলতে পারি। কিছুদিন পরই ভর্তিযুদ্ধে ব্রতী হবে শিক্ষার্থীরা। মানবজীবন কণ্টকশয্যা নয়। এধরনের সমস্যা, টানাপোড়েন সব জায়গায়ই থাকবে এবং তা মাথায় নিয়েই প্রতিটা পদক্ষেপ ফেলতে হবে ভেবেচিন্তে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অনেক শিক্ষার্থীই ধূমপানে আসক্ত হয়, মাদকে জড়িয়ে যায়। অনেকে মুক্তির পথ খুঁজতে জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন অন্যায় কর্মকাণ্ডে। সাময়িক আনন্দ কিংবা মুক্তির আশায় নিজের ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলী দেওয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন মানুষের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সময়। এসব সমস্যাকে মেধা, পরিশ্রম এবং মানবিকতার সাথে জয় করার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন আনন্দময় এবং সার্থক হতে পারে।

লেখকঃ
সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
যোগাযোগঃ fabihabintehaue83@gmail.com
Writing is not a view of the School of Thought, it is entirely the opinion of the Author.
If you want to share your thought, you can mail us at- editor.sot@gmail.com