বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠনের বর্তমান হালচাল ও ছলচাতুরী

স্বজনপ্রীতি বা পছন্দের নবীন সদস্য একটি সংগঠনের সবচেয়ে বড় ওপেন সিক্রেট। 

হেমায়েতউল্লাহ ইমন

সামাজিক ডিসকোর্সগুলোকে আরো সুস্থ ও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রাখে সামাজিক সংগঠনগুলো। সমাজের কল্যাণের জন্য যেকোনো পরিস্থিতিতে সংগঠনগুলো খুবই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে। আমাদের  ব্যক্তিজীবন ও ছাত্রজীবনকে সমৃদ্ধ করতে এই সংগঠনগুলোর যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। কেন সংগঠন করি প্রশ্নের উত্তরে নেতৃত্ব, ভ্রাতৃত্ব ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা শব্দগুলো ঘুরেফিরে আসে। সংগঠনের মৌলিকতার ভিত্তিতে কাজের পরিমাণ  এবং সদস্যরাই সংগঠনকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং এই প্রতিনিধিত্বকারীরাই নবীনদের আকৃষ্ট করে থাকে। একই পথে হাঁটতে সাহায্য করে। নীতি-নৈতিকতা, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা সংগঠনের সমার্থক শব্দ, এবং এসবই সংগঠনকে শক্তপোক্ত ভাবে দাঁড় করে  রাখে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সামাজিক-সেচ্ছাসেবী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠনগুলোর খুবই নাজেহাল অবস্থা। 

বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অরাজনৈতিক ও অলাভজনক সংগঠনগুলোর এরুপ বিশেষণে ‘অ’ এর ব্যবহার করে দিনের পর দিন যে ভন্ডামী করছে  তার টুকটাক আলোচনা করার চেষ্টা করব। 

শুরু থেকেই শুরু করা যাক। সংগঠনে যোগ দেওয়ার পিছনে একজন শিক্ষার্থীর প্রধান যে উদ্দেশ্য থাকে তা হলো তার একাডেমিক বিষয়ের বাইরে তার বিশেষ আগ্রহ, শৌখিনতা বা ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করে সার্বিক গুণাবলি অর্জন করা। সিভি ভারি করা। চাকরি বাজারে নিজের যোগ্যতা প্রকাশ করা। কিন্তু আমরা বাস্তবে দেখি যে বিভিন্ন সংগঠনে সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ‘ রিক্রুটমেন্ট’ বা ‘শর্তসাপেক্ষ’ থাকে। এর যৌক্তিকতা কি ? সংগঠন মানে কি চাকরিক্ষেত্র? যার সিভি যত ভারী সে সুযোগ পাবে, বাকিদের নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। এসব কোনভাবেই  সাংগঠনিক বিষয়াদি না । একজন নাচ,গান, রোবটিক্স বিষয়াদি  না জানলে যে সে ঐ সংগঠনে আগ্রহের ভিত্তিতে সদস্য হতে পারবে না, এটা সম্পূর্ণ  ভুল ধারণা। নাচ, গান ও রোবটিক্স না পারলেও সংগঠনে শেখার সুযোগ এবং সাংগঠিক অন্যান্য বিষয়াদি থাকে। এজন্য সংগঠনের রিক্রুটম্যান্টের ধারণা খুব একটা যুক্তিযুক্ত বলে মনে করি না। 

সমসাময়িক সকল ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি সমস্যাটি সবচেয়ে বেশী প্রকট। ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দেরও একটা সীমা আছে। মুদিমালের দোকান, রেষ্টুরেন্ট বা একান্তই ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে আপনি স্বজনদের নিয়োগ দিতে পারেন কিন্তু আপনি যখন কাগজকলমে একটা প্লাটফর্ম তৈরি করেন, এবং আপনার হাতে অনেকগুলো বৈধ অপশন থাকে তখন স্বজনপ্রীতি খারাপ, খুবই খারাপ। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবও যথেষ্ট ভয়ংকর। উদাহরণ হিসেবে বর্তমান সরকার প্রশাসনের কথা অনায়াসে বলা যায়।

স্বজনপ্রীতি বা পছন্দের নবীন সদস্য একটি সংগঠনের সবচেয়ে বড় ওপেন সিক্রেট। 

ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের ভিত্তিতে যখন সাংগঠনিক কাজ/পদ দেওয়া হয় তখন উক্ত সংগঠনের ইথিকসের যায়গা কতটুকু থাকে?  

যে সদস্য একে সাদরে গ্রহণ করে সে ঐ সিনিয়র সদস্য দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়ে, মানসিক দাসত্বে পরিনত হয়।  তার স্বকীয়তা বলতে তখন কিছু থাকে না। স্বজনের সিদ্ধান্তের বিপরীতে  সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। যেমনঃ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভিসি, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকান্ড। অপরদিকে যারা এর স্বীকার হয় তারাও সংগঠনের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়, মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। স্বজনপ্রীতির এই সিলসিলা চলতে থাকে, যোগ্যরা পিছিয়ে পড়ে এবং অযোগ্যরা সাংগঠনিক বড় বড় পদের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে, যার ফলস্বরূপ আমরা দেখতে পাই  সংগঠনগুলোতে কাজের চেয়ে অকাজই বেশী। দুঃখিত, অকাজ কথাটি তুলে নিলাম। যে কাজ হয় তা হয়ে যায় একটা নির্দিষ্টগোষ্ঠীর মতামতের ভিত্তিতে, একটা নির্দিষ্টগোষ্ঠীর পারস্পরিক স্বার্থ হাসিলের জন্য হয়। সার্বজনীন হয় না। 

তাছাড়া সবচেয়ে মজার বিষয় হলো সাংগঠনিক ক্ষেত্রে  এতসব দুর্নীতি, অনিয়ম করেও  তারা অন্যান্য ক্ষেত্রের অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে নিজেদের অবস্থান দেখায়। বলতে পারেন- ঘরের ভিতর যা-ই করুক, বাইরে সঠিক সময়ে সঠিক কাজটা করলেই হয়। ঠিকাছে, কিন্তু এতে যে সমস্যাটি হয়, আগেই বলছি তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ধরেন, সবথেকে ভালো মানের বীজ নিয়ে আপনি একটি চারা রোপণ করলেন কিন্তু তার সঠিক পরিচর্যা বা বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত জায়গা দিলেন না অর্থাৎ বারান্দার টবে কাঁঠাল গাছ লাগানোর অবস্থা আরকি। তখন নিশ্চয় আপনি টবের গাছ থেকে আশানুরূপ কাঁঠাল পাওয়ার আশা করবেন না?টবের এই কাঁঠালের চারার মতই আমাদের সার্বিক অবস্থা। যেকোনো সংগঠনের উদ্দেশ্যই থাকে সার্বিক উন্নয়নে কাজ করা। সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে একযোগে কাজ করা এবং সরকার (রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর কাজ),  ব্যাক্তিকে তার দায়িত্ব কর্তব্যের প্রতি সচেতন করে তোলা।  প্রয়োজনে বিক্ষোভ মিছিলের মাধ্যমে অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। কিন্তু যখন শিক্ষা নেওয়া জায়গাতে বা অধিকার সচেতনতা বৃদ্ধির জায়গাতেই সমস্যার সৃষ্টি হয় তখন তার ওরিয়েন্টেশনও ঐভাবে হয়।  ভবিষ্যতেও এর পরিবর্তন হয় না। এবং দিনের পর দিন চক্রাকারে চলতে থাকে। 

এসব কারণে যারা সুস্থ সমাজিক চর্চা করে, চর্চার পথ দেখায় এবং যাদের জন্য এইসব চর্চা করতে হয়, অবস্থান নিতে হয় উভয়ের সমান্তরালে এগুতে থাকে। দিনের পর দিন সমস্যা বেড়ে চলে, কিন্তু এর সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। এজন্য দরকার হয় সুষ্ঠু বিকাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই ভবিষ্যতের দেশের সার্বিক দায়িত্ব নিয়ে থাকে। তাদের ওরিয়েন্টেশন যদি এরকম বাজেভাবে হয় তাহলে এই সমান্তরাল রেখাগুলো এগুবে কিন্তু ফলপ্রসূ হবে না। এজন্য যে রেখাটির সহজেই দিক পরিবর্তন করে সমান্তরালকে ভেঙে অন্তর্বিভক্তের মাধ্যমে এগুতে পারবে, তাকে নিয়েই কাজ করা দরকার। বার বার ডাল না কেটে, গাছের মূল নিয়ে কথা বলতে হবে। সমস্যার গভীর সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পৌঁছাতে হবে। আর এরকম যদি না হয় এরচেয়ে খারাপ কিছু হতেই পারে না। সচেতন হওয়া দরকার, তা অবশ্যই সঠিক জায়গায়৷

লেখক,

শিক্ষার্থী, 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। 

যোগাযোগঃ hemon17399@gmail.com

Writing is not a view of the School of Thought, it is entirely the opinion of the Author.

If you want to share your thought, you can mail us at- editor.sot@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *